জেনে নিন আখ চাষের পদ্ধতি : ষষ্ঠ পর্ব
আখ অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। আখ থেকে চিনি, গুড় এবং রস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট আবাদকৃত জমির ২.০৫% আখের আবাদ হয় যার পরিমাণ ১.৭০ লাখ হেক্টর। মিলজোনে ০.৮৬ লাখ হেক্টর এবং ননমিলজোনে ০.৮৪ লাখ হেক্টর। আসুন আখ চাষের পদ্ধতি জেনে নেই-
রোগ দমন
রোগ দমনে অনুমোদিত, সুস্থ সবল রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। ৫৪০ সে.গ্রে. তাপমাত্রায় আর্দ্র গরম বাতাসে আখবীজ ৪ ঘণ্টা শোধন করে রোপণ করতে হবে। আক্রান্ত আখঝাড় থেকে বীজ ব্যবহার করা যাবে না। রোগাক্রান্ত আখঝাড় শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে। নিয়মিতভাবে রোগাক্রান্ত পাতা এবং আক্রান্ত গাছের অংশবিশেষ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আখ কাটার যন্ত্র আগুনে পুড়িয়ে অথবা লাইসল দ্বারা শোধন করে ব্যবহার করতে হবে। অধিক ভেজা বা অধিক শুকনো মাটিতে ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আখ রোপণ থেকে বিরত থাকতে হবে। জমি ভালোভাবে চাষ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বীজতলায় চারা তৈরি করে রোপণ করতে হবে।
বীজআখ শোধন জরুরি
বাংলাদেশে শনাক্তকৃত ৩৮টি রোগের মধ্যে মারাত্মক ৬টি রোগ হলো- লাল পচা, সাদা পাতা, ঘাসীগুচছ, পোড়া ক্ষত, কালো শীষ, মুড়ি খর্বা। তাপ শোধনের মাধ্যমে আখের এই ৬টি মারাত্মক রোগ দমন করা যায়। আমাদের দেশে তাপ শোধন পদ্ধতিতে আখবীজ শোধন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। নিরোগ আখ উৎপাদনের জন্য বীজআখ তাপ শোধন ও ছত্রাকনাশক শোধন উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে দু’উপায়ে আখবীজ শোধন করা যায়- ছত্রাকনাশক পদ্ধতি ও তাপ শোধন পদ্ধতি।
ছত্রাকনাশক পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে মাটিতে অবস্থানরত রোগ-জীবাণু থেকে আখবীজকে রক্ষা করার জন্য রোপণের আগেই বীজশোধন করতে হয়। ব্যাভিস্টিন, টেক্টো, নোইন নামক বাজারে প্রচলিত ছত্রাকনাশকের ০.১০% দ্রবণে বীজখণ্ড ৩০ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করতে হয়। এ ধরনের ছত্রাকনাশকের দাম খুব বেশি হয় না এবং দ্রবণ প্রস্তুত ও শোধন পদ্ধতিও খুব সহজ।
এখানে ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমির আখবীজ শোধনের জন্য আমরা ২৫ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ব্যবহার করতে পারি। একটি বড় মাটির বা প্লাস্টিকের পাত্র, গামলা বা বালতিতে ২৫ লিটার পানি নিতে হবে এবং তাতে ২৫ গ্রাম ব্যাভিস্টিন গুলিয়ে নিলেই দ্রবণটি তৈরি হবে। এ দ্রবণে রোপণের জন্য তৈরি আখবীজ খণ্ডগুলো ডুবিয়ে রাখতে হবে। ৩০ মিনিট পর বীজ খণ্ডগুলো দ্রবণ থেকে তুলে নিলেই শোধন হয়ে যাবে। আখ রোপণের আগেই ছত্রাকনাশক দিয়ে এভাবে আখবীজ শোধন করতে হবে।
এছাড়া কীটনাশক দিয়ে রোগ দমনের মত উঁইপোকা দমনের জন্যও আখবীজ শোধন করা যায়। সেজন্য আগে তৈরি ২৫ লিটার ছত্রাকনাশক দ্রবণের সাথে ৫০ গ্রাম গাউচো ৭০ ডব্লিউএস বা ১৭৫ মি.লি. টিড্ডো ২০ ইসি বা ২৫ গ্রাম ক্রুজার ৭০ ডব্লিউএস মিশিয়ে নিতে হবে। এভাবে বীজ শোধন করলে রোগ দমনের সাথে আখ রোপণের পর উঁইপোকার আক্রমণ থেকে বীজখণ্ড রক্ষা পাবে।
তাপ শোধন
