৪০ লাখ টাকা বিক্রির আশা
মাদারীপুরে ১২ একর জমিতে ড্রাগন চাষে সফল সজীব
মাদারীপুরের সজীব হোসাইন সাদ্দাম নামের এক যুবক ১২ একর জমিতে ড্রাগন চাষ করছেন। প্রথমদিকে অল্প চাষ করলেও লাভ বেশি হওয়ায় আস্তে আস্তে চাষ বেড়েছে। প্রথমে একটি বাগান করে লাভ হওয়ায় আরেকটি বাগান করেছেন তিনি। গত বছর ৩২ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন। এবার ৪০ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন। বর্তমানে তার বাগানে ১০ জন কর্মচারী কাজ করেন। তবে জেলায় আরও কয়েকজন ড্রাগন চাষ করলেও তা স্থায়ী হয়নি। শুধু সজীব হোসাইন সাদ্দাম নিজ উদ্যোগে ড্রাগন ফলের বাগান করে সফল হয়েছেন।
কৃষি অধিদপ্তর, চাষি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট দুধখালীর চরনাচনা গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদারের ছেলে সজীব হোসাইন সাদ্দাম। ৫ ভাই ১ বোনের মধ্যে সজীব সবার ছোট। ঢাকায় আইন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করেছেন। শখের বশে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভারতসহ বেশ কিছু দেশ ঘুরেছেন। থাইল্যান্ডে ড্রাগনের বাগান দেখে শখের বশেই গড়ে তোলেন বাগান।
২০১৯ সালে ৩ একর জমিতে শুরু করেন ড্রাগন চাষ। তখন ১ হাজার খুঁটিতে ৪ হাজার গাছের চারা লাগান। নাম দেন হাজী এগ্রো অ্যান্ড ড্রাগন গার্ডেন। তিনি দেশ-বিদেশ থেকে উন্নত জাতের প্রায় ৫ হাজার ড্রাগন ফলের চারা সংগ্রহ করেন। প্রথম ফল বিক্রি করেন ২০২০ সালে। ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করে আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। বর্তমানে ৯ একর জমিতে চাষ করছেন। লাভ ভালো হওয়ায় এ বছর একই উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিয়ারচর গ্রামে ৩ একর জমিতে ড্রাগনের চাষ শুরু করেছেন। নিজের কেনা জমির পাশাপাশি আশপাশের মানুষজনের কাছ থেকে লিজ নিয়েছেন জমি।
সরেজমিনে জানা যায়, চরনাচনা গ্রামের ৯ একর জমিতে ড্রাগন বাগানে ৪ হাজার খুঁটিতে ১৮ হাজার গাছ আছে। এ ছাড়া একই উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিয়ারচর গ্রামে ৩ একর জমিতে ১ হাজার ২০০ খুঁটিতে ১২ হাজার গাছের চারা লাগিয়েছেন। প্রতিদিন তার ১০ জন কর্মচারী কাজ করেন। প্রথম বছর বন্যার পানিতে ড্রাগনের ক্ষতি হলেও পরের বছর থেকে সফলতা পেতে শুরু করেন। গত বছর ৩২ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন। এ বছর তার আশা ৪০ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করতে পারবেন।
ড্রাগন ফলের পাশাপাশি সজীব আম, লেবু, আখ, নারিকেল, কলা, নানা ধরনের সবজিসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ড্রাগন বাগানের পাশেই গরুর ফার্ম গড়ে তুলেছেন। এ বছর কোরবানিতে তিনি ২৬টি গরু ৫২ লাখ টাকা বিক্রি করেন। এখনো তার ফার্মে ১০টি গরু আছে। সজীবের বাবা সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদারও ছেলেকে সাহায্য করেন। এক সপ্তাহ আগে ফল পাকতে শুরু করেছে। তাই প্রতিদিন সকালে ড্রাগন ফল তুলে তা ভ্যানগাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় মাদারীপুরের সবচেয়ে বড় ফলের আড়ৎ মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর বাজারে। সেখানে পাইকারিভাবে ফলগুলো বিক্রি করা হয়। শুরুর দিকে দেড়শ থেকে ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। পরে তা বেড়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ পর্যন্ত হয়।
চাষি সজীব হোসেন সাদ্দাম বলেন, ‘প্রথমদিকে ড্রাগন চাষ করে হঠাৎ বন্যায় বাগানের অনেক ক্ষতি হয়। পরে অনেক কষ্ট করে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে। প্রথমে ৩ একর জমিতে চাষ শুরু করি। পরে আস্তে আস্তে আশেপাশে জমি কিনে ও লিজ নিয়ে চাষ বাড়াতে থাকি। বর্তমানে একটি বাগানে ৯ একর ও আরেকটি বাগানে ৩ একর জমিতে এ ড্রাগন চাষ করছি। লাভও ভালো হয়। কারণ ড্রাগনের বাগান করতে খরচ খুব কম হয়। আর যা খরচ হয়, তা শুরুতে হয়। পরে তেমন খরচ নেই। একটি খুঁটিতে চারটি করে গাছ লাগানো হয়। একবার বাগান তৈরি করলে তা ৩০ বছর পর্যন্ত কাজে লাগানো যায়। তাই লাভ বেশি হয়। আমি গত বছর ৩২ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছি। এবার আশা করছি ৪০ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করতে পারবো।’
প্রতিবেশী জলিল ফকির বলেন, ‘সজীব হোসেন সাদ্দাম একজন শিক্ষিত মানুষ হলেও এখানে ড্রাগনের বাগান করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এটা খুব ভালো। তার ওখানে অনেক মানুষ কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। শুধু ড্রাগন নয়, তিনি আম, নারিকেল, কলাসহ ফলের চাষ করেছেন। তাছাড়া গরুর ফার্মও করেছেন তিনি। তাকে দেখে অনেকেই এই কাজে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।’
বাগানের কর্মচারী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানে আমি প্রায় চার বছর ধরে কাজ করি। প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে পাই। এই টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে। এই বাগানের জন্যই আমার কর্মসংস্থান হয়েছে। এত বড় বাগানে ড্রাগনের চাষ জেলায় আর নেই।’
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, ‘সজীবের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি চাকরি না খুঁজে নিজেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি অন্যদেরও কাজের ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া এই বাগান একদিকে যেমন অর্থের জোগান দিচ্ছে; অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাচ্ছে। তার এই বাগানের সফলতা দেখে অনেক যুবক এগিয়ে আসবেন। এতে দেশের বেকারত্ব কমবে।’
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হেমায়েত সরদার বলেন, ‘মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুরের সজীব হোসাইন সাদ্দাম নামের এক যুবক প্রায় ১০ একর জমিতে ড্রাগন চাষ করছেন। তিনি এই ড্রাগন চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। জেলায় আরও কয়েকজন ড্রাগন চাষ করলেও তা স্থায়ী হয়নি। তাছাড়া আমরা তাকে সব সময় সহযোগিতা করেছি।’
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সন্তোষ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘মাদারীপুরে সজীব ড্রাগন ফল চাষ করে অনেক লাভবান হয়েছেন। সজীবকে আমরা সব সময় সহযোগিতা করেছি। আমরা তার বাগানও পরিদর্শন করেছি। সে অল্প সময়েই একজন সফল চাষি হিসেবে জেলায় পরিচিতি লাভ করেছেন। তাকে দেখে অনেকেই এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছি।’
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/এসইউ/জিকেএস