ঈশ্বরদীর পদ্মার চরে ফসলের সমারোহ
পদ্মার বুকজুড়ে জেগে ওঠা চরে ফলেছে সোনার ফসল। নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা প্রায় ১২শ বিঘা জমিতে শোভা পাচ্ছে সবুজের সমারোহ। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের মাজদিয়া গ্রামের প্রমত্তা পদ্মার বুকে ২০০২ সালে জেগে ওঠে মোল্লার চর। একসময় মোল্লার চরজুড়ে ছিল ধূ ধূ বালুচর। ফলে সারাবছর এ চর পতিতই থাকতো। ২০০৭ সালে এ চর পলিমাটির আবরণে ঢেকে গেলে কৃষকরা চাষাবাদ শুরু করেন। প্রায় চার কিলোমিটার দৈর্ঘ ও দুই কিলোমিটার প্রস্থ এ চরের বেশিরভাগ জমিজুড়ে এখন ফসলের সমারোহ।
উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের মাজদিয়া পদ্মা নদীর মোল্লার ঘাট পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এ চরে। নদীর মাঝে দ্বীপের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মোল্লার চর। বিস্তীর্ণ এ চরের পূর্ব পাশে নাটোরের লালপুর ও পশ্চিম পাশে নদী পাড়ি দিলেই কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা। তিন জেলার সীমান্তবর্তী মোল্লার চর এ অঞ্চলের মানুষের কাছে শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি এ চরে প্রায় ৩৫টি বাথানে প্রায় ৩ হাজার গরু-মহিষ পালন করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ চর রাখাল, গোয়াল ও কৃষাণের পথচারণায় মুখর থাকে।
সরেজমিনে জানা যায়, এখানে চলে কৃষকের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ চরে গম, ভুট্টা, মসুর, মটরশুটি, খেসারি, বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টি আলুসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি বোরো ধান ও আখ রোপণ করা হয়েছে।
কৃষকরা জানান, সত্তরের দশকে মোল্লার চরজুড়ে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি ছিল। স্কুল, মসজিদ, ঈদগাহ, মাঠসহ সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। মোল্লার চর থেকে পদ্মা নদী ছিল এক কিলোমিটার পশ্চিমে। ধীরে ধীরে এ গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এ গ্রামের বাসিন্দারা পাশের এলাকায় বসতি গড়েন। প্রায় ৪০ বছর পর আবারও পদ্মার বুকে মোল্লার চর জেগে ওঠে। এ চরে কেউ বসতি না গড়লেও গরু-মহিষের বাথানে প্রায় দেড় শতাধিক রাখাল ও গোয়াল অস্থায়ীভাবে বাস করে। জমির মালিকেরা নিজ নিজ জমিতে শুরু করে চাষাবাদ।
আরও পড়ুন: লোকসান ঠেকাতে আগাম তরমুজ চাষ
চরে বছরে দুবার আবাদ করা যায়। আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত চর পানির নিচে ডুবে থাকে। চরের পানি নেমে গেলে আবারও চাষাবাদ শুরু হয়। পলিমাটির কারণে এ চরে আবাদের ফলন খুব ভালো হয়। বালুদস্যুদের অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে চরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৫০ বিঘা জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি গম, খেসারিসহ আবাদি জমিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলমান থাকলে দুই-চার বছরের মধ্যে এ চর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
চরের কৃষক আলতাব মোল্লা (৬০) বলেন, ‘এ চরে একসময় আমাদের বাড়িঘর ছিল। পৈতৃক সম্পত্তি সবই এ চরে। নদীতে বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ায় আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। আবারও জমি-জমা ফিরে পেয়েছি। এবার ৭ বিঘা জমিতে গম, ছোলা, মসুরের আবাদ করেছি। আবাদ খুব ভালো হয়েছে। আশা করি ফলনও ভালো হবে।’
কৃষক রিপন মোল্লা (৫৮) বলেন, ‘৫০ বিঘা জমিতে ধান, গম, আখ, মসুর, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করেছি। এ জমি আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। আমার বাবা-দাদারা চাষাবাদ করেছেন। প্রায় ৪০ বছর নদীতে বিলীন ছিল। এখন চাষাবাদ শুরু করেছি। নদী পাড় হয়ে যাতায়াত করতে হয়। এখানকার ফসল নদী পাড়ি দিয়ে বাড়িতে আনতে হয়। নদীপথ ও নৌকা ছাড়া বিকল্প কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় এ চরের কৃষকদের ফসল ফলাতে খুব কষ্ট হয়।’
রবিউল ইসলাম নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘৩০ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করেছিলাম। ফলন ভালো হয়েছে। এবার একই জমিতে খেসারি ও মসুরের আবাদ করেছি। এ ফসল ওঠার পর পাট চাষ করবো। চরের চাষাবাদ শুরুর পর থেকে এখানকার কৃষকরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।’
আরও পড়ুন: অনুর্বর মাটিতে ভেন্না চাষ করবেন যেভাবে
কৃষক মখলেছ হোসেন মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মোল্লার চরে চাষাবাদ শুরুর পর থেকে কৃষকরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন। বাবা-দাদার হারানো সম্পত্তি আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু বালুদস্যুদের কারণে চরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমার দুই বিঘা খেসারির জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলেছি। এভাবে চলতে থাকলে চর নদীগর্ভে আবারও বিলীন হয়ে যাবে।’
সাঁড়া ইউনিয়নের কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ চরে আবাদ করে কৃষকরা বেশ লাভবান হয়েছেন। চরাঞ্চলে কৃষি উন্নয়নে সরকারের একটি প্রকল্প আছে। এ চর সে প্রকল্পের আওতায় আনা হলে কৃষকরা বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা পেতেন। এতে তারা চাষাবাদে আরও বেশি উৎসাহিত হতেন। ফলন আরও ভালো হতো।’
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ চরে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় বাদামের। এ ছাড়াও সবজি ও ডাল জাতীয় ফসল আবাদের জন্য এ চর প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। রবি মৌসুমে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে মসুর, খেসারি, মটরশুটি, ছোলাসহ বিভিন্ন ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ হয়েছে। চরের কৃষকদের বিনা মূল্যে সার ও বীজসহ চাষাবাদে নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়।’
শেখ মহসীন/এসইউ/জিকেএস