দেশে ১১ প্রজাতির নতুন প্রাণীর সন্ধান
ছয় বছর ধরে চলা দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে নতুন ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে ১১ প্রজাতির অস্তিত্ব বাংলাদেশে নতুন।
২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চলা ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্সে’র উদ্যোগে এবং ক্যারিনাম ও বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উভচর ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর ওপর এক গবেষণার তথ্য সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র চেকলিস্টে প্রকাশ হয়েছে।
গবেষক দল ও বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ডেলটা স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. এ এইছ এম আলি রেজা তার এক গবেষণায় ২০১০ সালে লাউয়াছড়ায় ৪৫ প্রজাতি সরীসৃপ এবং ১৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী পান। কিন্তু নতুন গবেষণায় ৫১ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০ প্রজাতির উভচর প্রাণী শনাক্ত করা হয়। নতুন পাওয়া সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীর মধ্যে ১১টি বাংলাদেশে নতুন, এদের বাংলা নাম এখনো দেয়া হয়নি। তাদের নাম দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
গবেষক দলের প্রধান বন্যপ্রাণী গবেষক শাহারিয়ার রহমান সিজার জানান, আগের গবেষণায় ২৩ প্রজাতির যেগুলো লাউয়াছড়ায় আছে বলে ভাবা হতো, সেগুলো আমাদের গবেষণায় ধরা পড়েনি। সেগুলো ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছে মনে হয়েছে। এ কারণে সেগুলো আমরা তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। যেহেতু আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছি, তাই যা পেয়েছি তা-ই শুধু যুক্ত করেছি।
নিজেদের গবেষণাকে আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রতিটি প্রজাতিকে স্বচক্ষে দেখে তাদের দেহের বিভিন্ন মেজারমেন্টসহ যাবতীয় তথ্য নিয়ে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছি। এখানে ছবি দেখে কোনো অনুমাননির্ভর তথ্য আমরা যুক্ত করিনি। আগে যে কাজ হয়েছে সেখানে এত দীর্ঘমেয়াদি সময় হয়তো ছিল না, তাই প্রতিটা প্রজাতিকে আলাদাভাবে শনান্ত করা যায়নি।
সিজার আরও জানান, এ গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও তার আশপাশের এলাকার উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন করা। উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীরা পরিবেশের নানা রকমের পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীল। এছাড়া এই দুই শ্রেণির প্রাণীর মধ্যে অনেকের অবস্থান খাদ্য শৃঙ্খল একেবারে নিচের দিকে। আবার কিছু আছে যাদের অবস্থান খাদ্য শৃঙ্খলের খানিক উপরের দিকে। কাজেই কোনো একটা প্রতিবেশ ব্যবস্থায় নিচের দিকের প্রাণীরা যদি দূষণ বা অন্যান্য মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্তের সম্মুখীন হয়, তখন তা কার্যত পুরো প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
মাত্র ১২.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জাতীয় উদ্যানের আশপাশে রয়েছে চা বাগানসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আবাসস্থল। লাউয়াছড়া উদ্যানে প্রতি বছর লক্ষাধিক পর্যটকের যাতায়াত। এছাড়া নিয়মবহির্ভূত গাছ কাটার কারণে এ বনের প্রাকৃতিক আবহ ক্রমশই পরিবর্তিত হয়ে পড়ছে কৃত্রিমতার বেড়াজালে।
গবেষকরা জানান, ২০১১ সালে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের অধীনে এই বনে অজগর সাপের ওপর গবেষণা শুরু হলে, গবেষক দলের সামনে উঠে আসতে থাকে এই উদ্যানের জীববৈচিত্র্যের নানা ক্ষেত্র। মূলত অজগর সাপের আবাসস্থল খোজাকালীন লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার ওপর মরে থাকা উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীর দেহাবশেষ পাওয়ার মধ্যে দিয়ে এ গবেষণার যাত্রা শুরু।
বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে পরে অজগর ও কচ্ছপের ওপর শুরু হওয়া মূল গবেষণা কাজের পাশাপাশি বনের ভেতরে পাওয়া উভচর ও সরীসৃপ প্রাণীর ছবি এবং তাদের দৈহিক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে লাউয়াছড়ার প্রাণীগুলোর তথ্য সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে লাউয়াছড়ার আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে সাপ বা গিরগিটিজাতীয় প্রাণী ধরা পড়লে সংস্থার পক্ষ থেকে বন বিভাগের সহযোগিতায় তা উদ্ধার করে জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হতো। সেই তথ্যগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে বর্তমান তালিকায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পরিচালিত আগের যে গবেষণা কাজ ছিল সেগুলোর ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যার কারণে অনেক প্রজাতি ভুলভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বিশেষ করে ব্যাঙ ও গিরগিটি/টিকটিকি জাতীয় প্রাণীদের ক্ষেত্রে তাদের দেহের বিভিন্ন তথ্য (হাত-পায়ের দৈর্ঘ্য, স্কেল থাকলে তার সংখ্যা ইত্যাদি) সঠিকভাবে প্রজাতি নিরূপণের জন্য নেয়া প্রয়োজন, যা বর্তমান গবেষণাপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যদিও এই ধরনের প্রাণীদের ক্ষেত্রে ডিএনএ ভিত্তিক গবেষণা আরও সঠিক তথ্য দিতে পারে। তবে এই যেহেতু গবেষণা কাজের জন্য কোনো জীবিত প্রাণীর দেহ থেকে কোনো নমুনা নেয়ার অনুমতি ছিল না, তাই এই ডিএনএ ভিত্তিক গবেষণা এখানে করা হয়নি।
সবশেষ গবেষণা মতে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ১৫ ধরনের উভচর ও ৪৩ ধরনের সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী পাওয়ার তথ্য মিললেও, এই গবেষণায় মোট ৭১ প্রজাতির উভচর ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ১১টি নতুন।
অন্যদিকে, ২৩ প্রজাতির উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী, যেগুলো আগে লাউয়াছড়ায় পাওয়া যেত বলে ধারণা করা হতো, সেগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এই গবেষণা কাজের অধীনে তাদের প্রজাতি নিরূপণ করা হয়েছে। উভচর শ্রেণির প্রাণীর মধ্যে ১৯ প্রজাতির ব্যাঙ এবং মাত্র ১ প্রজাতির সিসিলিয়ান জাতীয় প্রাণী পাওয়া গেছে। সরীসৃপ শ্রেণির মধ্যে পাওয়া গেছে ২ প্রজাতির কচ্ছপ, ১৪ প্রজাতির টিকটিকি জাতীয় (২ প্রজাতির গুইসাপসহ) এবং ৩৫ প্রজাতির সাপ, যার মধ্যে রয়েছে মাত্র ৬ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে রাজ গোখরা, অজগর ও পাহাড়ি হলুদ কচ্ছপ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন’এর লাল তালিকায় মহাবিপন্ন বা বিপন্নের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
অপরদিকে চিকিলা, বাইবুন গেছো ব্যাঙ, ব্লিথের সাপের মতো প্রজাতি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পাওয়া গেছে, যা আইইউসিএন’এর লাল তালিকায় অপর্যাপ্ত তথ্যের কারণে তথ্য ঘাটতি তালিকায় রাখা হয়েছে।
গবেষকরা জানান, বনে বেশকিছু সমস্যা পেয়েছে গবেষক দল। তারা মনে করেন, বনের মধ্যে যে প্রতিবেশগত সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রাণীদের আবাস্থল নষ্ট হয়েছে তাতে আগামী ১০-১৫ বছরে বেশকিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার মধ্যে বনে পানির সংকট আছে। পাহাড়ে অপরিকল্পিত কালভার্ট এবং আশপাশের চা বাগানে যে কীটনাশক দেয়া হচ্ছে, তা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলবে। বনে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াও প্রাকৃতিক পানির উৎস কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
সামগ্রিক বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমরা গবেষণাপত্রটি পেয়েছি। পর্যবেক্ষণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। বন্যপ্রাণীর জন্য সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে আমরা আন্তরিক ও দায়িত্ববোধ থাকব।
রিপন দে/এমএসএইচ/পিআর