বাকৃবিতে ক্ষতিকর শামুকের প্রাদুর্ভাব, হুমকির মুখে কৃষি
শামুক নামের প্রাণীর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। ছোট-বড় সবাই শামুক সম্পর্কে কম-বেশি জানি। শামুক হচ্ছে মোলাস্কা (mollusca) পর্বের অন্তভুক্ত। এরা নরমদেহী এবং প্রাপ্তবয়স্কদের দেহ একটি প্যাঁচানো খোলকে আবৃত থাকে। সাধারণত শামুক বলতে স্থলচর, সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির শামুককে বোঝায়। মরুভূমি, নদী ও স্রোতস্বিনী, বদ্ধ জলাশয়, জলাশয়, সমুদ্র উপকূলসহ অনেক আবহাওয়াতে শামুকের দেখতে পাওয়া যায়।
ধানের জমিতে শামুকের ডিম খেয়ে ইঁদুর তার পেটপূর্তি করায় ধান নষ্ট করা থেকে বিরত থাকে। প্রাকৃতিক ও দেশীয় মাছের প্রধান খাদ্য হচ্ছে শামুকের ডিম ও মাংস। বিশেষ করে কৈ, শিং, মাগুর, ট্যাংরা, টাকি, শোল মাছের ডিম থেকে সদ্যোজাত পোনার একমাত্র খাদ্য হচ্ছে শামুকের নরম ডিম। আর এ খাবার না পেলে ওই পোনা মারা যায়। শামুকের খোলসের ভেতরের নরম অংশ চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হওয়াতে দক্ষিণাঞ্চলের ঘের মালিকেরা শামুক কিনে নিয়ে যায়।
ম্যাচোফেলিয়া ও মাইক্রোফেলিয়া নামে দুধরনের কীট শামুক থেকে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। ওই দুটি কীট ধান গাছের ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি ক্ষেতের ব্যাপক উপকার করে থাকে। অপরদিকে শামুক নিঃসৃত পানির রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। শামুক দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে চুন এমনকি হাঁসের খাবারও জোগান দেয়া হয়।
শামুক হচ্ছে প্রাকৃতিক ফিল্টার। শামুক পরিবেশের বিশেষ বন্ধু হিসেবে পরিগণিত। শামুক মরে গিয়ে তার মাংস ও খোলস পঁচে জমির মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশ তৈরি করে। ফলে জমির ঊর্বরতা বৃদ্ধিসহ ধানগাছের শিকড় মজবুত ও ফসল অধিক হতে সাহায্য করে। শামুক নিরীহ জলজ প্রাণী হওয়ায় সহজেই একে কুড়িয়ে নেয়া যায়।
কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) নিরীহ এ প্রাণীটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। বিচিত্র নতুন প্রজাতির এ শামুকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু ছড়িয়েই পড়েনি, হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবস্থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ নাজমুল আহসান হলের বাগান মালিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর শীতকে সামনে রেখে হলের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বিভিন্ন রকম ফুলের গাছ রোপন করে তারা। কিন্তু তারা জানান, এবছর এই শামুক গাদা, জিনিয়া, সিলভিয়, বাগানবিলাস, ক্যাকটাসসহ বিভিন্ন গাছের কচি পাতা খেয়ে ফেলছে। কোনো গাছই কোনোভাবে টেকানো যাচ্ছে না। এমনকি হলের নোটিশ বোর্ডে টানানো কাগজও খেয়ে ফেলছে। আর একবার কোনে গাছ আক্রমণের শিকার হলে সে গাছকে বাচানো যাচ্ছে না।
শামুকটি সম্পর্কে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ সালাম জানান, এটি হচ্ছে আফ্রিকান জায়ান্ট ল্যান্ড স্নেইল। বিদেশিদের আগমনের সময় এটি হয়তো আমাদের দেশে এসে থাকবে। ২০০২ সালে শ্রীমঙ্গলে ব্রিটিশদের একটি রেস্টুরেন্টে আমি এটা প্রথম দেখতে পাই। ফসল ও বাগানের ক্ষতি করে বলে সে সময় তারা এদের ধরে ধরে পুড়িয়ে ফেলত কিংবা মেরে ফেলত।
কিন্তু এরপর এদের তেমন আর দেখা যায়নি। এরা ফসলের জন্য খুব ক্ষতিকর। বাগান নষ্ট করে ফেলে। সন্ধ্যা হলেই ঝাকেঝাকে বের হয়ে আসে। আর দিনের বেলা অত্যাধিক সূর্যালোক থেকে বাচতে লুকিয়ে থাকে। অতি বৃষ্টির সময় এরা দালানের দেয়ালে বেয়ে উপরে উঠে আশ্রয় নেয়। এর মাংস খুবই শক্ত বিধায় পশু-পাখিরাও খেতে চায় না।
আমাদের দেশীয় যে শামুক আছে সেটি উপকারী এবং তারা স্থলভূমিতে উঠে আসে না, বরং পানিতেই থাকে। কিন্তু এটি গাছপালা, লতাপাতা, ফলমূল খেয়ে ধ্বংস করে। এমনকি দিনের বেলা অনেক গাছের যেমন-পেঁপে মাথায় উঠে গাছের পাতা খেয়ে গাছ ধ্বংস করে। যা আমাদের দেশের কৃষির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এটা নিয়ে গবেষণাও করা যেতে পারে।
এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কী করণীয় জানতে চাইলে ড. সালাম জানান, এটিকে স্বমূলে নির্মূলের জন্য এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং যেভাবেই হোক এর প্রজনন ও বৃদ্ধি প্রক্রিয়া নষ্ট করতে হবে। এর উপকারিতা বলতে কিছু নাই। একে ধ্বংস করার জন্য অনতিবিলম্বে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। অন্যথায় এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যাবে। হুমকির মুখে পড়বে গোটা দেশের কৃষি ব্যবস্থা।
এসএম আশিফুল ইসলাম মারুফ/বিএ