মৌসুমেও হাকডাক নেই বাজারে
ঝালকাঠির পেয়ারা চাষিদের কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা
পর্যটক, পাইকার, দর্শনার্থীদের আনাগোনা নেই দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী ভাসমান পেয়ারার বাজার ঝালকাঠির ভিমরুলিতে। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পেয়ারা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। প্রতি বছর এ মৌসুমে ভ্রমণপিপাসু, পর্যটক, পাইকার, দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। স্থানীয়ভাবে মৌসুমকে ঘিরে দোকান ও রেস্টুরেন্টেও থাকে ব্যস্ততা। তবে এখন পেয়ারা বাজার এলাকায় কোনো হাকডাক নেই। পাইকার না থাকায় পেয়ারা চাষিরা প্রতিমণ পেয়ারা ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
ছোট ছোট সাজিতে পর্যটকদের কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা পেয়ারায়ও পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত মূল্য। মৌসুমি দোকানদাররাও আশানুরূপ বিক্রি করতে পারছেন না। সব মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা পেয়ারা চাষি ও স্থানীয়দের। পেয়ারা মৌসুমের শুরুতেই হোচট খেয়েছেন চাষিরা। এমনিতেই এ বছর ফলন কম হওয়ায় ন্যায্য দামের আশায় বুক বেঁধেছিলেন চাষিরা। পাইকার, ক্রেতা ও পর্যটক সংকটে পেয়ারার চাহিদা কম থাকায় কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমবেশি সব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পেয়ারার চাষ হলেও বরিশালের বানারিপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশালের বানারিপাড়ার ১৬টি গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠি জেলার ১৩টি গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠির ২৬টি গ্রামে ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে পেয়ারার সমারোহ থাকে।
এদিকে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলি, শতদশকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়কাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামের বড় অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষ হচ্ছে। তবে এবার গাছগুলোয় দেরিতে ফুল এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় সেই ফুল অনেকটাই ঝরে পড়েছে। এতে পেয়ারা চাষি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় চাষিরা জানান, আনুমানিক ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে বিচ্ছিন্নভাবে আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ। এ আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৪ সালে ৫৬২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৬০৪২ মেট্রিক টন।
কৃষক পঙ্কজ বড়াল বলেন, ‘পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিল এ বছর; বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝরে পড়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পর্যটক ও পাইকারদের আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হওয়ায় পাইকার, ক্রেতা ও পর্যটক না আসায় পেয়ারার চাহিদা তুলনামূলক অনেক কম। ন্যায্য দাম তো দূরের কথা, নামমাত্র মূল্যেও বিক্রি করতে পারছি না। লাভ তো দূরের কথা, আসল খরচের টাকাই ওঠে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
কৃষক দেবব্রত হালদার বিটু বলেন, ‘পেয়ারা আমাদের মৌসুমি আয়ের একমাত্র অবলম্বন। পেয়ারার ফলন ভালো হলে আমাদের সচ্ছলতা আসে। পানির ওপরই ভাসমান হাটে বছরে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। অস্থায়ী কিছু দোকানপাট বসে পাইকার, পর্যটক বা দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের বা ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে ব্যবসা করে আর্থিকভাবে লাভবান হন বিক্রেতারা। কিন্তু দেশে সহিংস পরিবেশ বিরাজ করায় পাইকার আগমনসহ সবকিছুতেই প্রভাব পড়েছে। বাজারের যে অবস্থা; তাতে পেয়ারাও গাছ থেকে পারতে ইচ্ছা করে না।’
কৃষক বিপুল চক্রবর্তি বলেন, ‘আমরা সংসারে তিনজন পুরুষ পেয়ারা বাগানের পরিচর্যাসহ সব ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকি। বছরের এ মৌসুমটায় আমাদের আয় দিয়ে সারাবছর সংসার চলে। এ বছর ফলন কম হয়েছে। তার মধ্যে আবার দেশের অবস্থা খারাপ। যদি ন্যায্য দাম না পাই, তাহলে মৌসুমের তিনমাসই সংসার চালানো দুঃসাধ্য হবে। বাকি সময়টাতে কীভাবে চলবো, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।’
পর্যটন ব্যবসায়ী সুজন হালদার শানু বলেন, ‘পেয়ারা মৌসুমকে ঘিরে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক আসেন। আগে শুধু নৌপথে আসতো। এখন সড়কপথ ভালো হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই যাতায়াত সম্ভব। কিন্তু দেশের পরিস্থিতির কারণে পর্যটকশূন্য। পেয়ারা চাষিদের বাগানে ঢুকে ক্ষতি সাধন হওয়ায় আমরা পেয়ারা বাগানে নান্দনিক ভ্রমণের সুযোগ করেছি। কিন্তু এ বছর যেভাবে পেয়ারার বাজারের অবস্থা; তাতে তেমন পর্যটক বা দর্শনার্থী আসছেন না। এ বছর সবদিক থেকেই লোকসানের মুখে পড়বে এখানকার লোকজন।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার বলেন, ‘আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে ভরা মৌসুম। দেশের পরিস্থিতির কারণে পর্যটক ও পাইকারদের আগমন না থাকায় চাষিদের খরচ পোষানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঝালকাঠি সদর উপজেলার ১৩ গ্রামে ৫৬২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৬০৪২ মেট্রিক টন। পেয়ারা মৌসুমে এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ফুল কিছুটা ঝরে গেছে। তবুও যা আছে তার ঠিকমতো ন্যায্য দাম পেলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থার কারণে পাইকার, ক্রেতা, পর্যটক না আসায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।’
মো. আতিকুর রহমান/এসইউ/জিকেএস