দেশে প্রথমবারের মতো ইঁদুরে ক্ষতিকর গনজাইলোনেমা শনাক্ত
দেশে প্রথমবারের মতো ইঁদুরের মধ্যে মানুষের অন্তঃপরজীবী (কৃমি) গনজাইলোনেমা শনাক্ত করতে সফল হয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের একদল গবেষক। এ কৃমি মানুষের জন্য ক্ষতিকর এবং নানা রোগের কারণ। গবেষকদের দাবি, বাংলাদেশে তারাই এটা সর্বপ্রথম শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. উদয় কুমার মহন্তর নেতৃত্বে একদল তরুণ গবেষক ২০১৭ সালের মে মাস থেকে এই গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন।
গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এস এম আব্দুল্লাহ এবং মাস্টাসের্র শিক্ষার্থী অমৃত বর্মন। সাউরেসের এক প্রকল্পের মাধ্যমে তারা এ গবেষণা কার্যক্রম চালান।
গবেষক দল জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন ঘনবসতি এলাকার (তেজগাঁও, আগারগাঁও, তালতলা, মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজার, শেরেবাংলা নগর) বস্তি, মুদির দোকান, শাক-সবজির দোকান, বাসাবাড়ি থেকে ইঁদুর (মিউরাইন রোডেন্ট) সংগ্রহ করেন। এসব ইঁদুর মানুষে রোগ সৃষ্টি করে এমন কৃমি বহন করে।
এই কাজের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইঁদুরের মাধ্যমে যেসব অন্তঃপরজীবী (কৃমি) মানুষে রোগ ছড়ায় সেগুলোকে অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে শনাক্ত করা এবং তাদের বিস্তার নির্ণয় করা।
গবেষকরা আরও জানান, এ কাজের জন্য তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন ঘনবসতি এলাকা থেকে ৭০টি ইঁদুর সংগ্রহ করেন যার মধ্যে ২০টি ধাড়ি ইঁদুর, ১৫টি কালো ইঁদুর, ২৫টি বাদামি ইঁদুর এবং ১০টি নেংটি ইঁদুর ছিল।
গবেষণায় দেখা দেখে, ৭০টি ইঁদুরের মধ্যে ৫০টি (৭১.৪২%) ইঁদুর বিভিন্ন অন্তঃপরজীবী (কৃমি) দ্বারা আক্রান্ত। বিভিন্ন ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকা থেকে (৮৫%) সবচেয়ে বেশি অন্তঃপরজীবী (কৃমি) দ্বারা আক্রান্ত ইঁদুর পাওয়া গেছে। তারপর মুদির দোকান (৭৫%), বাসাবাড়ি (৬৬.৬৬%) এবং ধানখেত (৫৩.৩৩%)। সংগৃহীত কৃমিগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশই মানুষকে সংক্রমণ করতে সক্ষম।
ঘনবসতি এলাকায় যে ধরনের ইঁদুর থাকে তাদের মধ্য ৫ ধরনের কৃমি অধিক হারে পাওয়া যায়। এসব কৃমিগুলো হলো Heterakis spumosa (৬০%), Hymenolepis diminuta (৪৭.১৪%), Moniliformis moniliformis (৪২.৮৫%), Taenia taeniformis (৩৫%), Gongylonema neoplasticum (৩৫%)। গবেষকদের দাবি, এসব কৃমির মধ্যে সর্বপ্রথম তারা বাংলাদেশে গনজাইলোনেমা কৃমি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
গবেষকদলের একজন অমৃত বর্মন। তিনি উল্লেখ করেন, গনজাইলোনেমাসহ এসব কৃমির মাধ্যমে মানুষও সংক্রমিত হতে পারে। আক্রান্ত ইঁদুরের পায়খানার মাধ্যমে কৃমিগুলোর ডিম পরিবেশে আসে। এই ডিমগুলো যখন পাখাবিহীন মাছিজাতীয় কীট (ফ্লি), গুবরে পোকা, আরশোলা ইত্যাদি ভক্ষণ করে তখন এদের দেহে মানুষে আক্রমণ করতে সক্ষম কৃমির লার্ভা তৈরি হয়।
মানুষ খাবারের সঙ্গে বা অন্য যেকোনো উপায়ে আক্রান্ত ফ্লি, গুবরে পোকা, আরশোলা ইত্যাদি খেয়ে ফেললে এসব কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। গনজাইলোনেমা নিওপ্লাস্টিকাম দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষের লালাক্ষরণ, দাঁতের ব্যথা, অন্ননালী প্রদাহ, গলবিল প্রদাহ, গ্যাস্ট্রিক আলসার, স্নায়ুবিক বিকলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
গবেষণা সূত্রে জানা যায়, গনজাইলোনেমা ছাড়াও মানুষের মধ্যে হাইমেনোলেপিস ডিমিনুটা পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদির কারণ হয়ে থাকে। টেইনিয়া টেইনিফরমিস দ্বারা আক্রান্ত হলে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, স্ট্রোক, স্থায়ী ব্রেন ডেমেজ, অন্ধত্ব, মাংসপেশিতে ব্যথা, আচরণগত অসংগতি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। মনিলিফরমিস মনিলিফরমিস ক্ষুধামন্দা, বমি, গন্ধযুক্ত ডায়রিয়া, কফ ইত্যাদির কারণ হয়ে থাকে।
ইঁদুরবাহিত কৃমি দ্বারা সৃষ্ট ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধে সাধারণ জনগণকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড প্যারাসাইটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. উদয় কুমার মহন্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করতে স্যানিটেশন অবস্থার উন্নতি এবং সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা উচিত। সেই সঙ্গে ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত রোগ সংক্রমণ-সম্পর্কিত সচেনতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি খাদ্যদ্রব্য ঢেকে ও সবসময় ইঁদুর থেকে দূরে রাখতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে অতিদ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।’
ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের মধ্যে দুটি সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) কর্তৃপক্ষ জনসচেতনতা বাড়াতে যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে আমরা তাদেরকে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’
ড. উদয় কুমার মহন্ত জানান, আমরা এ গবেষণাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দরকার। এটা পেলে আমরা সাবলীলভাবে কাজ করতে পারব।
মো. রাকিব খান/এসআর/এমএস