ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ক্যাম্পাস

‘আবরার মারা গেছে, আমরা নির্যাতন সয়ে বেঁচে আছি’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৫:৩৬ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০১৯

‘আমাদের জীবন-মরণ ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। তারা যা চায় তা-ই আমাদের করতে হবে। তারা চাইলে যেকোনো সময় আমাদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারে। তাদের কথার বাইরে চলার কোনো সুযোগ নেই আমাদের।’

এভাবেই ছাত্রলীগের র‌্যাগিং ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ড. এম এ রশীদ হলের ১৫তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী।

ড. এম এ রশীদ হলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই ছাত্র বলেন, ‘আবরার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে। কিন্তু আমরা এই নির্যাতন সয়ে বেঁচে আছি। আবরারের হত্যার পর তার খুনিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে কিন্তু আমাদেরকে নিয়মিত যারা নির্যাতন করে, আহত করে তাদের কোনো বিচার হয় না। তারা নেতার বেশে দাঁপিয়ে ঘুরে বেড়ান।’

তিনি বলেন, ‘বুয়েটের এই হলে ছাত্রলীগের নির্যাতন অনেক দিনের। সাড়ে তিন বছরে আমি হলে থেকে বিভিন্ন নির্যাতন সহ্য করেছি। নির্যাতন সহ্য করার পর আমি হলও ছাড়তে পারি না। হলে উঠে যদি আবার হলে থেকে নেমে যাই, তাহলে ছাত্রলীগ আমাদের ক্যাম্পাসে আসতে না দেয়ার হুমকি দেয়। অনেক নির্যাতন দেখেছি। এর মধ্যে আমার বন্ধু নাসিমের নির্যাতনের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক।’

নাসিম তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ছাত্রলীগের ঘটনা নিয়ে বুয়েটের একটি ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন-

‘গত বছরের ২৩ নভেম্বর ২০১৮, রাত ১১টা। পরেরদিন দিন অপারেটিং সিস্টেম অনলাইন (প্রেজেন্টেশন পরীক্ষা) থাকায় আমি আর আমার রুমমেট হাসিব পড়তেছিলাম। হঠাৎ ১০-১২ জন আমার রুমে ঢোকে। তাদের মধ্যে ১৪তম ব্যাচের ৫-৬ জন ,১৫-এর ৩-৪ জন বাকিরা ১৬, ১৭ এর ছিল। ১৪-এর মিনহাজ ভাই আমাদের জিজ্ঞেস করে, তোরা কে কে হল ফেস্টের টাকা দিস নাই। আমাদের রুমের কেইউ টাকা দিই নাই। আমি বললাম, ভাই, আমি হল প্রোগ্রামে থাকব না তাই টাকা দিব না। ১৪-এর বাধন ভাই বলল, হল ফেস্টে থাকিস বা না থাকিস টাকা দিতে হবে। ভাই, আমি হল ফেস্টে থাকব না, তো কেন টাকা দিব?’

‘মিনহাজ : বেয়াদব, তুই কীভাবে আমাদের মুখের ওপর এইভাবে না করতে পারিস। রুমে বড় ভাই ঢুকা সত্যেও তুই কীভাবে পড়তেছিস? (আমার ল্যাপটপ কোড রান করার জন্য ওপেন ছিল)। তুই কীভাবে এই হলে থাকিস আমি দেখে নিব। ফাহিম ওর সব কিছু নামা রুম থেকে।’

‘ফাহিম, ফাহিম বলে চিল্লাইয়া রুম থেকে চলে গেছে। ১৪-এর সবাই আমার ওপর চিল্লাচ্ছিল তখন কীভাবে আমি এইভাবে না করতে পারলাম। চিল্লানোর সাথে সাথে এত অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতেছিল যে এই ধরনের গালি আমি জীবনে মুখেও আনতে পারব না। কিছুক্ষণ পর মেহেদি আর কায়েদ আমার রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী বলছিলাম আমি। আমি বললাম যে, ভাই, আমি হল কনসার্টে থাকব না, তাই টাকা দিব না। মেহেদি বলল, তোর এইভাবে বলা উচিত হয়নি।’

তুই থাকলে কীভাবে বলতি? সে কিছু বলল না। ১৫-এর সবাই তখন আমার সাথে একমত হয় যে ১৪ এর চিল্লাচিল্লি এখানে লজিক্যাল ছিল না। অনেকেই ওই দিন টাকা দেয়নি দেখে হয়তো তারা বেশি টেম্পার দেখাচ্ছে। সব কিছু ভুলে গিয়ে আমি পরের দিনের জন্য পড়াশোনা করতেছিলাম।

রাত তখন ১২:৩০টা। মেহেদি আর নিহাদ আমার রুমে এসে আমাকে রশীদ হল ৪০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। ওইদিন ফ্যাকাল্টি ফুটবল থাকায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই তারা আমাকে একরকম কাঁধে করে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে আমি জিজ্ঞেস করি, ভাইদের কি হইছে? আমি কি এমন কিছু বলে ফেলছি?

