খুবিতে বেগুনি ক্যাপসিকাম চাষে সাফল্য
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ গবেষণা কেন্দ্রে চলতি মৌসুমে মাঠ পর্যায়ে কম খরচে পোকা ও ভাইরাসমুক্ত নিরাপদ রঙিন ক্যাপসিকাম চাষের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। মালচিং ও জৈব প্রযুক্তি অনুসরণে আশানুরূপ ফলন পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে একবার ফল তোলা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারও ফল ধরেছে। এই গবেষণা প্রকল্পের মাঠে এখন ক্যাপসিকাম গাছে বেগুনি, হলুদ ও সবুজ তিন ধরনের ফল শোভা যাচ্ছে।
প্রতিটি গাছে ৪-১০টি পর্যন্ত ক্যাপসিকাম ঝুলে আছে। চলতি সপ্তাহেই দ্বিতীয় পর্যায়ের ফল সংগ্রহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আকর্ষণীয় বেগুনি রঙের ক্যাপসিকাম দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে এবারই প্রথম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা মাঠে চাষ করা হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণার মূল লক্ষ্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে থ্রিপস বাহিত ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করে ক্যাপসিকাম উৎপাদন। গবেষণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার দাশ। একই ডিসিপ্লিনের মাস্টার্সের ১ম বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আলম এ কাজের গবেষণা সহায়ক হিসাবে কাজ করছেন।
প্রধান গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক বলেন, মাঠ পর্যায়ে ক্যাপসিকাম চাষের প্রধান অন্তরায় হলো থ্রিপস পোকার আক্রমণ। এই থ্রিপস মরিচ গোত্রের সবজির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। এই পোকা পাতার নীচে থাকে ও ভাইরাসের বাহক হিসাবে কাজ করে। এই ভাইরাসের আক্রমণ হলে গাছের কচিপাতা হলুদ হয়ে কুকঁড়ে যায় ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
এই ভাইরাস দ্বারা এটি ছড়ায় ও অতি অল্প সময়ে এটি সমস্ত মাঠে ছড়িয়ে পড়ার খুবই সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ভাইরাস রোগের কোনো প্রতিশোধক নেই ও ভাইরাস প্রতিরোধী ক্যাপসিকামের জাত বিশ্বে এখনো উদ্ভাবন হয়নি।
কিন্তু আগাম সতর্কতা হিসাবে মাটি ও বীজ শোধন এবং পরিষ্কার চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এছাড়া অল্পসংখ্যক গাছে রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মাটিসহ গাছ তুলে ফেলে দূরে কোন গর্তে মাটি চাপা দিয়ে রাখতে হয়। মাঠ পর্যায়ে জৈব উপায়ে কার্যকরী থ্রিপস দমনের পদ্ধতি নির্বাচনই ছিল এই গবেষণার মূল লক্ষ্য। এই গবেষণায় থ্রিপস পোকা দমনের জন্য ক্যায়োলিন ক্লে ও নিমের তৈল জৈব বালাইনাশক হিসাবে ১০ দিন পর পর ছিটানো হয়।
ক্যায়োলিন ক্লে, একটি অর্গানিক ক্লে পার্টিকেল যা এ্যালোমিনিয়াম ও সিলিকন সমৃদ্ধ। এই দ্রব্যের বাণিজ্যিক নাম সারাউন্ড। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় এই ক্লে পাউডার ব্যবহার করেছেন- যেমন গাছের তাপ নিয়ন্ত্রণ, ফলকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা ও বিভিন্ন পোকা (থ্রিপস, মাইটস) দমন ইত্যাদি বিষয়ে যেখানে বিজ্ঞানীরা খুবই ভালো ফল পেয়েছেন। যদিও বাংলাদেশের গবেষণায় ইতোপূর্বে এটি ব্যবহৃত হয়নি।