তাপ শোধন পদ্ধতিতে আখবীজ শোধন করলে বীজের ভেতরে অবস্থিত আখের মারাত্মক ৬টি রোগের জীবাণু ধ্বংস হবে। একবার তাপ শোধন করে আখ রোপণ করে পরবর্তী ৩ বছর এ বীজে উৎপাদিত বংশজাত বীজ আর তাপ শোধনের প্রয়োজন হবে না। তাপ শোধন পদ্ধতি ২ প্রকার- গরম পানিতে তাপ শোধন ও আর্দ্র গরম বাতাসে তাপ শোধন।
গরম পানিতে
এ পদ্ধতিতে একটি বড় ট্যাঙ্কিতে ৫০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে আখগুলো ৩ ঘণ্টা শোধন করা হয়। পানি গরম করার উৎস সহজলভ্য হওয়ায় বাংলাদেশের সবগুলো চিনিকলে এ পদ্ধতি অনুসারে আখবীজ শোধন করা হয়। মিল এবং মিলের আখচাষিগণ এ পদ্ধতিতে বীজ শোধনের সুফল ভোগ করেন। ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যক্তিপর্যায়ে চাষিরা এই শোধনযন্ত্র স্থাপন করতে পারেন না।
বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র মিনি হটওয়াটার ট্যাংক নামে গরম পানিতে আখ শোধনের একটি সহজ যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। একজন বড় আখচাষি অথবা কয়েকজন ছোট আখচাষি একত্রে যন্ত্রটি তৈরি করে নিতে পারেন। যন্ত্রটি বিদ্যুৎ চালিত এবং সহজে বহনযোগ্য। যেকোনো আখচাষি সহজেই যন্ত্রটি ব্যবহার করে আখবীজ শোধন করতে পারবেন।
আর্দ্র গরম বাতাসে
বিশেষ যন্ত্রের ভেতর আখ রেখে একদিক দিয়ে ৫৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জলীয়বাষ্প প্রবাহিত করে ৪ ঘণ্টাকাল শোধন করা হয়। ননমিল জোনে অর্থাৎ যেখানে চিনিকলের কার্যক্রম নেই, সেখানে এ পদ্ধতিতে আখবীজ শোধনের সরকারি কার্যক্রম চালু আছে। ননমিল জোনের চাষিরা এ সুবিধা ভোগ করেন। চিনিকলগুলোতে এ পদ্ধতিতে আখবীজ শোধন করা হয়।
ননমিল জোনে আখচাষিদের বীজ শোধনের সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ননমিল জোন আখচাষ জোরদারকরণ প্রকল্প ১০টি আখবীজ শোধন কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এসব কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে আখচাষিদের বীজ শোধন করে দেওয়া হয়। আগ্রহী চাষিগণ তার নিকটস্থ আখবীজ শোধন কেন্দ্র থেকে আখবীজ শোধন করে রোগমুক্ত আখ উৎপাদন করতে পারেন।
১০ থেকে ২০ একর জমিতে নিয়মিত আখ চাষ হয়, এমন এলাকার জন্য প্রতিবছর মাত্র ১ একর জমিতে তাপ শোধন করে আখ রোপণ করতে হবে। প্রথম বছর এ জমি থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন হবে। এ বীজ এবং এর বংশজাত বীজ পরবর্তী ২ বছর আর তাপ শোধনের প্রয়োজন হবে না। এই ভিত্তি বীজ থেকে ২য় বছরে ৫ একর এবং ৩য় বছরে ২০ একর জমিতে খুব সহজেই আখ রোপণ করে তাপ শোধন বীজের সুবিধা ভোগ করা যাবে। আখচাষিদের সুবিধার্থে এখানে ননমিল জোনে আখবীজ শোধন কেন্দ্রের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হলো-
১. আইরখামার, লালমনিরহাট সদর
২. ঘোড়াচরা, সিরাজগঞ্জ সদর
৩. চুড়ামনকাঠি, যশোর সদর
৪. মোস্তফাপুর, মাদারীপুর সদর
৫. পাটকেলঘাটা, তালা, সাতক্ষীরা
৬. করোটিয়া, টাঙ্গাইল সদর
৭. ভালুকজান, ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ
৮. সিঙ্গাইর, মানিকগঞ্জ
৯. রাজারবাজার, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ
১০. ডিডি অফিস, চাঁদপুর সদর
এছাড়াও গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা ও চাপাইনবাবগঞ্জের শীবগঞ্জ উপজেলায় ১টি করে ২টি বীজ শোধনযন্ত্র বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের অর্থায়নে স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্র ২টি থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় আখচাষিরা বীজ শোধনের সুবিধা নিতে পারেন।
এসইউ/আরআইপি