পাখির ছানা খেয়ে ফেলা রাক্ষুসে ইঁদুর
পাখির ছানা খেয়ে সাবাড় করছে একদল রাক্ষুসে ইঁদুর। এই ইঁদুরের উপদ্রবে পাখিদের কয়েকটি প্রজাতি আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। মানুষ এই বিশাল আকৃতির ইঁদুর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। রাক্ষুসে ইঁদুর বিনাশ করার উপায় বের করা নিয়ে বিজ্ঞানী ও প্রশাসন এখন খুবই চিন্তিত।
দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে, কেপ টাউন থেকে ১৫ শ মাইল অদূরে অবস্থিত সামুদ্রিক পাখির বসবাসের সবচেয়ে বড় দ্বীপের নাম গফ আইল্যান্ড। এই আইল্যান্ডকে জুরাসিক পার্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এখানে লাখ লাখ সাগর পাখি বসবাস করে। প্রতিবছর কমপক্ষে দশ লাখ আলবাট্রোস, পেট্রেল এবং শিয়ার ওয়াটার নামক পাখি জন্ম গ্রহণ করে। দ্বীপটি বিশ্বের বুকে ঐতিহ্যবাহী দ্বীপ হিসেবে ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের সন্মাননা অর্জন করেছে ।
দক্ষিণ আটলান্টিকের সাগরের পাখির কলোনি খ্যাত এই গফ আইল্যান্ডে ২২ প্রজাতির সাগর পাখি এবং দুই প্রজাতির সাধারণ গাছ পাখি বাস করে। এখানে আলবাট্রোস পাখির শরীরের আয়তন থেকে অনেক বড় ত্রিসতান আলবাট্রোস নামক প্রজাতির পাখি বিশ্বে শুধু এখানেই দেখা যায়। এই পাখির ছোট ছোট বাচ্চা, ডিম খেয়ে সাবার করছে রাক্ষুসে খাদক, প্রকাণ্ড সাইজের সব ইঁদুরগুলো।
ইঁদুরগুলো স্বাভাবিক ইঁদুর থেকে ৫০ শতংশ বড়। ড্রোন ভিডিও চিত্র পরীক্ষা করে ২০২০ সালে প্রথম বিজ্ঞানীরা দেখেন সাগর পাখির বাচ্চাগুলো কিভাবে ধ্বংস করছে রাক্ষুসে ইঁদুর? ইঁদুরগুলো এমনই শক্তিশালী রাক্ষুসে যে, ইঁদুরের নিজেদের শরীরের চেয়ে বড় বড় প্রাণি শিকার করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এই রাক্ষুসে ইঁদুর ধ্বংস করা না হলে অচিরেই সাগরের পাখির বংশ নির্বংশ-ধ্বংস হয়ে যাবে।’
ধারণা করা হয়, উনিশ’শ শতকের আগে নাবিকদের মাধ্যমে গফ আইল্যান্ডে প্রথম ইঁদুর আসে। তাই উনিশ’শ শতকে যখন মাছ শিকারের জাহাজের আসা বন্ধ করা হয় তখন থেকেই এই সামুদ্রিক পাখিগুলো রক্ষা পাচ্ছিলো শিকারীদের হাত থেকে। কিন্তু ততোদিনে জাহাজের সঙ্গে কয়েক’শ রাক্ষুসে ধারী ইঁদুর এই দ্বীপে ঢুকে বংশ বৃদ্ধি করায় এই বিপত্তি ঘটেছে।
রাক্ষুসে ইঁদুর এখন পুরো আইল্যান্ড দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশিরভাগ ইঁদুরই এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে নতুন খাবারের উৎস। তাই যখনই কোনো গাছের কোটরে তারা পাখির ছানার সন্ধান পেয়ে যায়, তখনই মিটে যায় তাদের খাবারের সমস্যা।
গফ আইল্যান্ডের আয়তন লম্বায় আট কিলোমিটার ও চওড়ায় ছয় কিলোমিটার। সমুদ্রের উকূলবর্তী এই দ্বীপে বাস করে সাগরের শান্তি কপোত নামে পরিচিত আলবাট্রোস পাখি। এই দ্বীপের গাছের কোটরে এই পাখি বাসা বাঁধে এবং প্রজনন মুহূর্তে ডিম পেড়ে বাচ্চা জন্ম দেয়। আলবাট্রোসের ছানাগুলো প্রায় আটমাস ধরে খাবারের জন্য তাদের বাবা-মার প্রতীক্ষা করে।
