ভিডিও EN
  1. Home/
  2. কৃষি ও প্রকৃতি

ঢাকায় দাবদাহ ও বায়ুদূষণ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ

সমীরণ বিশ্বাস | প্রকাশিত: ০৬:১৮ পিএম, ১০ মে ২০২৩

 

জলবায়ু ও মাটির গুণে প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ সবুজের সমারোহের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। আর এ সমারোহ শুধু গাছের জন্য সংখ্যাধিক্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রজাতির বৈচিত্র্যও সমৃদ্ধ ছিল। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার্থে একটি দেশের আয়াতনের শতকরা ২৫ ভাগ এলাকায় বনভূমি থাকা একান্ত প্রয়োজন বলে বিশেজ্ঞরা মনে করেন। কিন্তু বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় বনাচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মাত্র ৭.৭ ভাগ এবং ভূমি এলাকার তুলনায় ১৪ শতাংশ বনাঞ্চল। গাছ শুধু প্রাকৃতিক শোভাই বাড়ায় না, মাটির ক্ষয় রোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, ঝড়-তুফানকে বাধা দিয়ে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও গাছের ভূমিকা অপরিসীম।

গাছ ছাড়া পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হতো। গাছ অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মানুষের ক্ষুধার অন্ন সে জুগিয়েছে। লজ্জা নিবারণের জন্য দিয়েছে বল্কল, বৃক্ষের পত্রে রচিত হয়েছে লিপি, মানুষের অসুখে জুগিয়েছে প্রশান্তি। গাছের অক্সিজেন আবহাওয়াকে করেছে নির্মল, মানুষের পরিত্যক্ত ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে সে নিজ শরীরে ধারণ করেছে। প্রাচীন ভারতের বেদে বৃক্ষের অপরিসীম গুরুত্বকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করা হয়েছে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পরিবেশের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়, সে বিষয় সম্পর্কে ভাবিত হয়েছে। অত্যাধুনিককালে পৃথিবীর অন্য দেশে চিন্তার বিষয়রূপে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেছে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরেই আজ শ্যামল-সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব। কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তাই বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা আছে।

আরও পড়ুন: পোষা পাখির সঙ্গে একদিন 

ঐতিহ্যের শহর ঢাকা। চারশ বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গমাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরও বেশি। ধারণা করা হয়, প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বর্গমাইলে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ।

জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের মতে, ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২%, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭% এর বেশি নয়। ঢাকায় যত পরিমাণ গাছ কাঁটা হয়, তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। ৮০ দশকের পর থেকে বৃক্ষ নিধন শুরু হয়েছে। ফলে ঢাকার চেহারাও বদলাতে শুরু করে। গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এ ছাড়াও বৃষ্টিপাত ঘটাতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঢাকা শহরেই নাকি বায়ুমণ্ডলে প্রায় ১০০০ মেট্রিক টন দূষিত কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। যার মধ্যে প্রতিদিন ঢাকা শহরের গাছগুলোয় ৪৩৬ মেট্রিক টন ধুলা জমে। এ থেকে শহরতলির শিল্পাঞ্চলের অবস্থা কল্পনা করা যায়। নগরজীবনে উত্থিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, দাবদাহ মানুষকে জটিল রোগের শিকার করে তুলছে। বৃক্ষ অনায়াসে এ বিষকে কণ্ঠে ধারণ করতে পারে, কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন, যেটা বৃক্ষই দিতে পারে। বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অরণ্যের অগ্রদায়িত্ব বহন করে বৃক্ষ। সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড, তুলতায়র ক্লোরাইড ইত্যাদি দূষণে সক্ষম না হলেও নগরজীবনে দুরারোগ্য ব্যধিতে বিস্তার ঘটবে। অথবা পৃথিবীতে দেখা দেবে বিপুল প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

আরও পড়ুন: সূর্যমুখী বাগানে প্রবেশমূল্য ২০, বিক্রি হয় ফুল 

পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুমেরুর বরফ গলতে শুরু করবে। বৃক্ষহীনতায় বৃষ্টি কমবে, অতিরিক্ত সূর্যতাপে মাটি হয়ে উঠবে রুক্ষ্ম। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে এখনই। মানুষকে তাই পরিবেশ সচেতন হতে হবে। একমাত্র গাছই আমাদের পরিবেশ পরিষেবা দিতে পারে। কলুষিত বিষাক্ত বাতাস নীলকণ্ঠের মতো গ্রহণ করে অরণ্যানী নির্মল বাতাসে রূপান্তরিত করতে পারে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি রোধ করতে গাছের যথাযথ ভূমিকা আছে। বৃক্ষরোপণে বন বাঁচবে, বন্যপ্রাণী বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। লোকালয় সুন্দর হবে, পৃথিবী হবে দূষণমুক্ত। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ও গাছ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।

গ্রীষ্মে ঢাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা বর্তমানে বেড়ে ৩৮-৪০ সেলসিয়াসেরও বেশি থাকে। অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধনের জন্য খরা ও বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। ফলে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা সহজেই অনুমেয়। বৃক্ষ ঢাকাকে ছায়া শীতল রাখতে সহায়তা করবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরিতেও গাছপালার অবদান আছে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বর্তমানে দেশে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ আছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা জনবহুল শহরের তালিকায় ১১তম স্থানে আছে।

ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর গ্লোব্যাল সিটিস ইনস্টিটিউশন পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল শহর। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২১.৪% শহরে বাস করে। যার সিংহভাগই ঢাকায়। ঢাকার মানুষ সাধারণত চাকরি, ব্যবসা, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। ফলে কৃষিপণ্য উৎপাদনে তাদের প্রত্যক্ষ অবদান নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ৭৮.৬% মানুষ গ্রামে বাস করেন। যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এদিকে ১% হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষকের বাড়ি 

আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে ঢাকা হবে সবুজের শহর। প্রতি বছর গাছ লাগানো কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অকারণে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। রাস্তার পাশে, খোলা মাঠে, খাল-বিল, নদী, লেকপার, উদ্যান, চত্বর, রাস্তার পাশে, ডিভাইডার, বাসা-বাড়ির আডিনায়, বাড়ির আশেপাশে পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ করতে হবে। দিন দিন শহরের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ২৫% বনায়ন নিশ্চিত করেই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। নগর কৃষি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। যা এ শহরের চেহারা বদলে দেবে। বসবাসযোগ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত শহরের তালিকায় স্থান করে নেবে ঢাকা।

লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।

এসইউ/জিকেএস