-আমরা জানি না রে ভাই, ওনারা কেন এ রকম পিনিক দেখাচ্ছে। ভাই চল, ওনারা চিল্লাফাল্লা করবে পরে অনেক।

আমি ভাবলাম হয়তো ধমক টমক দিবে হয়তো, বড়জোর দুই একটা চড়থাপ্পড় দিবে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই।

৪০৫ নম্বর রুমে প্রবেশ করলাম। রুমে ছিল ৬ জন। সবাই ১৪ ব্যাচের। মিনহাজ মেকানিক্যাল ১৪, অয়ন সিভিল ১৪, ঝলক সিভিল ১৪, বাধন সিভিল ১৪, সৌরভ সিভিল ১৪, আর ফাহিম মেকানিক্যাল ১৪। মিনহাজ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই আমাকে কী বলছিলি?’ এই বলে এত জোরে থাপ্পড় মারে যে কেউ কখনো এত জোড়ে আমাকে মারে নাই।

মিনহাজ ভাই আমাকে তার হাতে হয়রান হওয়ার আগ পর্যন্ত মারে। তারপর সে একটা স্টাম্প নেয়। তার গায়ে যত শক্তি আছে সেই শক্তি দিয়ে ১৫-২০টা বাড়ি দেয় আমার বাম হাতে। স্টাম্প ভাঙার আগ পর্যন্ত মারতে থাকে। এই বুঝি আমার বাম হাত যেন ভেঙে গেল। কান্না করার স্বভাব তেমন একটা ছিল না আমার। যেহেতু আমি কাঁদতেছিলাম না, সেই কারণে তারা আরও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে।

-‘তুই কিভাবে আমার সাথে এইভাবে কথা বলেছিস। এখন পর্যন্ত কোনো সিনিয়র আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে নাই। আর তুই আমার সাথে এইভাবে কথা বলছ।’ এই বলে আবার আমার মুখের ওপর চড় মারে। যখন শুনতে পাই যে, আমার পায়ে সমস্যা আছে তখন তারা আমার বাঁ পায়ে আঘাত করে। আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে লাথি মারে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেও তারা আমার পায়ের ওপর লাথি মারতে থাকে।

নতুন স্টাম্প নিয়ে আবার মারতে থাকে। যখনই আমার পায়ে কেউ মারতেছিল, ব্যথাটা এতই বেশি ছিল যে নিজের কাছে মনে হলো-এই বুঝি আমি মারা যাচ্ছি। ব্যথায় আমি চিল্লাচ্ছিলাম। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতেছিল। কান্না করে বলতেছিলাম, ‘ভাই আমাকে ছেড়ে দেন। ভাই, আমাকে ছেড়ে দেন। ভাই, আপনাদের কাছে হাত জোর করি, ভাই, আমাকে ছেড়ে দেন।’

সৌরভ ভাই বলে উঠল-আজ পর্যন্ত কোনো জুনিয়রকে মারতে দেখছিস? তবুও কেমনে তুই আমাদের সাথে বেয়াদবি করছ? তর কি বড় ভাই নাই। বড় ভাই থাকলে এ রকম করতি না। সৌরভ ভাই আরও অনেক আজেবাজে বকছে যে, শুনলে যেকোনো মানুষের মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। বাধন ভাই আমাকে থাপ্পড় মেরে একই রকম কথা বলে মজা নেয়। ঝলক ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করছিল যে, তুই কী বলছিলি? যখনই আমি উত্তর দিতে যাই তখন আমার মুখের ওপর থাপ্পড় মেরে আমাকে মেঝেতে ফেলে দিত। মেঝেতে ফেলে আবার মারত। মুখ থেকে বের হওয়া রক্ত যখন ওর হাতে লাগে তা আমার টি-শার্টে মুছতেছিল। মিনহাজ ভাই একটু পর পর সবাইকে বলতেছিল, কেন তারা আমাকে মারতেছে না। মিনহাজ ভাই আমাকে মারতেছিল আর যখন টায়ার্ড হয়ে যায় তখন উঠে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেট খেতে খেতে বলছিল, ‘ওই তোরা ওরে মারছ না কেন? ওই তোরা ওরে মারছ না কেন? আমার তো তারে খুন করতে ইচ্ছে করতেছে। এই কথা বলেই আমার মুখের ওপর লাথি মারছিল।

