ভিডিও EN
  1. Home/
  2. কৃষি ও প্রকৃতি

আরণ্যকের বৃক্ষ-কথা

প্রকাশিত: ০৪:৩১ এএম, ২৪ জুন ২০১৭

গভীর মুগ্ধতা নিয়ে প্রথমবার ‘আরণ্যক’ পড়ার কয়েক বছর পর আবার একই মুগ্ধতা নিয়ে পড়লাম। মনে হলো আবার যেন নতুন করেই পড়ছি। কাহিনির বিন্যাস, পটভূমি, বর্ণনা এবং সর্বোপরি লেখকের একাত্ম হবার বিষয়টি গল্পের সর্বত্রই যেন জাদুর আমেজ ছড়িয়ে রেখেছে। আরণ্যককে যদি উপন্যাস না বলে লেখকের দিনলিপিও বলা হতো তাহলে মনে হয় অবিশ্বাস্য কিছু বলা হতো না। আবার একথাও সত্যি যে এই উপন্যাসের সবকিছুই কাল্পনিক নয়। ভারতের পূর্ণিয়ায় সত্যি সত্যি এমন কিছু বন আছে। আরণ্যককে সাদামাটা একটি বন-বনানীর গল্প ঠাওরালে ভুল হবে। কারণ এখানে যেমন প্রান্তিক জীবনের গল্প আছে তেমনি আছে অরণ্যের বিচিত্র ও প্রাণবন্ত বর্ণনা। আবার প্রান্তিক জীবনের নানান মুখ যেমন আছে তেমনি আছে অসংখ্য পুষ্প-বৃক্ষের বৈজ্ঞানিক বর্ণনা। এই দুয়ের সংমিশ্রণ গল্পের পরতে পরতে তৈরি করেছে ভিন্ন এক মাদকতা।

উত্তম পুরুষে বর্ণিত এই বন-জীবনের দীর্ঘ আখ্যানে কতগুলো ছবি আমাদের অনুভবে বার বার মূর্ত হয়ে ওঠে। গনোরী তেওয়ারী, যুগলপ্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, আস্রফি টিণ্ডেল, পাটোয়ারী, কুন্তা, মটুকনাথ পন্ডিত, মঞ্চী, রাজা দোবরু পান্না, রাজকন্যা ভানুমতী- আরো কত কত জীবন। এদের সবারই মনের ভাষা আলাদা আলাদা। লেখক এদের মনের গভীরে ঢুকেছেন, ছুঁয়ে দেখেছেন আর অবলীলায় ওদের মুখের ভাষাগুলো পরম উপাদেয় করে তুলে এনেছেন আমাদের জন্য।

লবটুলিয়া, ফুলকিয়া বইহার, নাড়া বইহার, সরস্বতী কুণ্ডী, মহালিখারূপে, ঝল্লুটোলা, ভাগলপুর- পূর্ণিয়া জেলায় সত্যি সত্যি এমন নামের জঙ্গল আছে কী না জানা নেই। কিন্তু জঙ্গলের সঙ্গে নামগুলো এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে এগুলোকে আলাদা করে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই গল্পের যত্রতত্র পুষ্প-বৃক্ষের বর্ণনাই বার বার মূর্ত হয়ে ওঠে। আমাদের ডেকে নিয়ে যায় বিজন কোনো অরণ্য প্রান্তরে। ‘পথের সর্বত্র পাহাড়ের ঢালুতে ও ডাঙ্গায় ছাড়া-ছাড়া জঙ্গল, মাঝে মাঝে সরু পথটাকে যেন দুই দিক হইতে চাপিয়া ধরিতেছে, আবার কোথাও কিছু দূরে সরিয়া যাইতেছে। কি ভয়ঙ্কর নির্জন চারিদিক, দিনমানে যা-হয় একরূপ ছিল, জ্যোৎস্না উঠিবার পর মনে হইতেছে যেন অজানা ও অদ্ভুত সৌন্দর্যময় পরীরাজ্যের মধ্য দিয়া চলিয়াছি।’ মূলত লেখকের তীক্ষ্ম অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বনের এক টুকরো সৌন্দর্যকেও উপেক্ষা করে না। প্রতিটি অণুগল্পই বিভিন্ন ধারা উপ-ধারায় প্রবাহিত হয়ে একেকটি বড় গল্পের আদলে প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।

