‘কেউ হয়তো আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) অবস্থিত গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনিস্টটিউটের (জিটিআই) পরিচালক প্রফেসর এ.কে.এম. রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনিয়ম, দুর্নীতি, ট্রেনিংয়ের অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে গাছ কর্তন করে নিজের ফার্নিচার, চাকরির প্রভোলন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, চাকরিতে স্বজনপ্রীতি, সহকর্মী ও কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ট্রেনিংয়ের গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জিটিআইয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে থাকে।
এ.কে.এম. রফিকুল ইসলাম ছাত্রাবস্থায় ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী এবং চাকরি জীবনের শুরুতে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্ষমতার পালা বদলে খোলস বদলিয়ে যোগ দেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামে। জিটিআইয়ের পরিচালক হওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকের সহায়তায় নানা ধরনের অপকর্ম করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, পরিচালকের দ্বায়িত্ব নেয়ার পর তিনি রাজনীতিক প্রভাব খাটিয়ে দুইজন আত্মীয়সহ মোট ৫ জনকে মাস্টারোলে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে প্রথম জিটিআইয়ের একজন শিক্ষক নির্ধারিত থাকলেও পরবর্তীতে রাজনীতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি আরও তিনজন শিক্ষক নিয়োগের জন্য নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
অধ্যাপক এ.কে.এম. রফিকুল ইসলাম ২০১৬ সালের ২৫ মে পরিচালকের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমতে শুরু করে। একসময় চুপচাপ থাকলেও দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জিটিআইকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই ডরমেটরির ৮টি গাছ কেটে আসবাবপত্র বানিয়েছেন। ইনস্টিটিউটের গাড়ি ও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জিটিআইয়ের গাড়িতে করে তার স্ত্রী কর্মস্থল টাঙ্গাইলে যাতায়াত করেন। বেতনের পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাসের জন্য আলাদা অর্থ দেয়া হয়। কোর্স পরিচালক নামে আলাদা পদ সৃষ্টি করে প্রতিটি প্রশিক্ষণ থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নেন তিনি।
এছাড়াও অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া, অন্য শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সবগুলো ক্লাস নিজেই নিয়ে সম্মানির টাকা উঠিয়ে নেন তিনি। পছন্দের শিক্ষককে এবং অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কোর্স সমন্বয়ক বানিয়ে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আগের পরিচালকদের সময়ও এমনটি ছিল। সহকর্মীদের সিদ্ধান্ত নিয়েই ওসব করা হয়েছে।
অবসরে যাওয়া জিটিআইয়ের দুই বার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক তাজুল ইসলাম বলেন, প্রশিক্ষণে কোর্স ডাইরেক্টর রাখা কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষককে কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেয়ার কোনো নিয়ম জিটিআইয়ে নেই। আমার সময়ে ওরকম কিছুই ছিল না।
রফিকুলের সময়ে মোট ৬২টি ট্রেনিং সম্পন্ন হয়েছে যার মধ্যে বেশি সংখ্যক কোর্সের কোর্স-সমন্বয়ক হিসেবে পরিচালক নিজেই এবং পছন্দের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও প্রতিটি প্রশিক্ষক কোর্সে প্রত্যকটি কর্মচারীর জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ থাকে। তিনি কর্মচারীদের বঞ্চিত করে ওই টাকা নিজের পকেটে নেন। পরিচালকের ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস করেনি।
কর্মচারীদের অভিযোগ, এই পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মোট ৬২টি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। চাকরির সময়সূচির বাইরে এমনকি ছুটির দিনেও কাজ করতে হয় আমাদের। অতিরিক্ত কাজ করায় আগের পরিচালকেরা একটা সম্মানী দিতেন। এখন অনেক সময় দেন না, দিলেও সেটাকে সম্মানী বলা যায় না। এ ছাড়া সম্প্রতি জিটিআইয়ের ডরমিটরিতে ৪০টি নিম্নমানের খাট ক্রয় ও ব্যক্তিগত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড়ে কিছু কর্মচারী ও স্থানীয় লোকজনের জটলা দেখা যায়। পড়ে খবর নিয়ে জানা যায়, পরিচালক বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বয়ড়া গ্রামের মো. শফিকুল ইসলাম শাহীনকে হুমকি দেয়ার জন্য কয়েকজন সন্ত্রাসীকে পাঠিয়ে ছিলেন।
এ বিষয়ে শফিকুল বলেন, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জিটিআইয়ের পরিচালক তার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু চাকরি না দিয়ে সেই পদে বসিয়েছেন নিজের আত্মীয়কে। এখন টাকা ফেরত চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করছেন। নানাভাবে হুমকি দেয়ার চেষ্টাও করছেন। পরিচালকের কাছে ওই টাকা দেয়ার সাক্ষী তার কাছে আছে বলে জানান তিনি।
এ অভিযোগের বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, শফিকুল একটি চাকরির জন্য আমার অফিসে ধর্ণা দিত। চাকরি না পেয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কোনো টাকা-পয়সা নিইনি। শফিকুল আমাকে বলেছে যে সে চাকরির জন্য ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিয়া মোহাম্মদ রুবেল বলেন, প্রশাসনিক কোনো কাজে ছাত্রলীগ যুক্ত নয়। চাকরির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও জিটিআইয়ের পরিচালকেরই দেখার কথা।
অভিযোগের বিষয়ে পরিচালক এ.কে.এম. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সত্য নয়। কেউ হয়তো আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
পরিচালকের স্বেচ্ছাচারিতা, টাকা আত্মসাতের ও অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য মো. আলী আকবর বলেন, জনবল নিয়োগ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের জন্য। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে পুঁজি করে কারো কোনো অনিয়ম বা অর্থ লেনদেনের কোনো করার সুযোগ নেই। যদি এ ধরনের কোনো কিছু হয়ে থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
মো. শাহীন সরদার/এমএএস/এমএস