এটি অর্গানিক পাউডার হওয়ায় বাণিজ্যিক চাহিদা ও খুব বেশি। এটি পানিতে দ্রবণীয় এবং সাধারণ ব্যাকপ্যাক স্প্রেয়ার দিয়ে ছিটানো যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন সোর্স ও সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতে এই পাউডার পাওয়া যায়। এটি ছিটালে গাছ ও প্লাস্টিক মাল্চ পেপার সাদা হয়ে যায়। ক্যায়োলিন ক্লের সাদা রঙ সূর্য়ের তাপে প্রতিফলনের প্রভাব কাজে লাগিয়ে গাছকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া গাছের কাণ্ডে আলোর তীব্রতা বাড়ায় যা গাছের সালোক- সংশ্লেষণ বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া এ গবেষণায় নিমের তেলের ব্যবহার করা হয়েছে যার জৈব চাষ পদ্ধতিতে বাংলাদেশে বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেহেতু ক্যাপসিকামের সম্পূর্ণ অংশ খাওয়া হয় সেহেতু রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করলে সাধারণ মানুষ এই সবজিটি বেশি পছন্দ করে থাকে।
এ বিষয়টি মাথায় রেখেই মাঠ পর্যায়ে নতুন এই জৈব ক্যাপসিকাম চাষ পদ্ধতির কথা চিন্তা করেন প্রধান গবেষক। এই মাঠে তিন রঙ এর (সবুজ, বেগুনি, হলুদ ও বেগুনি) ক্যাপসিকাম গাছের বৃদ্ধি ও ফলনের তুলনামূলক গবেষণা চালানো হয়। বেগুনি রঙ এর ক্যাপসিকাম এই তিন রঙ এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলন দেয়। যার বাজার মূল্য অন্যান্য সবজির চেয়ে অনেক বেশি (প্রতি কেজির দাম প্রায় ২৫০-৩০০ টাকা)।
গবেষক বলেন, এই মাঠে একটি গাছে সর্বোচ্চ ২০-২৫টি ফল হয় এবং একটি ফলের ওজন প্রায় ৮০-১৪০ গ্রাম যা মানসম্মত ওজন। তিনি বলেন, বাজারে সবুজ, লাল ও হলুদ ক্যাপসিকাম দেখা মিললেও বেগুনি রঙ এর ক্যাপসিকাম তেমন চোখে পড়ে না। এজন্য আর্কষণীয় রঙিন সবজি হিসাবে বাজারে এর প্রচুর চাহিদা আছে। ক্যাপসিকাম সাধারণত সালাদ, মিক্সিড সবজি ও চাইনিজ রান্নায় এর বহুবিধ ব্যবহার হয়। দাম বেশি হওয়ায় বেগুনি রঙ এর ক্যাপসিকাম চাষ করার জন্য দক্ষিণাঞ্চলের সবজি চাষিরা খুবই আগ্রহী হবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। কিন্তু চাষিদেরকে সঠিক চাষ পদ্ধতি জানানো খুবই প্রয়োজন বলে গবেষক মনে করেন।
ড. প্রশান্ত কুমার দাশ বলেন, ক্যাপসিকাম ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভালো ফলে। এই জন্য শীতকালে গাছের বৃদ্ধি, ফুল ধারণ ও ফলন ভালো হয়ে থাকে। তিনি উল্লেখ করেন ক্যাপসিকামের জাত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বীজ শোধন করে প্লাস্টিক সেল ট্রেতে কোকোডাস্টসহ চারা উৎপাদন করলে ভালো সতেজ চারা পাওয়া যাবে বলে আশা করেন।
গবেষক বলেন ৩ মিটার দৈর্ঘ্যরে, ১ মিটার প্রস্থ ও ০.২ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন বেড তৈরি করে ০.২৫ মিলিমিটার পুরুত্বের উপরে সাদা ও নিচে কালো রঙ এর প্লাস্টিক মাল্চ বেডের উপরে ব্যবহার করলে গাছের সঠিক বৃদ্ধি ও পরিষ্কার চাষ পদ্ধতির নিশ্চয়তা দেয়া যেতে পারে। রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ০.৮ মিটার ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ০.৫ মিটার অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। প্লাস্টিক মালচ ব্যবহার করলে বহুবিধ উপকার পাওয়া যেতে পারে যেমন আগাছা দমন, মাটির সঠিক আর্দ্রতা বজায় রাখা ও গাছের ডগায় আলোর তীব্রতা বাড়ানো ইত্যাদি।
প্রধান গবেষক আশা করেন, জৈব প্রযুক্তি অনুসরণ করে মাঠ পর্যায়ে বেগুনি রঙ এর ক্যাপসিকাম চাষ করলে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে এক নতুন সম্ভাবনা হতে পারে। এছাড়া চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান এবং পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণে অনেকাংশেই সক্ষম হবেন। ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বেগুনি ক্যাপসিকাম জৈব সবজি হিসেবে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
আলমগীর হান্নান/এমএমএফ/এএসএম