প্রতিটি ঋতুর পালাবদল বন ও মনে যেসব পরিবর্তন আনে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা আরণ্যককে ভিন্ন সুষমা দান করেছে। ‘সেই বেগুনি রঙের জংলি ফুলগুলিই আমার কানে শুনাইয়া দিল বসন্তের আগমন বাণী। বাতাবী লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটু ফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনী ফুল নয়, রক্তপলাশ বা শিমুল নয়, কি একটা নাম গোত্রহীন, রূপহীন নগণ্য জংলী কাঁটাগাছের ফুল।....’ পুষ্প-বৃক্ষের এমন প্রাণবন্ত বর্ণনা গ্রন্থের পাতায় পাতায় রূপের পাশাপাশি সুগন্ধও ছড়াচ্ছে। আরণ্যকের সবচেয়ে বড় পুঁজি তরুপল্লবের সবিস্তার বৈজ্ঞানিক বর্ণনা। এখানে তিনি যেসব বৃক্ষ-তরুলতার গল্প করেছেন তার একটিও কাল্পনিক নয়। কখনো কখনো বানানো গল্পের সঙ্গে লেখক বাস্তবের সংমিশ্রণ করেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। আরণ্যকে ছড়িয়ে থাকা এমন সব পুষ্প বৃক্ষ লতা-গুল্মের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।

নিমগাছ
নিম মাঝারি আকৃতির সুদর্শন বৃক্ষ। কাণ্ড দীর্ঘ ও সরল, বাকল কালচে ধরনের। শাখা-প্রশাখা কিছুটা বিক্ষিপ্ত ধরনের। পাতা কাস্তের মতো বাঁকানো, কিনারা করাতের মতো দাঁতানো। প্রায় সারা বছরই গাছে নতুন পাতা গজায়। বসন্তে অধিকাংশ পাতা ঝরে পড়ার পরপরই আবার কচিপাতার উজ্জ্বল সবুজে আচ্ছন্ন হয় গাছ। তখনই ছোট ছোট অজস্র ফুলে ভরে ওঠে গাছ। পাপড়ির রং দুধসাদা, পরাগচক্র গুচ্ছবদ্ধ এবং হলুদ রঙের। ফুল শেষ হবার পর আসে ফল। দেখতে অনেকটা ডিম্বাকৃতির। নিমপাতার ভাজা, সিদ্ধ জল এবং মরু বিবিধ চর্মরোগের প্রতিষেধক। নিমের ডাল দাঁতন হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। বৈজ্ঞানিক নাম : Azadirachta indica.
‘স্তব্ধ দুপুরে ফালগুন-চৈত্র মাসে এখানে বসিয়া পাখির কূজন শুনিতে শুনিতে মন কতদূরে কোথায় চলিয়া যাইত, বন্য নিমগাছের সুগন্ধি নিমফুলের সুবাস ছড়াইত বাতাসে’ (পৃ. ৬২)।

স্পাইডারলিলি
এই ফুলের অনেক নাম- স্পাইডারলিলি, লিলি, গো-রসুন ইত্যাদি। মূলত কন্দজ উদ্ভিদ। শীত মৌসুমে ধড়টা শুকিয়ে গেলে কন্দ মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকে। শীতের শেষে বসন্ত কিংবা গ্রীষ্মে দু’এক পশলা বৃষ্টি হলে আবার নতুন জীবন ফিরে পায়। পাতা ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আনারস পাতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে স্বভাবে কোমল ও কিনারা সমান। ফুলের রঙ দুধ-সাদা, মাকড়সার মতো লম্বা লম্বা হাত-পা বহুল এবং সুগন্ধি। পাপড়ি ৬টি দীর্ঘ সরুখণ্ড তলপ্রান্তে পাতলা ঝিল্লিময় বা মুকুটযুক্ত থাকে। দীর্ঘ সবুজ পাতার পটভূমিতে ধবধবে সাদা রঙের ফুলগুলো সহজেই নজর কাড়ে। বর্ষার ভেজা বাতাসে এদের মধুর সুরভি ছড়িয়ে পড়ে অনেকদূর অবধি। বৈজ্ঞানিক নাম : Hymenocallis littoralis.
‘জলের ধারে স্পাইডার-লিলির বাহারও খুব’ (পৃ. ১২৮)। ‘নূরজাহান নাকি পারস্য হইতে চিনার গাছ আনিয়া কাশ্মীরে রোপণ করিয়াছিলেন। এখন নূরজাহান নাই, কিন্তু সারা কাশ্মীর সুদৃশ্য চেনার বৃক্ষে ছাইয়া ফেলিয়াছে। যুগলপ্রসাদ মরিয়া যাইবে। কিন্তু সরস্বতী হ্রদের জলে আজ হইতে শতবর্ষ পরেও হেমন্তে ফুটন্ত স্পাইডার-লিলি বাতাসে সুগন্ধ ছড়াইবে কিংবা কোনো না কোনো বনঝোপে বন্য হংসলতার হংসাকৃতি নীল ফুল দুলিবে, যুগলপ্রাসাদই যে সেগুলি নাঢ়া-বইহারের জঙ্গলে আমদানি করিয়াছিল একদিন- একথা না-ই বা কেহ বলিল’ (পৃ. ১৪০)।

