‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে চান জাবি কর্মকর্তারা
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘সাহেব’, ‘বাবু’, ‘স্যার’ কিংবা ‘জনাব’ বলে সম্বোধন করা ঔপনিবেশিক একটি রীতি। যা সাধারণত দেশের আমলাতন্ত্র ও সামরিক দপ্তরে বহুল প্রচলিত। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারাও ‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে চান বলে অভিযোগ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি অফিসের কর্মকর্তারা তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে নানাভাবে চাপ দেন। ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে তাদের অসহযোগিতামূলক আচরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়, রেজিস্ট্রার কার্যালয়সহ কয়েকটি জায়গার কর্মকর্তারা ‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে শিক্ষার্থীদের তাগিদ দিয়ে আসছেন। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ না বলে ‘বস’ বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলেন, “পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের এক কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় তিনি আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। পরবর্তীতে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার জন্য পীড়াপীড়ি করেন।”
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের সবাই ‘কর্মচারী’। ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে—‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারী’। অর্থাৎ ‘কর্মকর্তা’ বলে কোনো শব্দও নেই।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে ‘সরকারি কর্মচারী’ বলতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদিযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত কোনো ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। এখানেও ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি নেই।
গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, “সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধনের কোনো রীতি নেই। রুলস অব বিজনেসে দুটোর কোনোটিই নেই।”
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কীভাবে কাজ করতে হবে—সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাগুলো তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতার নির্দেশনা ছিল— ‘যারা সেবা নিতে আসেন তাদের দিকে তাকাও, তারা তোমার বাবার মতো, ভাইয়ের মতো, আত্মীয়ের মতো। সেবা নিতে আসে জনগণ। তাদের টাকায় তোমাদের বেতন হয়।”
কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ ডাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আজীম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, “‘স্যার’ বলার বিষয়টিকে কে কীভাবে নেয়—এটাই হচ্ছে বিষয়। শুধু শিক্ষক হলেই যে তিনি ‘স্যার’ হবেন বিষয়টাকে এভাবে বুঝলে আমি মনে করি এখানে বোঝাপড়ার ঘাটতি আছে। একজন শিক্ষার্থী যখন এখানে পড়াশোনা শেষ করে কোনো অফিসে চাকরি নিতে যাবেন, তখন তিনি কিন্তু সেই অফিসের ক্লার্ককেও ‘স্যার’ বলবেন।”
কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ সম্বোধনের পক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে চাইতেই পারেন। একজন ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পাস বা অনার্স পাস শিক্ষার্থী একজন ডেপুটি বা অ্যাসিসস্ট্যান্ট কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ বলতে সমস্যা কোথায়? এই শিক্ষার্থীরাই তো মাস্টার্স পাস করে তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য হাজারখানেক ইন্টারভিউ দেবে। তাহলে এখানে কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলতে তার ইগোতে লাগবে কেন? তবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কেউ ‘ভাই’ বললে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যেহেতু বিষয়টা নিয়ে কথা উঠেছে তাই এর একটা সমাধান দরকার।”
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সম্মান করেন। তাদের ‘ভাই’ বলে ডাকলেও সেটা মন থেকে ডাকেন। সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকে সচিবের মতো বড় বড় পদে আছেন, তাদেরকেও তো আমরা ‘ভাই’ সম্বোধন করি। এতে তারা বরং বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কর্মকর্তারা এতো সম্মান পাওয়ার পরও যদি শিক্ষকদের পাশাপাশি তাদেরও ‘স্যার’ ডাকার বাসনা লালন করে থাকেন, তাহলে তা হিতে বিপরীত হবে।”
কেউ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে সম্মান দেখানোর খাতিরে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকেও ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন, তাহলে সেটি ওই সম্বোধনকারীর বিনয় বলে উল্লেখ করেন জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আকতারুজ্জামান সোহেল।
তিনি বলেন, “কিন্তু ওই কর্তাব্যক্তি যদি মনে করেন যে, তাকে ‘স্যার’ বলতেই হবে, নাহলে তিনি প্রশ্ন করেন, ক্ষুব্ধ হন, তাহলে সেটি ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মানসিক দৈন্য।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন জাগো নিউজকে বলেন, “সাহেব হওয়া বা স্যার হওয়া ইউরোপীয়দের ক্ষমতা কাঠোমোর একটি ভাষিক প্রকাশ। আমাদের প্রশাসনে এই কাঠামোর কারণেই তারা যে জনগণের সেবক, সেই বোধটি তাদের ভেতরে জাগ্রত হয় না। এখানে ‘স্যার’ সম্বোধনের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় কে ক্ষমতাবান আর কে ক্ষমতাবান নয়। এইটা হচ্ছে উপনিবেশিক হীনমন্যতা।”
‘কিছু কর্মকর্তাদের বেতন স্কেল হয়তো একজন লেকচারের থেকে বেশি। সেই দিক দিয়ে যদি তারা শিক্ষকের সম্মান পেতে চান তাহলে তো বলার কিছু থাকে না। কিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক যে পদমর্যাদা যখন টাকা-পয়সা ও পদবি দিয়ে নির্ধারিত হয়, তখন এটা খুবই অন্তঃসারশূন্য একটা সমাজের বহিঃপ্রকাশ’, যোগ করেন এ অধ্যাপক।
“যে কেউ যে কাউকে ‘স্যার’ বলতেই পারে, এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার” বলে মন্তব্য করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে তো ‘স্যার’ বলতে শিক্ষকদের অথবা অফিসের যে বস তাকে বোঝায়। যেহেতু বিভিন্ন প্রয়োজনে অফিসের কর্মকর্তাদের সম্বোধন করতে হয়, তাই শিক্ষার্থীরাই ঠিক করবে কর্মকর্তাদের কী বলে ভদ্রতার সঙ্গে সম্বোধন করা যায়।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রয়ক অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্বোধন করার বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সম্বোধনের চেয়ে বড় বিষয়টি হলো তারা সঠিক সেবা পাচ্ছে কি না। অনেক সিনিয়র পর্যায়ের অফিসার কর্মরত আছেন যারা হয়তো এক দুই বছর পর অবসরে যাবেন, তাদের সম্বোধনের বিষয়টি শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে করবে বলে আমরা আশা রাখি। তবে কেউ যদি সম্মান চেয়ে নিতে যান সেটা একেবারেই উচিত নয়।’
মাহবুব সরদার/এসআর/এএসএম