ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করবে কাউনের চালের নুডলস
শস্য বৈচিত্রের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য তৈরি করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা বর্তমান পুষ্টিবিজ্ঞানীদের অন্যতম উদ্দেশ্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের চাহিদা এখন ভোক্তাদের কাছে অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের খাদ্য তালিকায় এখন কম কার্বোহাইড্রেট ও বেশি প্রোটিনযুক্ত খাবারই স্থান পায়।
খাদ্য গবেষকদের মতে, কম্পোজিট ফ্লাওয়ারের ব্যবহারটা এক্ষেত্রে একটি দ্রুত সমাধান হতে পারে যা গতানুগতিক খাদ্যের গুণগত মানকে অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম। আর তাই ভোক্তার চাহিদাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি (এফইটি) বিভাগের একটি পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণার মূল বিষয় ছিল- নতুন প্রজাতির কাউনের চাল, গম, রাইস ব্রান ও মাশরুমের সমন্বয়ে তৈরি কম্পোজিট ফ্লাওয়ার দ্বারা পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি নুডুলস উৎপাদন করা। যেখানে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে এনে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলসের পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। যেটি সাধারণ নুডুলসের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর। এই নুডুলস খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অভিসিটি, হাইপার অ্যাক্টিভিটিনসহ ওভারওয়েট নামক ভয়াবহ রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে এই নুডুলস উৎপাদনের ফলে দেশে কাউনের চাল উৎপাদনের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। এতে করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা নতুন করে তাদের জীবনের গতি পাবেন। কারণ অব্যবহৃত জমি ও চর এলাকায় অনাবৃষ্টির কারণে অন্য ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়- এমন জমিতে স্বল্প খরচে এই ধান উৎপদান সম্ভব।
এই গবেষণার গবেষক ছিলেন এফইটি বিভাগের পিএচডি ফেলো মোছা. মেহেরুন্নাহার। তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক। এছাড়া সহ-তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ইনস্টিটিউট অব ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (আইএফএসটি) সিএসও ড. মো. আব্দুস সাত্তার মিয়া।
মূল গবেষণাটি সম্পন্ন হয় আইএফএসটির ল্যাবরেটরিতে। গবেষণায় কাউনের চালকে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি গম, রাইস ব্রান ও মাশরুমও ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেকটি কাঁচামালের তিন ধরনের জাত নিয়ে তাদের ভৌত রাসায়নিক, মিনারেলস এবং ফাংশনাল প্রোপার্টিস এনালাইসিসের মাধ্যমে কাঁচামালগুলোর গুণগত মান নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো জাতের কাঁচামালটি নুডুলস উৎপাদনের জন্য বাছাই করা হয়।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ওজন নিয়ন্ত্রণে কাউনের চাল অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। এটি গ্লুটেন ও সুগার ফ্রি। প্রতি ১০০ গ্রাম কাউনের চালে প্রায় ১০-১২% প্রোটিন, ৬৫-৭০% কার্বোহাইড্রেট, ৫-৭% ফাইবার, ২-৩% ফ্যাট, ৩৮০-৩৯০ কিলোক্যালরি এনার্জি, ৩০-৩২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭-৮ মিলিগ্রাম আয়রন, ৩৫০-৪০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, প্রায় ৬০০-৭০০ মিলিগ্রাম ফসফরাসসহ অন্যান্য খনিজ লবণ ও ভিটামিন বিদ্যমান।
গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধাণের বিষয়ে মোছা. মেহেরুন্নাহার জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে নুডুলস উৎপাদন হয়। বর্তমানে ইনস্ট্যান্ট নুডুলস এখন পুরো বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং এর উৎপাদন দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ এটি অল্প সময়ে, কম খরচে এবং দ্রুত প্রস্তুত করা যায়। আমাদের দেশে সাধারণত গম, চাল, আলু, মিষ্টি আলুকেই নুডুলস উৎপাদনের প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই উপাদানগুলোতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে। যার ফলে এগুলো শরীরে ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসহ নানারকম জটিল রোগের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এজন্য এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সময়ের চাহিদায় শস্য বৈচিত্র আনা এবং অল্প খরচে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের কাঁচামাল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এই গবেষণা।
তিনি বলেন, কাউনের চালে গ্লুটেন ফ্রি এবং ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। যেটি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কারণ ফাইবার বেশি থাকার কারণে এটি পাকস্থলী পরিষ্কার এবং কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সক্ষম। পর্যাপ্ত পরিমাণ মিনারেলস থাকায় শরীরে লবণের ঘাটতি পূরণ করে বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের। এছাড়া ভিটামিন এবং খনিজ লবণ থাকায় এটি পরিপাকে দীর্ঘ সময় লাগে, শরীরে এনার্জি সরবরাহ করে থাকে। শুধু তাই নয়, মেডিকেল সায়েন্সের পরিভাষায় গ্লুটেন জাতীয় খাবার অনেক শিশুদের হাইপার অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে তোলে। তাই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা গ্লুটেন (আটা, ময়দা) জাতীয় খাবারের পরিবর্তে কাউনের চালের তৈরি খাবারকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যের এই দারুণ উপকারিতায় এবং ডায়েটে অসাধারণ ভূমিকা রাখার কারণে একে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বর্তমানে ‘সুপার ফুড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অন্যদিকে কাউনের চাল জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম একটি শস্য। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তাই দেশে খাদ্য নিরাপত্তা এখন হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বিভিন্ন অভিযোজনের কৌশল সম্পর্কে জানা জরুরি। কাউনের চাল জলবায়ু অভিযোজনসম্পন্ন একটি শস্য।
গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক এফইটি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অসামঞ্জস্যতায় দেশের কৃষিতে বড় ধরনের সমস্যা হতে চলেছে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শস্য বৈচিত্র আনা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি দিনে দিনে ডায়াবেটিস, হাইপার অ্যাক্টিভিটিসহ ওভারওয়েট রোগের প্রবণতাও বাড়ছে। এজন্য রোগ নিয়ন্ত্রণ ও একইসঙ্গে জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম শস্য উৎপাদন এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই এ ধরনের শস্য নিয়ে আরও অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে এবং এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকায় শরীরে ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসহ নানারকম জটিল রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। এছাড়া জলবায়ু অভিযোজনে সক্ষম শস্য উৎপাদন এবং এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম থাকে- এমন শস্য উৎপাদন নিয়ে গবেষণা নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণায় প্রতিনিয়ত ভালো করছে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়া। এজন্য গবেষকদের সব সময় আমরা উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে থাকি। এ বছর গবেষণায় বরাদ্দ ৭ গুণ বাড়িয়েছি। সামনে আরও বাড়বে। গবেষণায় অবকাঠামো উন্নয়নসহ যা যা দরকার তা আমরা করে যাচ্ছি।
মোয়াজ্জেম আফরান/এফএ/জেআইএম