শিউলী
শেফালি নামেও পরিচিত। ছোট গাছ, ৫ থেকে ৭ মিটার উঁচু, কচি ডল চৌকা। পাতা প্রায় ১০ সেমি লম্বা, আগা চোখা কিনার কখনো সামান্য কাটা-কাটা, শীত ও বসন্তে অনেক পাতা ঝরে পড়ে। ২ সেমি লম্বা ও ৩ সেমি চওড়া ফুল ফোটে শরতে, নিশিপুষ্পা, ঝরে পড়ে রাতশেষে। ১ সেমি লম্বা সোনালি-লাল বোটার আগায় সাদা পাপড়ির ৫ থেকে ৮টি লতি। ফল চ্যাপ্টা, বিতাম্বুলাকার, ২-ভাগ, একটি করে বীজ আছে। বৈজ্ঞানিক নাম : Nyctanthes arbor-tristis.
‘সরস্বতী কুণ্ডীর বনে কত বন্য শিউলি গাছ.... যেন শিউলিবন। বড় বড় শিলাখণ্ডের উপর শরতের প্রথমে সকালবেলা রাশি রাশি শিউলিফুল ঝরিয়া পড়িয়াছিল’ (পৃ. ৬৩)। ‘সন্ধ্যা হইবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নতুন সুবাস পাইলাম। আশেপাশের বনের মধ্যে যথেষ্ট শিউলিগাছ আছে। বেলা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে শিউলি ফুলের ঘন সুগন্ধ সান্ধ্য-বাতাসকে সুমিষ্ট করিয়া তুলিয়াছে’ (পৃ.১৪০)।

কাশ
কাশ ঘাসজাতীয় গাছ। জন্মে জলার ধারে, খাল ও নদীর তীর বেশি পছন্দ। তবে পাহাড়েও একজাতের কাশ আছে। সরু ধারালো পাতার এগাছ নিজেরাই ঝোপ বানিয়ে থাকতে পছন্দ করে। গাছ বেশ শক্তপোক্ত ধরনের। শরতে শুভ্র তুলোর মতো তুলতুলে ফুলগুলো ফোটে। তখন ফুলের সৌন্দর্য চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ গাছ ৫ থেকে ২৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাহাড়ি কাশ প্রায় সারা বছরই দেখা যায়। সমতল এবং পাহাড়ি কাশের মধ্যে বর্ণ ও গড়নের দিক থেকে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কাশের পাতা ঘর-গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। বৈজ্ঞানিক নাম : Saccharum spontaneum.
‘ধূ ধূ বন-ঝাউ আর কাশবনের চর’ (পৃ. ৭)। ‘শুকনো কাশ ও সাবাই ঘাসের ছোট্ট একটা ছাউনি’ (পৃ. ৩৫)। ‘সেই খাটো কাশ-জঙ্গল’ (পৃৃ. ৫৯)।