যখন ওর লাথির কারণে আমি মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম আর আমার পা বের হয়ে যাচ্ছিল তখন আমার পায়ে লাথি মারছিল। পায়ে যখন মারছিল তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি মারা যাচ্ছি। ভাঙা পায়ে মার মানেই কলিজা যেন ফেটে যাচ্ছিল।

একটু পর অয়ন ভাই রুমে ঢুকে। ‘কিভাবে তুই আমাদের সাথে বেয়াদবি করিস। তোকে শিক্ষা দেয়া লাগবে।’এই বলে অয়ন ভাই আমার মুখে লাথি-ঘুষি মারতেছিল। আমার দুই পা উঁচু করে স্টাম্প দিয়ে মারতে থাকে। পায়ের তালুতে কিংবা হাঁটুতে। অন্যরা যখন মারতেছিল আমাকে তখন সে বলতেছিল, ‘পায়ের তালুতে মার। অন্য জায়গায় মারলে দাগ থাকবে। এখানে মারলে দাগ থাকবে না।’ মিনহজ ভাই আর অয়ন ভাই পালাক্রমে মারতে থাকে। কখনো হাতে কখনো বা স্টাম্প দিয়ে।

একজন টায়ার্ড হলে অন্যজন আসে। আমি ব্যথায় চিৎকার করতেছিলাম। সবার পায়ে ধরতেছিলাম। কিন্তু ওই রুমের কেউ আসেনি আমাকে মার থেকে বাঁচানোর জন্য।
মিনহাজ ভাই জিজ্ঞেস করল, ‘ওই তোর ফোন দে?’।

-‘ভাই, আমি ফোন আনিনি’।
-ফোন আনিস নাই কেন? এই বলে আবার আমার মুখে লাথি মারে। রক্ত বের হয়ে ফ্লোরে পড়ে। মেহেদিকে দিয়ে আমার রুম থেকে ফোন আর ল্যাপটপ আনানো হয়। ওরা আমার ফেসবুক প্রোফাইল চেক করে। কিছু না পেয়ে তারা আমার মেসেঞ্জার চেক করে। মেসেঞ্জারেও যখন কিছু পাচ্ছিল না তখন দেখে যে, আমার সাথে কয়েকজন মেয়ের চ্যাট আছে (যারা হয় আমার ব্যাচম্যাট না হয় সিনিয়র আপু, যাদের সাথে প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনে কথা হতো)।

ফাহিম ভাই আমার চ্যাট পড়তেছিল আর তা ব্যঙ্গ করে সবার সামনে তা উচ্চারণ করে হাসাহাসি করতেছিল। একটু পর বলে যে, এই এই পোলা তো আওয়ামী লীগের পোস্টে হা হা দেয়। মিনহাজ ভাই বলে, ‘কত্ত বড় সাহস! তুই আওয়ামী লীগের পোস্টে হা হা দেছ। শিবির তুই?’

-ভাই, আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার চাচা একজন শহীদ। এরপর তারা একটু থামে। শেষ পর্যায়ে যখন তিনটা স্টাম্প ভেঙে যায় তখন বাহির থেকে হকিস্টিক আনে। আমি সবার পায়ে ধরে মাফ চাচ্ছিলাম। ওরা বলতেছিল, ‘তুই, আজকেই হল ছেড়ে চলে যাবি।’

আমি রাজি হয়ে যাই। ‘জি, ভাই, আজই চলে যাব। আর আসব না এই হলে।’ ওদের মনে দয়া হলো। আমাকে ছেড়ে দেয়। যখন মেহেদি আর নিহাদ আমাকে নিতে আসে। আমি রুম থেকে বের হই। রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে ৪০৬ নম্বর রুমের ফাহিম আমাকে নিয়ে তার রুমে নিয়ে বসায়। কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে আমাকে ডিএমসিতে নিয়ে যায়। ওখানে এক্সরে আর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর বলল যে, একজন অর্থোপেডিক্স ডাক্তার দেখানোর জন্য।

ডাক্তার বলে যে, আমার লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে আর পায়ে ফ্রেকচার দেখা গেছে। এক মাস হাঁটতে পারব না আর ছয়মাসের মতো ভারী কোনো কাজ করতে পারব না।

এ বিষয়ে কথা হলে ড. এম এ রশীদ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো ইলিয়াস বলেন, ‘আমরা চাই না এমন কিছু ঘটুক। আমরা আগে এ রকম ঘটনার তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করেছি। এখন কোনো ধরনের ঘটনার খবর পেলে আমরা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেব।’

আল-সাদী ভূঁইয়া/এসআর/পিআর