মিরসরাইয়ে ১০ বছরে ৯৫ শতাংশ পান চাষ কমেছে
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা একসময় পান চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। ধীরে ধীরে কমে গেছে পান চাষ। গত ১০ বছরে ৯৫ শতাংশ পান চাষ কমে গেছে। পান চাষিরা অন্য কিছু চাষ করছেন। আবার অনেকে পেশা বদলে ফেলেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পান বিক্রির জন্য মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট বাজারের নামকরণ করা হয়েছে। পানের বারৈ অর্থাৎ পান বিক্রেতারাই বারইয়ারহাট বাজারটির নামকরণ করেন। সেই থেকে সরকারিভাবে বাজারটির নাম হয় বারইয়ারহাট।
উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর এলাকার বারোমাসি ছড়ার পাড়ে আজ থেকে ১৫ বছর আগে চোখে পড়তো পানের বরজ। পান চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওই এলাকার শতাধিক কৃষক। এখন একটি পানের বরজও নেই। পান চাষিরা পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন।
মধ্যম ওয়াহেদপুর এলাকার পান চাষি চিত্তরঞ্জন নাথ বলেন, ‘প্রচুর বৃষ্টি ও শীতে পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। এছাড়া দিন দিন বাঁশ, ছনসহ পান চাষের বিভিন্ন উপকরণের দামও বেড়ে যাওয়ায় এখন আর পান চাষ করছি না। বাইরের আড়ত থেকে কিনে এনে বাজারে পান বিক্রি করে থাকি।’
আরও পড়ুন: ভবনের ছাদে হোক শীতকালীন সবজির বাগান
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, একসময় উপজেলার হিঙ্গুলী, দুর্গাপুর, ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পান চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। ২০১৩ সালে মিরসরাইয়ে প্রায় ৩৫ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছিল। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হেক্টরে। ২০১৫ সালে ১০ হেক্টর চাষ কমে নেমে আসে ৪০ হেক্টরে। ২০১৬ সালে চাষ হয় ১৫ হেক্টর। ২০১৭ সালে ১০ হেক্টর, ২০১৮ সালে ১০ হেক্টর এবং ২০১৯ সালে ৮ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। এরপর থেকে উৎপাদন আর বাড়েনি। ২০২০-২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে শুধু হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে পান চাষ হয়।
মিরসরাই উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামে প্রায় শত বছর ধরে পান চাষ হয়। এখানকার ঝাল পানের চাহিদা থাকায় সরবরাহ হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
পান চাষিরা জানান, একসময় মিরসরাই উপজেলাজুড়েই পানের চাষ হতো। তবে চাষের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, পুঁজির সংকট, বিরূপ আবহাওয়া আর রোগবালাইয়ের ঝক্কি সামলে উঠতে না পেরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার চাষিরা পান চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। তবু নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামের ৫০ জন কৃষক এখনো ধরে রেখেছেন পান চাষের ঐতিহ্য। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টির মতো পানের বরজ রয়েছে।
হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বারইয়ারহাটের মেম্বার পানের আড়তের মালিক ইফতেখার উদ্দিন পিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে বারইয়ারহাটে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পান বিক্রির জন্য আনতেন চাষিরা। এখন তা নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। তবে পাইকারি বিক্রির জন্য উত্তরবঙ্গ থেকে এখানে পান নিয়ে আসেন চাষিরা।’
আরও পড়ুন: ঝিনাইদহে বাড়ছে ড্রাগনের ফুল ও ফল
স্থানীয় বাজারগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এক বিড়া (৭০টি) পান বিক্রি হচ্ছে ৫০-১০০ টাকায়। তবে শীতে কিছুটা দাম বাড়লেও বর্ষায় কমে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত। উপজেলার বারইয়ারহাট ও মিঠাছড়া বাজারে সপ্তাহে তিনদিন পানের বাজার বসে। বারইয়ারহাট বসে শনি, সোম ও বৃহস্পতিবার। আর মিঠাছড়া বাজারে বসে রোববার ও বৃহস্পতিবার।
একসময় দুই বাজারে প্রতি হাটবারে প্রায় কোটি টাকা লেনদেন হতো বলে জানান আড়তদাররা। এখন তা নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। পানের বরজ করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়ে বাঁশ, ছন ও খৈলের। অথচ এগুলোর সংকট দেখা দিয়েছে। ভাদ্র থেকে আশ্বিন পর্যন্ত খৈলের প্রয়োজন পড়ে। এগুলো না দিলে পান গাছের মূলে পচন ধরে। পান চাষে ব্যবহৃত বাঁশের খুঁটি ও ছন পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা হয়। বন বিভাগ সেখানে বাগান করায় বাঁশ ও ছন সংকট দেখা দিয়েছে।
হিঙ্গুলী গ্রামের পান চাষি নারায়ণ চন্দ্র আইচ বলেন, ‘মিরসরাইয়ে দিন দিন পান চাষ কমে যাচ্ছে। আমি চলতি বছর মাত্র ৫০ শতাংশ জমিতে পান চাষ করেছি। পান চাষের উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। এছাড়া সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া না যাওয়ায় চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা।’
আরও পড়ুন: মিরসরাইয়ে পানির স্কিমগুলো চালুর দাবি
তিনি আরও বলেন, ‘অন্য ফসল চাষে কৃষি বিভাগ নানা প্রণোদনা দিলেও পান চাষিদের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না কখনো। সহজ শর্তে কোনো ঋণের ব্যবস্থাও নেই আমাদের জন্য। পুঁজির সংকট খুব ভোগায়।’
এ বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, ‘মিরসরাইয়ে পান চাষের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। পান চাষিদের জন্য আর্থিক কোনো সুযোগ কিংবা প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকায় আমরা শুধু পরামর্শ দিয়ে থাকি।’
এম মাঈন উদ্দিন/এসইউ/এএসএম