পলাশ (রক্তপলাশ)
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রজাতি। দেশের প্রায় সর্বত্রই কম বেশি চোখে পড়ে। উজ্জ্বল বর্ণের ফুলের জন্য পলাশ সর্বত্রই আদৃত। মাঝারি আকারের পত্রমোচি গাছ, ১০ থেকে ১২ মিটার উঁচু, কাণ্ড গাঁটাল, কচি ডাল রোমশ। যৌগপত্র ৩-পত্রিক। কচি পত্রিকার নিচ রোমশ, ১৫ থেকে ১৮ সেমি লম্বা, চার্ম, শীতে ঝরে যায়। বসন্তের শুরুতে নিষ্পত্র ডাল থোকা থোকা গাঢ়-কমলা রঙের ফুলে ভরে ওঠে। ফুল বেশ বড়, শিমফুলের গড়ন, ৮ সেমি পর্যন্ত লম্বা। বৃতি ১.২ সেমি লম্বা, বাদামি, মখমলতুল্য। সামনের বড় পাপড়ির রং গাঢ়-কমলা। অল্পদিনের মধ্যেই ফুল ঝরে যায় আর সারা গাছে অজস্র সবুজ চ্যাপ্টা ফল ঝুলতে থাকে। শুঁটি ১০ থেকে ১৫ সেমি, পাতলা, এক বীজিয়, বায়ুবাহী। বীজে চাষ। গোড়ায় শিকড় থেকেও চারা গজায়। বৈজ্ঞানিক নাম : Butea monosperma.
‘সে অপূর্ব মুক্ত শিলাবিস্তৃৃত প্রান্তরে রঙিন বনফুলের শোভা, ফুটা রক্তপলাশের ঘন অরণ্যেও কথা ভাবি... তখন মনে হয়.... ঘুমের ঘোরে এক সৌন্দর্যভরা জগতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম’ (পৃ. ৭)। শৈলসানুতে.... প্রথম বসন্তে প্রস্ফুটিত রাঙা পলাশ ফুলের মেলা বসিয়াছে’ (পৃ. ৩৪)। ওপারে ফুটন্ত রক্তপলাশের বন, উঁচু নিচু রাঙা রাঙা শিলাখণ্ড, আর শুধুই পলাশ আর পলাশ, সর্বত্র পলাশ ফুলের মেলা’ (পৃ. ৩৫)।

শিমুল
মালয়েশিয়া ও ভারত উপমহাদেশের উষ্ণাঞ্চলের প্রজাতি। গাছ পত্রমোচি, ২৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পুরনো গাছের কাণ্ড মসৃণ, অল্পবয়সী গাছে চ্যাপ্টা কাঁটা থাকে। ডালগুলো আনুভূমিকভাবে ছড়ান। যৌগপত্র করলাকার, পত্রিকা ৩ থেকে ৭টি, ভল্লাকার, ১০ থেকে ৩০ সেমি লম্বা। শীতে পাতা ঝরে, বসন্তে শূন্য ডাল বড় বড় ফুলে ভরে যায়। ফুলের রঙ লাল, হলুদ এবং দৈবাৎ সাদাটে। পুংকেশর ৫ স্তবকে গুচ্ছবদ্ধ। ফল ১০ থেকে ১২ সেমি, তুলাভরা, তাতে গাঢ়-বাদামি অজস্র বীজ। ফল ফেটে তুলার সঙ্গে বীজ দূরদূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। বৈজ্ঞানিক নাম : Bombax ceiba.
‘শিমুলগাছের তলায় আমরা ঘোড়া থামাইয়া একটু বিশ্রাম করি’ (পৃ. ৫৮)। ‘পথে বড় একটা শিমুল গাছ- ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি জ্বলিতেছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া চক্রাকারে... নানা জ্যামিতিক ক্ষেত্র অঙ্কিত করিয়া আলো-আঁধারের পটভূমিতে’ (পৃ. ৯৯)।

