জাবিতে শ্রমিকের মৃত্যু, ৩ লাখে মিটিয়ে ৮ লাখের দলিলে সই!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন হল থেকে পড়ে মারা যান নির্মাণশ্রমিক শাহের আলী। তার মৃত্যুতে ফুসে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবির মুখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূরানী কনস্ট্রাকশন মৃতের পরিবারের একজনকে কোম্পানিতে স্থায়ী চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি ৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়।
তবে ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, নুরানী কনস্ট্রাকশনের অফিস মোহাম্মদপুরে ডেকে তিন লাখ টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকে দলিল সই নেওয়া হয়। এমনকি দলিলে সই নেওয়ার সময় ‘আট লাখ’ শব্দ যুগল উচ্চারণ করে শোনানো হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন মৃত শাহের আলীর বাবা শমসের আলী।
গত বছরের ২৭ মে শহীদ রফিক-জব্বার হল সংলগ্ন নির্মাণাধীন ২২ নম্বর হলের ৬ তলা থেকে পড়ে শাহের আলীর (২৫) মৃত্যু হয়। তার বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর কচাকাটা থানার নারায়ণপুর ইউনিয়নের পদ্মারচর গ্রামে। শাহের আলীর বাবা শমসের আলী ও মা শহর বানু।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে আসে, শাহের আলীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিবারের একজনকে কোম্পানিতে স্থায়ী চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং ৮ লাখ টাকা হস্তান্তর মর্মে দলিলে আছে। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারটি তিন লাখ টাকা পেয়েছে। তবে সেই টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দেয়নি বরং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি চাপ প্রয়োগ করে সাব-কনট্রাক্টরের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয়।
মৃত শাহের আলীর বাবা শমসের আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুর দুদিন পর ক্ষতিপূরণ নিতে আমাদের ঢাকায় কোম্পানির অফিসে ডাকে। তিন লাখ টাকা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাগজে টিপসই নেয়। আমাদের বলতে বলা হয়, আমাদের পক্ষ থেকে কোম্পানির কাছে আর কোনো দাবি নেই। কোম্পানির লোকজন তা ভিডিও করে। সেই টাকা নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরি।’
শমসের আলী আরও বলেন, ‘সে সময় আমাদের পক্ষে আমার শ্যালক মনিরুল এবং দুজন সাব-কনট্রাক্টর জাহাঙ্গীর আলম এবং আব্দুল কাদের দলিলে সই করেন। পরবর্তীতে আর একজন সাব-কনট্রাক্টর বেলাল আমাকে এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আজ পর্যন্ত দেননি।’
দলিলে ৮ লাখ টাকার উল্লেখের বিষয়ে শমসের আলী বলেন, ‘আমি মূর্খ লোক। দলিলে কী লেখা ছিল তা তো জানি না। টিপসই দিতে বলছে তাই দিয়েছি। আমার সামনে আট লাখ টাকার কথা কখনো উল্লেখ করেনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম তিন লাখ টাকাই সব।’
শাহের আলীর মা শহর বানু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’
দলিলে স্বাক্ষরকারী মনিরুল ইসলাম জাগো নিউকে বলেন, ‘আট লাখ টাকা দেওয়ার বিষয়টি জানি না। তবে কোম্পানির অফিসে সেদিন আমাদের তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়।’
সেদিন তিন লাখ টাকা দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছেন আরেক স্বাক্ষরকারী আব্দুল কাদেরও। তবে অপর সাক্ষী সাব-কনট্রাক্টর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এরকম ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুই-তিন লাখের বেশি টাকা দেয় না। যা দিয়েছে তাতেই আমরা খুশি ছিলাম। কাগজে কী আছে সেটা দেখার ওপর ততোটা গুরুত্ব দেইনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূরানী কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার মো. খোকন মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের চুক্তি অনুযায়ী ৮ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে দলিলে সই নেওয়া হয়। এ বিষয়ে তাদের কোনো দাবি নেই বলেও জানায়। মৃতের একমাত্র ছোট ভাই অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাকে কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার বয়স হলে সে ব্যবস্থাও করা হবে।’
