আন্দোলনের উত্তেজনার পর থমথমে ঢাবি
পূর্ব ঘোষিত পদযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ নিতে রোববার দুপুর দেড়টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিলে মিছিলে কর্মসূচিস্থলে আসতে শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল- কোটা বিলুপ্ত নয় যৌক্তিক সংস্কার।
দুপুর মোটামুটি ৩টার পর শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে ফেলেন আন্দোলনকারীরা। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় অনেককে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ লাঠিসোটা, টিয়ারসেল নিয়ে অবস্থান নেয়।
নিরাপত্তার অংশ হিসেবে শাহবাগ থানার সামনে একটি সাঁজোয়া যান (এপিসি) প্রস্তুত রাখে পুলিশ। যানটি শাহবাগ থানার পাশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি আসতেই শিক্ষার্থীরা মাটিতে শুয়ে পড়ে। তাদের ওপর দিয়ে সাঁজোয়া যান চালাতে বলে। শিক্ষার্থীদের সড়কে শুয়ে থাকতে দেখে পেছনে নেয়া হয় সাঁজোয়া যানটি।
দুপুরের দিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে এক বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোনোভাবেই হচ্ছে না। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেসময়কার বাস্তবতা বিবেচনায় ৫৬ শতাংশ কোটা রেখেছিলেন। তবে এখন আর এতো কোটার প্রয়োজন নেই। সরকার এটাকে বহাল রেখে মেধাবীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করছে। আমাদের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না দেয়া হলে আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’
এদিকে ঢাকার পাশপাশি রোববার বিকেলেরে মধ্যে আন্দোলন ছড়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাবি)। রাবির প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়কে প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী অবস্থান নেয়। এতে সড়কের দু’পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
শাহবাগ যখন কোটাবিরোধীদের আন্দোলনে উত্তাল তখন সেখানকার ফুল ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে তাদের দোকান বন্ধ করে দেন। একজন বিক্রেতা বলেন, আমাদের কষ্ট কেউ দেখার নেই। আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা আর দোকান বন্ধ আমাদের। দোকান বন্ধ থাকায় আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে নানা বক্তৃতা দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। ‘সেভ মেরিট সেভ নেশন, রিডিউস কোটা অনার-’ প্ল্যাকার্ডে এমন লেখাও ছিল আন্দোলনকারীদের।
সেখান থেকে একজন বক্তা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে করজোড়ে অনুরোধ দয়া করে মাত্র পাঁচ বছরের জন্য এই মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে দেশসেবার সুযোগ দিন। এ সময়ের মধ্যে এ মেধাবীরা দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করে দেখাবে।’
বক্তব্যের পাশাপাশি শাহবাগে তখন চলছিল দেশাত্মবোধক গানও। এভাবেই আন্দোলন চাঙা রাখছিলেন তারা।
ঢাবি, রাবির পর আন্দোলনে খবর আসে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়(বেরোবি), কারমাইকেল কলেজ, রংপুর সরকারি কলেজ, রংপুর মডেল কলেজ থেকেও। সেখানকার শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোটা ব্যবস্থা চলতে পারে না।
এদিকে শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ থাকায় ব্যা্পক যানজট ছড়িয়ে শাহবাগের আশপাশের এলাকায়।
রোববার বিকেল নাগাদ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাইপাস মোড় এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা পৌনে ৬টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচি পালন করা হয়েছে সিলেটেও।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে উত্তাল থাকার পর রাত পৌনে ৮টার দিকে শাহবাগে অ্যাকশনে নামে পুলিশ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ারসেল ও ফাঁকা গুলি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। ছত্রভঙ্গ করে দেয়ায় শাহবাগ পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটকও করে পুলিশ। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় শাহবাগ। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশের টিয়ারশেলের জবাবে ইট পাটকেল মারতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
এসবের মধ্যেই সোমবার থেকে সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে আন্দোলনকারীদের দিক থেকে।
স্লোগানমুখর আন্দোলনকারীদের দমাতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। রাত ১২টার দিকেও চারুকলার সামনে কয়েক হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন- ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, বুলেট দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।’ মিছিলকারীদের সামনে তখনও আগুন জ্বলছিল। টিয়ারসেলের ঝাঁজ থেকে বাঁচতে টায়ার ও পরিত্যক্ত কাঠ বাঁশে আগুন ধরিয়ে রেখেছিলেন তারা।
রাত সোয়া ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ শটগানের গুলি ছোড়ে এবং তাদের টিএসসির দিকে ধাওয়া করে। এ সময় একজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়েও যায় পুলিশ। আহত ওই শিক্ষার্থীরা নাম শাওন। তিনি সমাজকল্যাণ বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র এবং এফ রহমান হলে থাকনে। এ ছাড়া এক পুলিশ সদস্যের মাথা থেকে রক্ত ঝরতেও দেখা গেছে তখন। তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে রাত পৌনে ১টার দিকে চারুকলা চত্বরে যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। তখন তিনি বলেন, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা হয়েছে। বিষয়টি সমাধানে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। খুব শিগগিরই বিষয়টির সমাধান হবে।
এরইমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনে ভাঙচুর চালানো হয়। আগুনও দেয়া হয়।
সোমবার ভোর নাগাদ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ফিরতে দেখা যায়। এরপরই পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসে।
এরপর সোমবার সকালে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জসীম উদ্দিন শাহবাগ, দোয়েল চত্বর ওে টিএসসি এলাকা ঘুরে জানান, সেখানে আন্দোলনকারীরা নেই। তবে পুলিশের সতর্ক অবস্থান রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফাঁকা ফাঁকা ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
রমনা জোনের পুলিশ কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
এনএফ/জেআইএম