এবার ব্ল্যাক বেঙ্গলের জীবনরহস্য উন্মোচন
পাট, মহিষ ও ইলিশের পর প্রথমবারের মতো পৃথিবীর অন্যতম সেরা জাতের ছাগল ‘ব্ল্যাক বেঙ্গলের’ জীবনরহস্য উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) একদল গবেষক ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের এ জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গলের’ জীবনরহস্য উন্মোচনের (জিনোম সিকোয়েন্সিং) কথা জানান বাকৃবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জসিমউদ্দিন খান।
প্রধান গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপ্রজনন ও কৌলি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকারের নেতৃত্বে গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হলেন- পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্ল্যা, পশুপ্রজনন ও কৌলি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম ভূঞা, বিএলআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল জলিল, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. গৌতম কুমার দেব, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. পণির চৌধুরী ও নূরে হাছনি দিশা।
জিনোম হলো- কোনো প্রজাতি বা জীবের মোট নিউক্লিওটাইডের সমষ্টি। সহজ কথায় জিনোম হলো- কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের অঙ্গ-সংস্থান, জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় এর জিনোমে সংরক্ষিত নির্দেশনা মতে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হলো- কোনো জীবের জিনোমে সমস্ত নিউক্লিওটাইড সমূহ কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে তা নিরূপণ করা। একটি জীবের জিনোমে সর্বমোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যায়।
বাংলাদেশে মোট ছাগলের ৯০ ভাগই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। এই জাতের ছাগল প্রতি প্রসবে একাধিক বাচ্চা দেয়, দ্রুত প্রজননশীল, চামড়া উন্নত মানের এবং উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া উপযোগী। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস স্বাদে, গন্ধে ও রসালতায় অনন্য। বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ছাগলের মাংস ওতপ্রোতভাবে আদিকাল থেকে জড়িত। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে গ্রামীণ দুস্থ নারী, ভূমিহীন পরিবারের জীবন ও জীবিকায় ছাগল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১, ২৭, ০০০ মেট্রিক টন ছাগলের মাংস উৎপাদিত হয় যা মোট উৎপাদিত গবাদি পশুর মাংসের প্রায় ২৫ ভাগ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিনোমে প্রায় ২.৯ গিগাবেজ নিউক্লিওটাইড পেয়েছেন গবেষকরা। যার মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম সাইজ ১৬, ৬৪০টি নিউক্লিউটাইড, যাতে ৩৭টি জিন রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্স এনালাইসিস করে ২৬ লাখ, ৫ হাজার ৩০০টি সিঙ্গেল নিউক্লিউটাইড পলিমরফিজম (এসএনপি) পাওয়া গেছে। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল জিনোমে জিনের সংখ্যা ও গঠন জানার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
প্রধান গবেষক ড. এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার বলেন, বাংলাদেশে আমরাই প্রথম ব্ল্যাক বেঙ্গলের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করেছি। এর মাধ্যমে এখন ব্ল্যাক বেঙ্গলের খাদ্যাভাস, শারীরিক গঠন, চামড়া ও প্রজননসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হলো। ভবিষ্যতে কেউ গবেষণা করতে চাইলে এই জিনোম সিকোয়েন্সিং অনেক কাজে লাগবে।
গবেষক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্ল্যা বলেন, বাংলাদেশি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের একটি পূর্ণাঙ্গ জিনোম রেফারেন্স তৈরি করেছি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের একটি পূর্ণাঙ্গ রেফারেন্স জিনোম তৈরি হলো। এতে ডিএনএ আবিষ্কার ও মার্কারগুলোর মাধ্যমে ছাগলের ওজন বৃদ্ধির হার, দুধ উৎপাদন, বাচ্চা উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ও মাংসের গঠন সংক্রান্ত জিন আবিষ্কার করা সহজ হবে। ফলে সহজেই ছাগলের মোট জিনের সংখ্যা, গঠন ও কার্যাবলী নিরুপণ করা যাবে।
এর আগে ২০১৬ সালে জাতিসংঘের কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) ও আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা সংস্থা থেকে বিশ্বের ১০০টি ছাগলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি গবেষণা করে। তাতে বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গলকে বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মো. শাহীন সরদার/এএম/এমএস