খোকন মিয়া আরও বলেন, ‘টাকা হস্তান্তরের সময় নূরানী কনস্ট্রাকশন কোম্পানির এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) খন্দকার গোলাম কবির, প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) আহসান হাবিব এবং আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম। মরদেহ পরিবহন, দাফন এবং পরবর্তী অনুষ্ঠানের জন্যও টাকা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া সাব-কনট্রাক্টর বেলালের অধীনে শাহের আলী কাজ করতেন বলে বেলালও এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপরও যে কোনো সমস্যায় শাহের আলীর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে আমরা রাজি আছি।’
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন প্রথম দফায় জাগো নিউজের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নিজে উপস্থিত থেকে ভুক্তভোগী পরিবারটিকে ৮ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি করলেও দ্বিতীয় দফায় তিনি বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের বিষয়ে শ্রম-আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ থাকলেও মানবিক বিবেচনায় আমরা ভুক্তভোগীর পরিবারকে ৮ লাখ টাকা দেওয়ার চুক্তি করি। টাকা হস্তান্তরের মুহূর্তে আমি অন্য কক্ষে ছিলাম। টাকা হস্তান্তর শেষে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। দলিল অনুযায়ী টাকা না পেয়ে থাকলে এতদিন তারা অভিযোগ করলো না কেন?’
প্রকল্পটির নিবার্হী প্রকৌশলী (সিভিল) আহসান হাবিবও টাকা হস্তান্তরের সময় অন্য কক্ষে ছিলেন বলেন জানান। যদিও তাদের অন্য কক্ষে থাকার বিষয়টি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মো. খোকন মিয়া।
প্রকল্পের আরেক সাব-কনট্রাক্টর বেলাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহের আলী আমার অধীনে কাজ করে বলে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে তিন লাখ টাকা তার পরিবারকে দেওয়া হয় তার পুরোটা কোম্পানি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়। তাই আমার প্রতিশ্রুতির এক লাখ টাকা আর দিতে পারিনি। তার ক্ষতিপূরণ কোম্পানি বহন করলে ঠিকই আমি এক লাখ টাকা দিতাম।’
এ বিষয়ে নূরানী কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হয়নি। তবে তার ছেলে বর্তমান ডিরেক্টর হুমায়ুন কবির তুহিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটির পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে বলে আমি জানি। তবে আমার বাবা বিষয়টি ভালো জানেন। এতদিন পরে বিষয়টি আবার কেন উঠে এলো?’
এ বিষয়ে জাবি শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি আবু সাঈদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘৮ লাখ টাকার দেওয়ার কথা বলে তিন লাখ টাকা দিয়ে টিপসই নেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু জবাবদিহিতা চাই।’
জাবি সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাকিবুল হক রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এরকম জালিয়াতির ঘটনা ঘটে থাকলে আমরা অতিদ্রুত প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ভুক্তভোগী পরিবারকে ৮ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার যে, এ প্রকল্প দুর্নীতিতে ভরা আর এসবের আস্কারা দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
শাহের আলীর এলাকাবাসী জানান, নদী ভাঙনে সব সম্পত্তি চলে যাওয়ায় শাহের আলীর বাবা শমসের আলী তার শ্বশুরবাড়ির উঠানে বসবাস করে আসছেন। তিনি এখন দিনমজুর হিসেবে মাটিকাটার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শাহের আলীর মা শহর বানু দীর্ঘদিন ধরে স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। দারিদ্র্যতার কারণে শাহের আলীর একমাত্র ১৩ বছর বয়সী ছোট ভাই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন।
শাহের আলীর কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, বিশেষ এক ভয় থেকে শমসের আলী টাকা কম পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চান না।
এসজে/এমএস