বৃষ্টিতে রোপণে দেরি ও পচন
মুড়িকাটা পেঁয়াজের ফলন নিয়ে শঙ্কায় পাবনার কৃষকরা
সাধারণত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণ করেন পাবনার চাষিরা। মৌসুমি আবাদ শুরু হওয়ার আগেই এ পেঁয়াজ বাজারে আসায় সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে।
তবে এবার কয়েকটি ধাপে অতি বৃষ্টির ফলে পেঁয়াজের জমিতে পানি জমে থাকায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ দেরিতে পেঁয়াজ রোপণ করতে হয়েছে। আবার এর মধ্যেও বৃষ্টি হওয়ায় অঙ্কুরোদগমের আগেই পচে যাচ্ছে নিচু জমির বীজ। ফলে এবার উৎপাদন কিছুটা কম হবে বলে আশঙ্কা চাষিদের। একইসঙ্গে উচ্চমূল্যে সার, কীটনাশক ও বীজ কেনায় খরচ বাড়ায় লাভ নিয়ে শঙ্কা তাদের।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, খরচ বাড়লেও রোপণে দেরি ও স্বল্প পচনে ফলনে তেমন প্রভাব পড়বে না। ভালো দামে লাভবান হবেন কৃষক।
- আরও পড়ুন
- গাছের পাতা পোড়া রোগ হলে করণীয়
চাষিরা বলছেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজের বীজের দাম বেড়েছে। ৫/৬ হাজার টাকা মণের বীজ এবার তাদের কিনতে হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায়। হাজার টাকার এক বস্তা বিএডিসি ড্যাপ সার আবার ১২০০-১২৫০ টাকা, ১৫০০ টাকার বাংলা ড্যাপের দাম হয়েছে ১৭০০-১৮০০ টাকা। একইভাবে লেবার বিলসহ সবদিক থেকে খরচ বেড়েছে।
এদিকে দফায় দফায় অতিবৃষ্টির ফলে জমিতে জলাবদ্ধতা হওয়ায় রোপণেও পিছিয়ে পড়েছে তারা। আবার এরমধ্যেও বৃষ্টি হওয়ায় মাটির নিচে থেকেই পচে যাচ্ছে নিচু জমির বীজ। কোথাও কোথাও অঙ্কুরোদগম হওয়া চারাও পচে যাচ্ছে। এসব জায়গায় আবার বীজ লাগাতে খরচ বেড়ে যাবে, পেঁয়াজ বাজারে উঠতে দেরি হবে এবং ফলন কম হবে।
এ ব্যাপারে সুজানগরের মুজাহিদপুরের পেঁয়াজ চাষি আরিফ বলেন, জমি থেকে বৃষ্টির পানি নামতে দেরি হওয়ার ফলে এবার পেঁয়াজ রোপণে আমরা পিছিয়ে গেছি। উপযুক্ত না হওয়ায় এখনো কিছু জমিতে পেঁয়াজ রোপণ করা হয়নি। তিন থেকে চারদিন পর এসব জমিতে বীজ লাগাতে হবে। এই পিছিয়ে পড়ার কারণে এবার পেঁয়াজের ফলনে মার খাবো আমরা। দেরিতে বুনলে গাছের ফুল বেশি হয়, অন্যদিকে ফলন কম হয়। এমনিতে বিঘা প্রতি ফলন ৬০ মণ হলে এবার ৫-১০ মণ করে কম হবে। আবার বাজারে উঠতেও দেরি হবে। ফলে ভালো দাম পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
একই এলাকার চাষি মকবুল মিয়া। তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন তিনি। এবার পেঁয়াজ লাগাতে গিয়ে ব্যাপক খরচ বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতি বিঘা পেঁয়াজ লাগাতে এবার খরচ হয়েছে এক লাখ থেকে এক লাখ পনেরো হাজার টাকার মত। সার বিষ ও বীজের দাম অতিরিক্ত বাড়তি। এক মণ পেঁয়াজ ঘরে তুলতে প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ পড়ে যাবে। লোন নিয়ে ক্ষেত করতে হচ্ছে, এর সুদ আছে। সেক্ষেত্রে ৪-৫ হাজার টাকা দরে না বিক্রি করতে পারলে পোষাবে না।
গোপালপুর গ্রামের চাষি আ. মজিদ বলেন, এবার ১০ বিঘা মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করেছি। এরমধ্যে বৃষ্টির কারণে ৫ বিঘা জমির পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। এমনিতে উচ্চদরে বীজ কেনায় খরচ বেড়েছে, এই নষ্ট হওয়া পেঁয়াজ ফের লাগাতে দ্বিগুণ খরচ। এবার কপালে কি আছে তা বলা মুশকিল।
মাঠে সদ্য অঙ্কুরোদগম হওয়া পেঁয়াজের পরিচর্যা করছিলেন রফিক, ইফনুছ মৃধা ও জহিরুল ইসলামসহ কয়েকজন চাষি। তারা জানান, দেরিতে লাগানোর ফলে এবার পেঁয়াজের ফলন কম হবে। দাম ভালো পেলে হয়তো চাষি বাঁচবে। কিন্তু সেটা তো হয় না। বাজারে কিনতে গেলে কেজি ১৫০-২০০ টাকা, আমরা বেচতে গেলে দাম নাই। এভাবেই আমাদের ঠকানো হয়। জন্মাই আমরা, কিন্তু ফায়দা লুটে ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই এবার প্রচুর খরচ, প্রায় সবাই লোন নিয়ে জমি করেছি। অন্তত কৃষক বাঁচাতে নতুন সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, ন্যায্য দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার।
কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ পেঁয়াজই উৎপাদন হয় উত্তরের জেলা পাবনায়। সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়াসহ কয়েকটি উপজেলায় এ পেঁয়াজের আবাদ হয়। এ বছর পাবনায় পেঁয়াজ আবাদের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৮০১ হেক্টর। এরমধ্যে মুড়িকাটা ৮ হাজার ৫৮০ হেক্টর। এর বিপরীতে আবাদ হয়েছে ২ হাজার ১২৩ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৫৯৬ টন। এ পেঁয়াজ বাজারে আসতে সর্বোচ্চ ৮০ দিন সময় লাগে। তবে এবার বৃষ্টির কারণে মাটির শক্তি বেশি থাকায় আরও কম লাগবে। সবমিলিয়ে ডিসেম্বরের শেষের দিকে এ পেঁয়াজ বাজারে উঠবে বলে আশাবাদি কৃষি বিভাগ।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) রোকনুজ্জামান বলেন, বৃষ্টির ফলে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এবার পাবনায় পেঁয়াজ রোপণ হয়েছে। তাতেও কৃষকরা পিছিয়ে নেই, কারণ নভেম্বর অবধি মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের সময় থাকে। এছাড়া বৃষ্টির কারণে নিচু জমির খুবই অল্প পেঁয়াজ পচতে পারে। এক্ষেত্রে ফলনে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। আবহাওয়া ভালো থাকলে ভালো ফলন পাবে এবং ভালো দাম পেলে কৃষকরা লাভবান হবেন।
আলমগীর হোসাইন/কেএসকে/জিকেএস