ছাগল পালনে স্টল ফিডিং পদ্ধতি
বাংলাদেশে ছাগল পালনে কোনো পদ্ধতি এখনো সেভাবে পালন করা হয় না। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিপালিত হতে থাকে এই গৃহপালিত প্রাণি। এদেশে সাধারণত ছাগলকে ছেড়ে বা মাঠে বেঁধে খাওয়ানো হয় ঘাস। বিশেষ যত্ন নিতেও দেখা যায় না বেশির ভাগ ছাগল পালনকারীকে। একটু সচেতন হলে ছাগল পালনে আরেকটু যত্নশীল হওয়া যায়।
স্টল ফিডিং পদ্ধতি
গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত বিজ্ঞানভিত্তিক বাসস্থান, খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনুসারে ছাগল পালনের প্যাকেজ প্রযুক্তিকে স্টল ফিডিং পদ্ধতি বলা হয়।
ছাগল নির্বাচন
ছাগলের খামার করার উদ্দেশ্যে ৬-১৫ মাস বয়সী স্বাভাবিক ও রোগমুক্ত ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের পাঁঠা বা ছাগী সংগ্রহ করতে হবে। পাঁঠার বয়স ৫-৭ মাস হতে পারে।
ঘর নির্মাণ
এ পদ্ধতিতে প্রতিটি বয়স্ক ছাগলের জন্য প্রায় ১০ বর্গফুট ঘর প্রয়োজন। ঘরটি বাঁশ, কাঠ বা ইটের তৈরি হতে পারে। শীতের রাতে ঘরের বেড়া চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং মেঝেতে খড় বিছিয়ে দিতে হবে।
ছাগলকে অভ্যস্ত করা
ছাগলকে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় রাখা উচিত নয়। দিনে ৬-৮ ঘণ্টা চরিয়ে বাকি সময় আবদ্ধ অবস্থায় রেখে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এভাবে ১-২ সপ্তাহের মধ্যে চরানোর সময় পর্যায়ক্রমে কমিয়ে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় রাখতে হবে। তবে বাচ্চা বয়স থেকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখলে এ ধরনের অভ্যস্ততার প্রয়োজন হয় না।
পরিচর্যা
জন্মের পরপরই বাচ্চাকে পরিষ্কার করে শালদুধ খাওয়াতে হবে। এক মাস পর্যন্ত বাচ্চাকে দিনে ১০-১২ বার দুধ খাওয়াতে হবে। দুধ না পাওয়া গেলে মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়াতে হবে। দুধ খাওয়ানোর আগে ফিডার, নিপলসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পানিতে ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এক-দেড় কেজি ওজনের একটি ছানার দৈনিক ২৫০-৩৫০ গ্রাম দুধ প্রয়োজন। ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুধের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বাচ্চার বয়স ৬০-৯০ দিন হলে দুধ ছেড়ে দেবে। বাচ্চার ১ মাস বয়স থেকেই ধীরে ধীরে কাঁচা ঘাস এবং দানাদার খাদ্যে অভ্যস্ত করতে হবে।
ছাগলের খাবার
ছাগল সাধারণত তার ওজনের ৪-৫% হারে খেয়ে থাকে। এরমধ্যে ৬০-৮০% আঁশ জাতীয় খাবার এবং ২০-৪০% দানাদার খাবার দিতে হবে। দুই বাচ্চা বিশিষ্ট ২৫ কেজি ওজনের ছাগীর দৈনিক প্রায় ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ৩৫০-৪৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পাঁঠার দৈনিক ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ২০০-৩০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন।
ঘাস চাষ
ছাগলের জন্য ইপিল ইপিল, কাঁঠাল পাতা, খেসারি, মাসকলাই, দুর্বা, বাকসা ইত্যাদি দেশি ঘাসগুলো বেশ পুষ্টিকর। এছাড়া উচ্চফলনশীল নেপিয়ার, স্পেনডিডা, এন্ড্রোপোগন, পিকাটউলুম ইত্যাদি ঘাস চাষ করা যায়।
