ভিডিও EN
  1. Home/
  2. কৃষি ও প্রকৃতি

বদলে যাচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি

নিজস্ব প্রতিবেদক | রাজশাহী | প্রকাশিত: ০৮:৩১ এএম, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

খরা, বন্যা ও শৈত্য বদলে দিচ্ছে বরেন্দ্র খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি। এবারের বন্যায় কেবল রাজশাহী জেলায় কৃষকের ক্ষতি ৩৭২ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উঠতি আউশ ও রোপা আমনের। তারপরও রাজশাহী অঞ্চলে গত পাঁচ বছরে আউশ ও আমনের আবাদ বেড়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৩১ হেক্টার। আর উৎপাদন বেড়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৮০ মেট্রিকটন।

দেশের খাদ্য শস্যের অন্যতম ভাণ্ডার এ অঞ্চল থেকে চাল যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। কৃষিতেই সমৃদ্ধ হচ্ছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি। সংরক্ষণশীল কৃষি প্রযুক্তি যুক্ত করেছে এ অঞ্চলের কৃষিতে নতুন মাত্রা।

সম্প্রতি চাষ ছাড়াই ব্রি ধান-৭১ ঘরে তুলেছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। সাথী ফসলের সঙ্গে ফলছে এ ধান। আগেভাগেই পেকে যাওয়া এ ফসল স্বল্প খরচেই ঘরে তুলতে পারছেন কৃষক। নয় অঞ্চল ভেদে আমন (বর্ষাকালীন ধান), রবি মৌসুম (শীত ও শুষ্ক কালীন ধান, তেলবীজ, ডাল অথবা গম) এবং খরিফ-১ (প্রাক-মৌসুমি) শস্য আউশ ধান, মুগ ডাল অথবা পাট চাষাবাদ হচ্ছে এ কৃষি পদ্ধতিতে। নতুন এ পদ্ধতির চাষাবাদ কৃষকদের মধ্যে বেশ সাড়াও ফেলেছে।

কেবল ব্রি-৭১ ধানই নয়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) উদ্ভাবিত বিনাধান-৭ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুলেছে সম্ভাবনার দুয়ার।

বিনার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটি স্বল্প সময়ের ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে এ ধানের ফলন পাওয়া যায়। ফলে বিনাধান-৭ চাষের পরেও বোরো চাষের আগে কৃষক আলু, সরিষা, মটরশুটি, ডাল ও আগাম জাতের কিছু রবিশস্যের আবাদ করা যায়। এ ধান বরেন্দ্র কৃষি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

অন্যদিকে রাজশাহী ধান গবেষণা কেন্দ্রের জৈষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ব্রি-৭১ ধান চাষ প্রকল্পের প্রধান ইনভেস্টিগেটর ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, এবার চাষ করা ব্রি-৭১ ধানের ফলন হয়েছে বিঘায় ১৯ মণ। আমন মৌসুমে পাটের জমিতে এ ধানের বীজ রিলে পদ্ধতিতে বোপন করা হয়। চাষ ও শ্রমিক খরচ হয়েছে তিন হাজার টাকাও কম। ধান পেকেছে দশদিন আগেই। প্রচলিত জাতের ধান চাষে বিঘায় সাশ্রয় হচ্ছে অন্তত ৭ হাজার টাকা।

সম্প্রতি রাজশাহীর পবা উপজেলার বামুনশিখর এলাকায় হয়ে গেলো ব্রি-৭১ ধান নিয়ে কৃষক সমাবেশ। সেখানে অংশ নেন ধান গবেষক, কৃষি কর্মকর্তা ও বিপুল সংখ্যক স্থানীয় কৃষক। চাষিদের আগ্রহ বাড়াতে এ আয়োজন করা হয়।

এরই মধ্যে এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে সেচ সাশ্রয়ী ডাল চাষ। বিশেষ করে গত দুই কৃষিবর্ষে রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে অন্তত সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে মসুর চাষ বেড়েছে। বেড়েছে ছোলা, মুগ ও মাসকালাই চাষও।

এ বিষয়ে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) খামার গবেষণা বিভাগের বরেন্দ্র সেন্টারের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাখাওয়াত হোসেন জানান, গত মৌসুমে ডাল গবেষণা কেন্দ্র এ অঞ্চলের প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে মসুর চাষ করেছিল। কৃষকদের মাঝে মসুর চাষের আধুনিক কলাকৌশল ও উচ্চফলনশীল জাত ছড়িয়ে দেয়া ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্যে।

rajshahi

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা অববাহিকায় বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলের জলবায়ু দিন দিন চরম হচ্ছে। উজানে ফারাক্কার প্রভাবে প্রবাহ হারানোয় পদ্মার বুকজুড়ে পড়েছে বিস্তৃীর্ণ বালুচর। মরে গেছে এর শাখা ও উপনদীগুলো। খাল বিলেও পানি থাকছেনা প্রায় বছরজুড়েই।

এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফল বলছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সরোয়ার জাহান সজল। তিনি বলেন, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর। ফলে প্রতি বছর পানির স্তর নিচের দিকে নামছে। এতে কেবল সেচের পানিই নয় সুপেয় পানীর যোগান কমছে আশঙ্কাজনক হারে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের উপায় সংরক্ষণশীল কৃষি বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. মো. এনামুল হক। তিনি জানান, খরাসহিষ্ণু এবং পানি কম লাগে এই ধরনের উন্নত জাতের আবাদের দিকে ঝুঁকছেন এই অঞ্চলের চাষিরা। এরই অংশ হিসেবে বরেন্দ্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে সংরক্ষনশীল কৃষি প্রকল্প। এ পদ্ধতিতে বিনা চাষে ফসল ফলানোর কৌশল শেখানো হচ্ছে কৃষকদের।

এ চাষে পানির ব্যবহার নেমে আসছে অর্ধেকে। এছাড়া ৮০ ভাগ জ্বালানি খরচ এবং ৩০ ভাগ শ্রমিক খরচ কমছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচা নেমে আসছে অর্ধেকে। এ পদ্ধতিতে চাষে জমির ঊর্বরতা বাড়ছে, ক্ষয়রোধও হচ্ছে মাটির।

অন্যদিকে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক এটিএম রফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দুর্যোগমুক্ত সময়ে বহুমুখী ও অধিক ফলনের কোনো বিকল্প নেই।

এছাড়া দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চাহিদা ভিত্তিক জাতের ধান উৎপাদনে টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দায়ী করা হয় বিএমডিএর সেচ পাম্পকে। তবে অবস্থা চরম হয়ে ওঠায় বিষয়টি ভাবনায় ফেলেছে সংস্থাটিকেও। সেচ সাশ্রয়ী ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা ছাড়াও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএমডিএ।

এ বিষয়ে বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, সেচে অতিরিক্ত পানি ব্যবহারে ভূ-গর্ভের পানির স্তর কমে যাচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণে বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকায় ৫৫০টি কুয়া খনন করে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে নবায়ন করছে বিএমডিএ। এসব কুয়ার গভীরতা ৭০ থেকে ১২০ ফিট পর্যন্ত। খাড়িতে পানি জমা হলে কুয়ার মধ্য দিয়ে তা ভূগর্ভের অনেক ভেতরে চলে যায়। বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় লাগসই কৃষি প্রযুক্তি প্রবর্তনে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।

এমএএস/আরআইপি/এমএস