এরিস্টোলোকিয়া/হংসলতা
জানামতে বাংলাদেশে শুধুমাত্র বলধা গার্ডেনেই আছে। এগাছ কোথাও কোথাও এরিস্টোলোকিয়া নামেও পরিচিত। সম্ভবত আমাদের প্রাকৃতিক বনেও নেই। লতান গাছ। পাতা পানের মতো বা কিছুটা লম্বাটে। ফুলের গড়ন হাঁসের মতো, গোড়ার দিকটা লম্বা ও বাঁকা। প্রজাতিভেদে ফুলের আকার ও রঙে তারতম্য ঘটতে পারে। কোনো কোনোটি ভারি সুন্দর। তবে গন্ধ অপ্রীতিকর। আরণ্যক গ্রন্থে অন্তত দু’বার এ ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে। বৈজ্ঞানিক নাম- Aristolochia spp.
‘যুগলপ্রসাদ দেখিলাম এ দেশের বহু ফুল ও সুদৃশ্য বৃক্ষলতার খবর রাখে। বলিলাম, তুমি এরিস্টোলোকিয়া লতা চেন?’ (পৃ. ৬৫)। ‘সে বলিল, সরস্বতী কুণ্ডীর পূর্ব পাড়ের জঙ্গলে যতগুলো হংসলতা লাগিয়েছিলাম সবগুলো কেমন ঝাঁপালো হয়ে উঠেছে দেখেছেন বাবুজী?’ (পৃ. ১২৮)।

ভুঁইকুমড়া
ভুঁইকুমড়া (Ipomoea mauritiana) লতান গাছ। আশ্রয় পেলে খুব সহজেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বনবাদাড়, ঝোপজঙ্গল কিংবা পরিত্যক্ত স্থান পছন্দ। অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায়ও সহজলভ্য। পাতা সবুজ, মিষ্টি আলুর পাতার মতো, কিনারা গভীরভাবে খাঁজকাটা, লতি ৫ থেকে ৭ ভাগে বিভক্ত। প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা বোঁটায় ২ থেকে ৩ ইঞ্চি চওড়া গাঢ়-বেগুনি রঙের ফুলগুলো ফোটে। প্রধান প্রস্ফুটনকাল বর্ষা-শরৎ হলেও শীতকাল ব্যতীত প্রায় সারা বছরই কমবেশি ফোটে। কন্দ বেশ বড়, সাদা ও সুমিষ্ট। সারা পৃথিবীতে আইপোমিয়া গণনা করে প্রায় ৫০০ প্রজাতির গাছ দেখা যায়।
‘...প্রথমে ভাবিলাম লোকটা ভুঁইকুমড়া তুলিতে আসিয়াছে। ভুঁইকুমড়া লতাজাতীয় উদ্ভিদ, মাটির মধ্যে লতার নিচে চালকুমড়ার আকারের প্রকাণ্ড কন্দ জন্মায়- উপর হইতে বোঝা যায় না। কবিরাজী ঔষধে কাজে লাগে বলে বেশ দামে বিক্রয় হয়’ (পৃ, ৬৪)।

বটগাছ
বটগাছ মোটামুটি সহজলভ্য। খুব অল্প বয়স থেকেই ঝুরি নামতে শুরু করে। মাটির সমান্তরালে বাড়তে থাকা ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কাণ্ডে পরিণত হয়। এভাবেই বটগাছ ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকে এবং একসময় মহীরূহে পরিণত হয়। বটের পাতা ডিম্বাকৃতি (আগা গোলাকার), একান্তর, মসৃণ এবং উজ্জ্বল সবুজ। কচিপাতা তামাটে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পাতার আয়তনের বিভিন্নতা একাধারে বটের বৈশিষ্ট্য তথা প্রজাতি শনাক্তকরণের পক্ষে জটিলতার কারণও। পরিণত গাছের পাতা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে আসে। বটের কুঁড়ি পাঁশুটে হলুদ এবং এর দুটি স্বল্পায়ু উপপত্র পাতা গজানোর পরই ঝরে পড়ে। বসন্ত শরৎ বটের নতুন পাতার দিন। কচি পাতার উজ্জ্বল সবুজে আচ্ছন্ন বট বেশ সুশ্রী। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত হলো ফল পাকার দিন। এই ফল কাক, শালিক ও বাদুড়ের প্রিয়। আমাদের দেশে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুরের বটগাছটি সবচেয়ে বড়। বৈজ্ঞানিক নাম : Ficus benghlensis.
‘এই বটগাছ আগে এখানে ছিল না। অন্য অন্য গাছের বন ছিল। একটি ছোট বট চারা ক্রমে বেড়ে অন্য অন্য গাছ মেরে ফেলে দিয়েছে। এই বটগাছটা এত প্রাচীন যে এর আসল গুঁড়ি নেই। ঝুরি নেমে যে গুঁড়ি হয়েছে তারাই এখন রয়েছে’ (পৃ. ৯১)।