খড় খাওয়ানো
ঘাস না পেলে খড়কে ১.৫-২.০ ইঞ্চি পরিমাণে কেটে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ানো যেতে পারে। এজন্য ১ কেজি খড়ের সাথে ২০০ গ্রাম চিটাগুড়, ৩০ গ্রাম ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম পানির সঙ্গে মিশিয়ে ইউএমএস তৈরি করে খাওয়ানো যায়। এরসঙ্গে অ্যালজি উৎপাদন করে দৈনিক ১-১.৫ লিটার পরিমাণে খাওয়াতে হবে। একটি ছাগল দৈনিক ১.০-২.০ লিটার পানি খায়। এজন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
পাঁঠার ব্যবস্থাপনা
যেসব পাঁঠা বাচ্চা প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হবে না তাদের জন্মের ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে খাসি করানো উচিত। পাঁঠাকে যখন প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হয় না, তখন তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে শুধু ঘাস খাওয়ালেই চলে। তবে প্রজনন কাজে ব্যবহারের সময় ওজনভেদে ঘাসের সঙ্গে ২০০-৫০০ গ্রাম পরিমাণ দানাদার খাবার দিতে হবে। পাঁঠাকে প্রজননক্ষম রাখার জন্য প্রতিদিন ১০ গ্রাম পরিমাণ গাঁজানো ছোলা দেওয়া উচিত। পাঁঠাকে কখনোই চর্বিযুক্ত হতে দেওয়া যাবে না।
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
ছাগলকে বছরে দু’বার (বর্ষার শুরু এবং শীতের শুরু) কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। ছাগলের মারাত্মক রোগ হলে দ্রুত পশুহাসপাতালে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া তড়কা, হেমোরেজিক সেপ্টিসেমিয়া, এন্টারোটক্সিমিয়া, বিভিন্ন কারণে পাতলা পায়খানা এবং নিউমোনিয়া হতে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে সুস্থ ছাগলের জন্য একথাইমা রোগের ভ্যাকসিন জন্মের ৩য় দিন ১ম ডোজ এবং ২য় ডোজ জন্মের ১৫-২০ দিন পর দিতে হবে। পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন ৪ মাস বয়সে এবং গোট পক্সের ভ্যাকসিন ৫ মাস বয়সে দিতে হবে।
জৈব নিরাপত্তা
খামারের জন্য অবশ্যই রোগমুক্ত ছাগল সংগ্রহ করতে হবে এবং ১৫ দিন খামার থেকে দূরে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো রোগ দেখা না দিলে ১৫ দিন পর পিপিআর ভ্যাকসিন দিয়ে খামারে রাখা যাবে। অসুস্থ ছাগল পালের অন্য ছাগল থেকে দ্রুত সরিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
প্রজনন
ছাগলের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বছরে ৫-৬ বার ০.৫% ম্যালাথায়ন দ্রবণে চুবিয়ে চর্মরোগ মুক্ত রাখতে হবে। ছাগী ১২-১৩ কেজি ওজন (৭-৮ মাস বয়স) হলে তাকে পাল দেওয়া যেতে পারে। ছাগী গরম হওয়ার ১২-১৪ ঘণ্টা পর পাল দিতে হয়। অর্থাৎ সকালে গরম হলে বিকেলে এবং বিকেলে হলে পরদিন সকালে পাল দিতে হবে। পাল দেওয়ার ১৪২-১৫৮ দিনের মধ্যে সাধারণত বাচ্চা দেয়। পাল দেওয়ার জন্য নির্বাচিত পাঁঠা সবসময় নিরোগ, ভালো বংশের হবে। ‘ইনব্রিডিং’ এড়ানোর জন্য ছাগীর বাবা বা দাদা বা ছেলে বা নাতিকে দিয়ে প্রজনন করানো যাবে না।
বাজারজাতকরণ
সুষ্ঠু খাদ্য ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় ১২-১৫ মাসের মধ্যে খাসি ২০-২২ কেজি ওজনের হয়। এসময় খাসি বিক্রি করা যেতে পারে। অথবা খাসির মাংস প্রক্রিয়াজাত করেও বিক্রি করা যেতে পারে।
এসইউ/পিআর