এই ছানাগুলো একেকটি ইঁদুরের চেয়ে প্রায় আড়াই’শ গুণ বেশি ওজন সম্পন্ন। ছানাগুলো লম্বায় আধা মিটার। তা সত্বেও বিশাল আকৃৃতির ইঁদুরের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার মতো মোটেও শক্তি বা ক্ষমতা নেই ওদের। একসঙ্গে দশ বারোটি রাক্ষুসে ইঁদুর যখন এদের একেকটিকে আক্রমণ করে তখন আলবাট্রোস পাখির ছানাগুলোর কিছুই করার থাকে না। আলবাট্রোস পাখির ছানাগুলো ইঁদুরের পেটে চলে যায় খাবার হয়ে।
এমনিতেই পৃথিবী থেকে আলবাট্রোস পাখির অস্তিত্ব প্রায় হুমকির সন্মুখীন। প্রতিবছর মাছ ধরা নৌকার জেলেরা প্রায় এক লাখ আলবাট্রোস পাখি শিকার করে। শিকারীদের এ অঞ্চলে আসা নিষিদ্ধ করা হলেও ইঁদুরের হাত থেকে পাখি রক্ষা করার কোনো উপায় পাচ্ছে না দ্বীপটির রক্ষা কমিটি। সে কারণে এই আলবাট্রোস পাখির আর মাত্র কয়েকটি প্রজাতি কোন মতে এ দ্বীপে বেঁচে রয়েছে।
গফ আইল্যান্ডের এই রাক্ষুসে ইঁদুর ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের ছয়টি উপসাগরীয় অঞ্চলের বন্যপ্রাণিদের জন্যেও ভয়ানক ভয়ের সৃষ্টি করেছে। এই ইঁদুর কিভাবে বিনাশ করা যায় সে ব্যাপারে উপায় বের করার জন্য রয়েল সোসাইটি সর্ব সাধারণের সাহায্য কামনা করেছে।
এজন্যে বাষট্রি হাজার পাউন্ড অর্থ বিশেষ পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যিনি ইঁদুর নিধন করতে উপায় বের করতে পারবেন তার ভাগ্যেই জুটবে এই পুরস্কারের অর্থ। ড. রিচার্ড কাবার্ট নামের এক জীববিজ্ঞানী ইতোমধ্যে উপায় বের করেও ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডে ইতিপূর্বে এই জাতীয় ইঁদুর নিধনের জন্যে বিষ ব্যবহার করা হয়েছিলো।’
তিনি বলেন, ‘ইঁদুর মারতে বিষাক্ত বড়ি হেলিকপ্টার থেকে গফ আইল্যান্ডে ফেলা হবে। এই বড়ি অন্য কোনো পাখি বা প্রাণি খায় না। যা শুধু ইঁদুরে খায়।’
বিজ্ঞানী ড. রিচার্ড কাবাট বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে, এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন দ্বীপে ক্ষতিকর প্রাণি কীটপতঙ্গ নিধন করা হয়।’ তাই বিষ ব্যবহারের বিষয়টি ভেবে দেখার আহবান জানান তিনি। ‘এই ইঁদুরের মধ্যে নানাবিধ রোগ ব্যাধি ছড়িয়ে দিলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইঁদুরের বংশ নির্বংশ করা সম্ভব হতে পারে’ বলেও তিনি জানান।
গফ আইল্যান্ডের রাক্ষুসে ইঁদুর থেকে পাখি বাঁচাতে ইঁদুর নিধনের বিষ কিনতে আর্থিক সাহায্যের জন্য গঠিত হয়েছে চ্যারিটি ফান্ড। ইঁদুর মারতে পাখি বাঁচাতে যে কোন ব্যক্তি এই ফান্ডে আর্থিক সাহায্য দিতে পারেন। হয়তো এভাবেই একদিন ধ্বংস হবে রাক্ষুসে ইঁদুর। বেঁচে যাবে গফ আই্যান্ডের বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির সাগরের লাখ লাখ শান্তির কপোত আলবাট্র্রোস পাখি।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এমএমএফ/এএসএম