আমলকী
মাঝারি আকারের পত্রমোচী বৃক্ষ। সরু ডালের দুপাশে অসংখ্য ছোট ছোট পাতা। ফুল খুব ছোট। ফল গোল, সামান্য শিরাল, টক, রসাল, অত্যন্ত পুষ্টিকর ও ভেষজগুণসমৃদ্ধ। বৈজ্ঞানিক নাম : Emblica officinalis.
‘শুকনো কাশ ও সাবাইর ছোট্ট একটা ছাউনি কেঁপ ও আমলকীর বনে (পৃ. ৩৫)।’

জম্বুফল/কালোজাম
বড় গাছ। পাতা ৩ থেকে ৬ সেমি লম্বা। নাকফুলের মতো ছোট থোকা থোকা সাদা ফুল ফোটে। বেশ সুগন্ধী। মধু খেতে আসে মাছি এবং মৌমাছি। ফল কালো, ডিম্বাকার, রসাল, শাঁস বেগুনি। বীজ একটি। বৈজ্ঞানিক নাম : Syzygium cumini.
‘মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূর দেশে, যেখানে পতিত-পক্ষ জম্বুফলের গন্ধে গোদাবরী তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে’ (পৃ. ৫)।

ফণীমনসা
গাছ চ্যাপ্টা, স্থূল এবং অনেকগুলো টুকরো জোড়া লাগালে যেমন দেখতে অনেকটা সে রকম। ২ থেকে ৪ ফুট বা তার চেয়েও উঁচু হতে পারে। একত্রে অনেকগুলো ঝোপ বানায়। গাছ কাঁটাভরা। ফুল বেশ বড়, পাপড়ি অনেক, হলুদ রঙ।
‘মাঝে মাঝে নিতান্ত দরিদ্র পল্লী। ফণীমনসা-ঘেরা তামাকের ক্ষেত ও খোলায় ছাওয়া দীনকুটির’ (পৃ. ২০)।

কেলীকদম্ব/ছোট হলদু
প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু পত্রমোচী ঝোপাল গাছ। শরতে পাতা ঝরে। ১ ইঞ্চির মতো চওড়া চুল, ঝুলন্ত, হলুদ। বসন্তে ফোটে। ফল দেখতে সুপারির মতো। বীজ ৬টি। বৈজ্ঞানিক নাম : Adina cordifolia.
‘কেলিকদম্ব গাছের সেগুন পাতার মতো বড় বড় পাতায় বাতাস বাঁধিয়া শন শন শব্দ হইতেছে (পৃ. ১২৫)। পাহাড়ের জঙ্গলে কেলিকদম্ব গাছের বড় বড় পাতার আড়ালে শুক্র ও বৃহস্পতি জ্বল জ্বল করিতেছে (পৃ. ১২৬)। কেলিকদম্ব কদম্বফুলের গাছ নয়, কেলিকদম্ব ভিন্নজাতীয় বৃক্ষ, সেগুনপাতার মতো বড় বড় পাতা, চমৎকার আঁকাবাঁকা ডালপালাওয়ালা বনস্পতি শ্রেণীর বৃক্ষ’ (পৃ. ১৩৯)।

ছাতিম/সপ্তপর্ণী
বড় আকৃতির চিরসবুজ গাছ। ডালপালা কিছুটা ছত্রাকৃতির। ডালের গাঁটে ৫ থেকে ৭টি পাতা থাকে। শরৎ-হেমন্তে গুচ্ছবদ্ধ সবজেটে ছোট ছোট ফুল ফোটে, গন্ধ তীব্র, ঝাঁঝাল এবং মধুর। থোকায় থোকায় সরু লম্বা ফলগুলো প্রথমে সবুজ, পরে সাদাটে বাদামি বীজে তুলা থাকায় বাতাসে ওড়ে। কাণ্ড, ডাল ও পাতায় দুধকষ থাকে। বৈজ্ঞানিক নাম : Alstonia scholaris.
‘কিছুদূর উঠতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল। গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত... চারিদিকে চাহিয়া দেখি ধনঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ আছে তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই। এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস। ...ছাতিম ফুলের সুবাস আরও ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে... ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোপায় গুঁজিল’ (পৃ. ১৩৯)।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন