যে কারণে মৌলভীবাজারে কমলা চাষে বিপর্যয়
মৌলভীবাজারে অনাবৃষ্টিতে ফুল ঝড়ে যাওয়ায় চলতি মৌসুমে কমলার ফলনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বাগানের জায়গায় সাফারি পার্ক নির্মাণের ঘোষণার পর থেকে চাষিরা হতাশায় বাগান পরিচর্যা করেননি আগের মতো। এতে আশানুরূপ ফলনও হয়নি।
মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা জুড়ী। এলাকার লাটিটিলা বনভূমির লালছড়া, রূপাছড়া, শুকনাছড়ার টিলায় টিলায় ছোট বড় কমলার গাছ। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে সবুজ কমলা।
কৃষি বিভাগ কমলা লেবুর ফলন বৃদ্ধির জন্য জাত পরিবর্তন করে হাতে নিয়েছে নতুন প্রকল্প। লাটিটিলার ৯৬ হেক্টর ভূমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এসব কমলার মধ্যে রয়েছে নাগপুরি, খাসি, ছাতকী, চায়নিজ কমলা। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে এর ব্যাপক চাষ হয় বলে ফলটির এ নামকরণ হয়েছে।
তবে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের লালছড়া গ্রামের কমলা চাষি মুর্শেদ মিয়ার বাগানে বিভিন্ন জাতের কমলা চাষ হচ্ছে। চলতি বছর বৃষ্টির পরিমাণ কম ও সাফারি পার্ক নির্মাণের ঘোষণায় চাষিদের মন বসেনি বাগান পরিচর্যায়। এতে আশানুরূপ ফলনও হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মুর্শেদের বাড়ির চারপাশে টিলার ঢালে সারি সারি কমলাগাছ। তবে আগের মতো গাছভর্তি ফল নেই। স্থানীয় জাতের কমলার পাশাপাশি সেখানে রয়েছে বেশ কিছু চায়নিজ কমলার গাছ। চায়নিজ কমলার গাছ ও ফল স্থানীয় জাতের চেয়ে আকারে ছোট।
ঘুরে ঘুরে বাগান দেখার ফাঁকে কথা হয় বঝি টিলার জালাল মিয়া ও শুকনাছড়ার রাজ্জাক মিয়া ও মুর্শেদ মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জাতের কমলার চাষ করছেন। তাদের বাগানে স্থানীয় জাতের কয়েকশ কমলাগাছ রয়েছে।
অনেক দিন আগ থেকে হায়ছড়া, লালছড়া, শুকনাছড়া, রুপাছড়া, জরিছড়া ও কচুরগুল গ্রামের লোকজন বিছিন্নভাবে নিজ উদ্যোগে কমলা চাষ করে আসছেন। ২০০১ সালের দিকে কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এ এলাকায় নতুন রূপে কমলা চাষ শুরু হয়। মুর্শেদ মিয়া সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার একটি নার্সারি থেকে কৌতূহলী হয়ে ১৮০টি চায়নিজ কমলাগাছের চারা কিনে আনেন। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাগান এসব চারা।
জালাল মিয়া বলেন, চায়নিজ কমলার একেকটি গাছে এক থেকে দেড় হাজার ফল ধরেছে। কার্তিক মাসের শেষ দিকে ফল পুরোপুরি পাকবে। তখন বিক্রি শুরু করবেন। স্থানীয় জাতের কমলায় রোগবালাই বেশি দেখা দেয়। তবে চায়নিজ কমলায় এখনো রোগবালাই দেখা দেয়নি।
জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে যেসব বাগান আছে সেখানে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে এ বছর বৈরী আবহাওয়ায় ফলন আগের মতো হয়নি। আব্দুল গফুর,মুর্শেদ মিয়াও জয়নুল মিয়ার বাগানের চায়নিজ কমলার ফলন সরেজমিনে দেখাশোনা চলছে।
তিনি আরও বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টির কারণে ফুল ঝড়ে গিয়ে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগ লেবুজাতীয় ফসল সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনা উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পে স্থানীয় জাতের ফসল বারি কমলা-১ বারি কমলা-৩ ও দার্জিলিং কমলার চারা উৎপাদন করে কমলাচাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
মুর্শেদ মিয়া বলেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে ফলটির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করি। ছোট আকারের কমলার জন্ম চীনে। সে কারণে বাজারে এটা চায়নিজ কমলা নামে পরিচিত। স্থানীয় জাতের চেয়ে চায়নিজ কমলা মিষ্টি বেশি। ফলে অনেকেই সেটা পছন্দ করে। কৃষি বিভাগ নতুন জাতের চারা দিয়েছে আমরা রোপণ করেছি। কমলার ফলন ভালো না হলেও বাজারে দামে বিক্রি করতে পারলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
কমলা চাষি মানিক মিয়া ও তার স্ত্রী ছালেহা বেগম বলেন,আর কিছুদিন পরেই দেশি জাতের কমলা বাগানের গাছ থেকে সংগ্রহ হবে। এসব কমলা পাইকারদের কাছে বিক্রি হবে। এ বছর খরায় ফুল ঝড়ে গেছে। তারপর অসময়ে বেশি বৃষ্টিতে অনেক গাছ উপড়ে পড়েছে। সাফারি পার্ক নির্মাণ করা হবে এই শঙ্কায় আছি আমরা।
সব মিলিয়ে কমলার অবস্থা আগের মতো নেই। তিনি আরও বলেন, সাফারিপার্ক নির্মাণের খবর শুনে হতাশায় এলাকার মানুষ কমলার পরিচর্যা ছেড়ে দিয়েছেন। কমলার বাগান থাকবে কি? না, আমরা থাকব কি? না, এমন ভাবনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা। তাদের দুটি কমলাবাগানে ৩০০ গাছ রয়েছে। ফলন সম্পর্কে জানতে চাইলে ছালেহা বললেন, ‘এইবার কমলার ফুল ঝড়ে যাওয়ার পরও মোটামোটি ফল আসছে।’
এলাকাবাসী জানান, লালছড়ার আশপাশের হায়ছড়া শুকনাছড়া, রুপাছড়া, জরিছড়া ও কচুরগুল গ্রামের টিলায় টিলায় রয়েছে কমলার বাগান। বিপর্যয়ের পরও বিভিন্ন বাগানে এবার আশানুরূপ না হলেও কমলার মোটামুটি ফলন হয়েছে।
চাষিরা জানান, এখানকার কমলা দেশি জাতের। আকারভেদে ১০০ কমলা ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়। সিলেট, কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও চট্টগ্রামের ফলের আড়তদারেরা এখান থেকে কমলা কিনে নেন। এখানে বছরে কোটি টাকার কমলা বেচা-কেনা হয়।
বানর ও কাঠবিড়ালি ফল নষ্ট করে ফেলে। সে কারণে পুরোপুরি পাকার আগেই চাষিরা কমলা পেড়ে বিক্রি করে ফেলেন।
জেলার ১৫৪ হেক্টর টিলাভূমিতে কমলার চাষ হয়। গাছের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। ব্যক্তি মালিকানাধীনসহ বাগান আছে ১৯৩টি।
মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, কমলা চাষিদের উৎসাহিত করেছেন। সাময়িক সমস্যার পরও আশানুরূপ ফলন হয়েছে। কমলা চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তাই নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে জুড়ী, বড়লেখা, কুলাউড়া উপজেলায়। কমলা চাষিদের আমরা পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছি।
আব্দুল আজিজ/এমএমএফ/জিকেএস