গবেষণায় নেই রাবির ৮ শতাধিক শিক্ষক!
২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২৪ শতাংশ শিক্ষকের গবেষণা প্রবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ৭৬ শতাংশ শিক্ষকের এই শিক্ষাবছরে কোনো গবেষণা প্রবন্ধ বা গ্রন্থ নেই। এক বছরে একটিও গবেষণা প্রবন্ধ নেই এমন বিভাগ আছে ১০টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নতুন বিভাগগুলোতে গবেষণা প্রায় শুন্যের কোটায়। ব্যবসায় শিক্ষা, আইন অনুষদের গবেষণা সংকট, পুরাতন বিভাগেও শিক্ষকদের গবেষণা ঘাটতি, প্রবীণ শিক্ষকদের খুব কম সংখ্যক গবেষণায় নিয়মিত।
বার্ষিক প্রতিবেদন (২০১৭-১৮) এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ১১৭০ জন। গ্রন্থ ও গবেষণা প্রবন্ধ আছে মোট ২৮৪ শিক্ষকের। বাকি ৮৮৬ শিক্ষকের গবেষণা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদন বলছে, কলা অনুষদভুক্ত ১২টি বিভাগের মোট ২৫৪ শিক্ষকের মাত্র ৪৯ জন, আইন অনুষদের দুটি বিভাগের মোট ২৫ শিক্ষকের মাত্র একজন, বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত আট বিভাগের মোট ২৩১ শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১০০ জন শিক্ষকের গবেষণা আছে।
এদিকে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ১০০ শিক্ষকের মধ্যে মাত্র চারজন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ১৭২ শিক্ষকের মাত্র ২৮ জন, জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ১৪৮ শিক্ষকের মাত্র ৫৭ জন, কৃষি অনুষদের ৮৪ শিক্ষকের মাত্র ১৪ জন, প্রকৌশল অনুষদের ১১৯ শিক্ষকের মাত্র ৩০ জনের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। চারুকলা অনুষদের তিনটি বিভাগে মোট ৩৬ শিক্ষকের মাত্র একজনের গবেষণা আছে।
গবেষণা হয়নি ১০ বিভাগে
কোনো শিক্ষকের গবেষণা নেই এমন বিভাগও আছে ১০টি। অধিকতর নতুন বিভাগগুলোর পাশাপাশি অনেক পুরাতন বিভাগও আছে এই তালিকায়।
বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী গবেষণা না থাকা বিভাগগুলো হলো- সঙ্গীত বিভাগ, আইন ও ভূমি প্রশাসন, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, ফিশারিজ ও চারুকলা অনুষদভুক্ত মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য, গ্রাফিক্স ডিজাইন-কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ।
তবে ফিশারিজ বিভাগসহ পুরো কৃষি অনুষদে গবেষণা বেড়েছে বলে দাবি করেন অনুষদটির ডিন ড. সালেহা জেসমিন। তার দাবি- শিক্ষকদের গবেষণা থাকলেও সেগুলো বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
অধ্যাপক জেসমিন বলেন, গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ যেমন বেড়েছে সেই সঙ্গে গবেষণা প্রকল্প বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভাগের অধ্যাপক ইয়ামিনের বেশকিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে।
চারুকলা অনুষদের গবেষণা ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে অনুষদটির ডিন অধ্যাপক সিদ্ধার্থ শঙ্কর তালুকদার বলছেন, এই অনুষদের শিক্ষকদের গবেষণা দুই ধরণের। যার মধ্যে হাতেকলমে কাজ বেশি। তবে প্রকাশনা থাকবে না এইটা দুঃখজনক। শিক্ষকদের বড় এই ঘাটতির কারণ অনুসন্ধান জরুরি বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে অনেকে শিক্ষকের গবেষণা থাকলেও বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ হয় না বলে জানান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব।
তিনি বলেন, পুরো বাংলাদেশ জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক প্রতিবেদনকে যতখানি গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত আমাদের শিক্ষকরা সেভাবে নিচ্ছেন না। বার্ষিক প্রতিবেদনের জন্য যখন তথ্য চাওয়া হচ্ছে তখন অনেকেই গবেষণা থাকলেও তথ্য জমা দেন না। এতে অনেকে গবেষণা করলেও প্রতিবেদনে আসেনি।
তবে শতকরা ৭৫ ভাগ শিক্ষক নয়, যদি ৬০ শতাংশ শিক্ষকও গবেষণার বাইরে থাকেন তাহলে তা একটি অশনি সংকেত। তার মানে এই যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে চলার কথা ছিল সেভাবে চলছে না। আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চলছে না। ১০ শতাংশ শিক্ষকও যদি সারাবছরে গবেষণা কার্যক্রমের সঙ্গে না থাকেন সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়।
গবেষণা সংকট সত্যিই আছে বলে জানিয়ে এই অবস্থার জন্য মৌলিক শিক্ষার ঘাটতি, যেন তেন গবেষণা দিয়ে পদন্নোতি, শিক্ষক নিয়োগে প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন না করাকে দায়ী করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুন কুমার বসাক।
তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর বর্তমান শিক্ষকদের গবেষণা সংকটের প্রভাব এতে খুব বাজেভাবেই পড়বে। গবেষণার সত্যিকার মানদণ্ড না থাকার কারণে পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাও আজকে পদোন্নতির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। গবেষণা না করেই যদি পদোন্নতি পাওয়া যায় তাহলে গবেষণা হবে কীভাবে? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
পঞ্চাশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় গবেষণা উন্নয়ন উপেক্ষিত
শিক্ষকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ বছর মেয়াদি যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সেটি আসলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা। এটি গবেষণা বা পঠনপাঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে সরাসারি গবেষণায় বরাদ্দ বা শিক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য যে সমস্ত উপকরণ দরকার সেগুলো এই পরিকল্পনা থেকে অনেকটা বাইরে আছে। শিক্ষকদের গবেষণা দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যদি বরাদ্দ থাকত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপরি উন্নয়ন হতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, গবেষণা করেন না এমন শিক্ষকের সংখ্যা এতো বেশি হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক গবেষণা করেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান অনুষদগুলোতে গবেষণা করেন না এমন শিক্ষক খুবই কম আছেন বলে দাবি করেন তিনি।
আরএআর/এমকেএইচ