‘হিটশক’ এড়াতে নজর প্রতিরোধী ধানের জাতে
ক্রমাগত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশের কৃষিতে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ ‘হিটশক’। গত ৪ এপ্রিল হাওরাঞ্চলসহ দেশের ৩৬ জেলায় গরম বা লু হাওয়াজনিত এ হিটশকে বোরো ধানের ৬৮ হাজার ১২৩ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্য এ বছর কমপক্ষে লাখ টন ধানের ক্ষতি হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আগেও হিটশক হয়েছে, তবে এতো বেশি ক্ষতি হয়নি কখনো। এখন ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় আগামীতে এ সমস্যা আরও বাড়বে।
হিটশকের পরবর্তী বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনকে একমাত্র কার্যকর উপায় হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) একটি বিশেষজ্ঞ দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পর্যবেক্ষণের পর বলছেন, ‘উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন জোরদারকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। হাইব্রিড জাত অনুমোদনের ক্ষেত্রে স্বল্প ও মধ্যম জীবনকাল এবং উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন জাতগুলো অনুমোদনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ব্রি’র কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম (গত ৬ এপ্রিল) হিটশকে পুড়ে যাওয়া মাঠগুলো পরিদর্শন করেন। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশিক ইকবাল খান এবং উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান।
গত বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) নজমুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্ষতি মোকাবিলা ও সম্ভাব্য প্রতিকারের জন্য আমরা কয়েকটি সুপারিশ করেছি। সাধারণত বছরের ওই সময়টায় কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এবং তাপপ্রবাহ হয়, যেগুলো প্রতিরোধের উপায় নেই। তাই উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন সবচেয়ে ভালো উপায়।’
‘এছাড়া আগাম উচ্চ ফলনশীল ও ব্রি ধান২৮-এর জীবনকালের সমান জীবনকালের হাইব্রিড জাতের বপন সময় সম্ভব হলে এক সপ্তাহ এগিয়ে অথবা পিছিয়ে এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে যেন এর ফুল ফোটার এবং দানা গঠন সময়কালে এ জাতীয় দুর্যোগ কম হয়।’
নজমুল বারী বলেন, ‘আমরা দেখেছি তাপমাত্রা সহনশীল ধানের উৎপাদন জনপ্রিয় ব্রি ২৮-এর চেয়েও বেশি। ফলে এসব ধান এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিনের বৃষ্টিহীন উচ্চ তাপপ্রবাহ এই হিটশকের কারণ। অতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে, তীব্র দাবদাহে ধানগাছও এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেটাকে হিটশক বলা হয়। দীর্ঘ অনাবৃষ্টি এবং দাবদাহের কারণে এ বছর সমস্যাটি দেখা দিয়েছে। যা বিশ্বের জলবায়ু প্রভাবের নতুন অভিঘাত।
দেশে জনপ্রিয় ব্রি ২৮-এর ফলন
কৃষি মন্ত্রণালয় হিটশকে ক্ষতির যে হিসাব করেছে তাতে দেখা গেছে, হিটশকে বোরো ধানের মোট আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ১২৩ হেক্টর। যার মধ্যে ১০ হাজার ২৯৮ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। বাকিটুকুতে আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ফলে এ বছর উৎপাদন কমপক্ষে এক লাখ টন কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ৩৬টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই হিটশকে ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, সবজি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ও কলার ফলনও নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে টাকার অংকে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটি টাকার বেশি। এতে সারাদেশের তিন লাখ ১০ হাজার কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ব্রি’র ওই পর্যবেক্ষণ টিমের অন্য সদস্য সাজ্জাদুর রহমান ২০১২ সাল থেকে হিটশকের তথ্য রাখছেন। তিনি বলেন, ‘এ বছরের আগে যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে হিটশক হয়েছে। তবে সেটা গ্রামের এক-দুইটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। এতো বড় হিটশক এটাই প্রথম। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যত বাড়বে, এ সমস্যা ততই বাড়তে থাকবে।’
ব্রি জানিয়েছে, ধান গাছ বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা নানা মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে। অঙ্গজ বৃদ্ধির পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা তেমন ক্ষতিকর প্রভাব না ফেললেও প্রজনন পর্যায়ে তা (>৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ফলনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শীষ বের হওয়ার নয়দিন আগে তাপমাত্রা ৩৫-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ফুল ফোটা ও পরাগায়নের সময় ১-২ ঘণ্টা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হলে সাদা শীষ, সাদা স্পাইকলেট, শীষে স্পাইকলেটের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং চিটা সমস্যার কারণে ধানের ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া ধানের পরিপক্কতার পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা (>৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) দানা গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এ সময় তাপমাত্রা বেশি হলে অর্ধপুষ্ট দানার সংখ্যা বাড়ে, যা ধানের ফলন ও গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সংস্থাটি বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে তেমন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছিল। সঙ্গত কারণে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ৪ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিহীন তীব্র দাবদাহ বয়ে যায়। যেসব এলাকার ওপর দিয়ে এ দাবদাহ বয়ে গেছে এবং জমির ধান ফুল ফোটা পর্যায়ে ছিল, সেসব এলাকায় ধানের শীষ শুকিয়ে যায়। বৃষ্টিহীন তীব্র দাবদাহে বাতাসের তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। ফলে সেগুলোর পরাগ রেণু শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে গেছে। তবে ঢাকা-গাজীপুরসহ বেশকিছু স্থানে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি থাকায় এসব স্থানে তাপমাত্রা দ্রুত কমে যায় এবং ফলনে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
২০১৩ সাল থেকে চলছে উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের গবেষণা
আশার খবর হচ্ছে, আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ২০১৩ সাল থেকে উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের গবেষণা শুরু করে ব্রি। উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু এন২২ জাতের সঙ্গে বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় আধুনিক জাত ব্রি ধান-২৮-এর সংকরায়ণ করে মার্কার অ্যাসিসটেড ব্যাক ক্রসিং পদ্ধতির মাধ্যমে একটি অগ্রগামী সারি নির্বাচন করা হয়েছে, যা মধ্যম মাত্রার উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল।
২০১৩ সাল থেকে দেশে চলছে উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা
জানা গেছে, সারিটি বর্তমানে আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষণ পর্যায়ে রয়েছে। ফলন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হলে এটিকে জাত হিসেবে অনুমোদনের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডে আবেদন করা হবে। জাত হিসেবে অনুমোদিত হলে ফুল ফোটা পর্যায়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেও সারিটি আশানুরূপ ফলন দিতে পারবে। এছাড়া ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে আরও ১৬টি উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল সারি অগ্রগামী করা হচ্ছে।
পাশাপাশি ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে আরও ৭২টি উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল সারি বিসি৩এফ৭ নামের জেনারেশনে আছে। ব্রি ধান-৪৮ ও ব্রি ধান-৫৮-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল সারি বিসি২এফ১ জেনারেশনে আছে। ব্রি ধান-৬২-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল সারি বিসি১এফ১ জেনারেশনে রয়েছে।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘অচিরেই দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবে ব্রি।’
এদিকে উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল এসব জাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারও। ১৮ এপ্রিল ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু ধানের জাত এবং এ-সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য আকস্মিকভাবে গবেষণা মাঠ পরিদর্শন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। পরের দিন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম ওই ধানের প্লটসমূহ পরিদর্শন শেষে ব্রির সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন।
পরিদর্শনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ভবিষ্যতে যেন দেশের মেহনতি কৃষক ভাইদের এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্যই উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল এবং রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধক উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে।
এনএইচ/এইচএ/এমএস