শস্যের বীজ কৃষকের অধিকার
শত শত বছর ধরে কৃষকেরা বিশ্বে নতুন-নতুন জাতের শস্যবীজ এবং শস্যের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছেন। বাণিজ্যিক জাতগুলোর প্রেক্ষাপটে কৃষকদের নিজস্ব বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণের প্রাচীন অধিকার চিহ্নিত করার বিষয়টিকে নীতি নির্ধারকরা প্রায়ই চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু কৃষকেরা তাদের অধিকার এবং নিজস্ব জাতগুলোর গুরুত্ব বিষয়ে ক্রমশ সচেতন হচ্ছেন। কৃষকদের কথা হচ্ছে, ‘আমার অধিকার, আমি বলতে পারি, যেসব স্থানীয় শস্য আমি উৎপাদন করি, সেগুলো আমারই এবং আমার বীজের ওপর আর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি সেগুলো বিক্রি করবো কি না, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমারই।’
বর্তমানে গবেষকরা গুণিতক হারে স্থানীয় জাতের কৃষকদের বীজগুলোর ফলন বাড়াচ্ছেন এবং তারপর সেগুলো আবার ফিরে কৃষকদের কাছেই বিক্রি করছেন। কিন্তু যখন কৃষকেরা শস্য উৎপাদন করেন, তখন তা আর বীজ থাকে না এবং গবেষকরা বলেন, কৃষকদের প্রতি বছর বীজ কেনা প্রয়োজন। কিন্তু আগেকার দিনে, কৃষকদের স্থানীয় বীজগুলোকেই বার বার ব্যবহার করা যেত। অতীতের মতো এখনো কৃষকেরা তাদের স্থানীয় জাতগুলো ব্যবহার করতে পারছেন; এগুলো কৃষকদের সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কৃতি-কৃষ্টি, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেও উপকারে লাগছে। নিজ-নিজ পরিবার ছাড়াও আরেকটি জিনিসকে কৃষকেরা তাদের হৃদয়ের খুব কাছে রাখেন, তা হচ্ছে বীজ।
তারা কৃষক হিসেবে গর্বিত। কৃষকেরা তাদের সন্তানদের খাবার এবং সহায়তা দেন। প্রকৃতপক্ষে কৃষকেরা বিশ্বের খাবার জোগান দিয়ে থাকেন। সুতরাং পাঠকরা নিশ্চয়ই কৃষকদের সাথে একমত হবেন, তাদের নিজেদের বীজ নিজেদের কাছে রাখাটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এখন কৃষকদের জানার অধিকার আছে, কত ভালোভাবে তারা তাদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন। এখন আমরা কৃষকদের কাছে প্রশ্ন রাখতে পারি, কোথা থেকে তারা এই বীজ পান? আগের ফসল থেকে কি তারা কিছু বীজ রেখে দেন? তারা কি কিছু বীজ অন্য কৃষকের সাথে বিনিময় করেন; অথবা তারা কি মাঝে-মাঝে স্থানীয় বাজার থেকে বীজ কেনেন? আমাদের মাঝে কেউ-কেউ কৃষক প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় কৃষি প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বীজ কিনে থাকেন। যা-ই হোক, তারা যে বীজ বিক্রি করেন, সেসব জাত প্রধানত অন্য কোথাও উৎপাদিত এবং সেগুলো প্রায়ই বেশি দামে প্রত্যেক মৌসুমে কিনতে হয়।
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় স্থানীয় জাতের শস্যগুলো ভালো জন্মায় এবং প্রশংসা করার মতো ভালো কিছু জাত আমাদের আছে। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখার জন্য এসব জাত সংরক্ষণ করা দরকার। যখন আপনার সন্তান বিয়ে করবে বা যখন আপনি কাউকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করবেন, আপনার গ্রামে কোনো উৎসবের আয়োজন করবেন; তখন আনন্দ উদযাপন এবং গান-বাজনা করার অনুষঙ্গ হিসেবে স্থানীয় জাতের ধান দিয়ে অবশ্যই তাকে বরণ করে নিতে হবে। কৃষকরা বলেন, ‘আমরা খুব সুখী যে, আমরা আমাদের পূর্বসুরিদের কাছ থেকে বীজ ফিরে পেয়েছি। আমরা বয়স্করা জানি যে, আপনারা যখন স্থানীয় চাউল দিয়ে ভাত রান্না করেন, তখন এর থেকে সুন্দর গন্ধ বের হয়, জাউও ঘন হয় এবং যখন আপনি তা খাবেন, তখন আপনার তা ভালো লাগবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য স্থানীয় জাতগুলো কৃষকদের সহায়তা করার ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃষকেরা বলেন, ‘অতীতে আমাদের দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। তাই আমরা শুধু ধান চাষ করতাম; কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, বৃষ্টি কীভাবে বছরের পর ধরে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা এই তথ্য পেয়ে থাকি। বিভিন্ন জাতের শস্য বিষয়ে আমাদের কাছে অতিরিক্ত তথ্যও থাকে। যার ফলে যখন আমরা একটি ফসল চাষে ব্যর্থ হই; তখন আমরা আরেকটি ফসল চাষে লাভবান হয়ে থাকি।’
যেহেতু আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে; সেহেতু শস্য উৎপাদনকারীরা আধুনিক জাত তৈরির উদ্দেশ্যে উত্তরোত্তর নিজেদের স্থানীয় জাতগুলোর ওপর নির্ভর করছেন, যাতে নতুন-নতুন প্রয়োজন মেটানো যায়। কৃষকের ভাষায়: ‘তাদের যে জাতের শস্য দরকার, আমাদের স্থানীয় বীজ ছাড়া তাদের পক্ষে সেই জাতের শস্য পাওয়া সম্ভব নয়। তারা স্থানীয় বীজ থেকে সংগৃহীত বীজাণুর ওপর নির্ভর করে থাকেন, যা আমাদের মতো কৃষকেরা উৎপাদন করে থাকেন। আমাদের কাছ থেকে বীজ জোগাড় করার পর পরই তারা বীজের মান উন্নত করার জন্য দুটি বীজের মধ্যে মিশ্রণ ঘটায়। তারা তাদের চাহিদামতো বীজ না পাওয়া পর্যন্ত তা করতেই থাকেন। সুতরাং আমাদের সহায়তা ছাড়া তাদের নিজেদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।’
বীজ জমা করে রাখার ব্যাপারে বীজ আইন কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে। ফলে বীজ উৎপাদকরা নতুন, আধুনিক জাতের বীজ উৎপাদন করার ব্যাপারে যেসব বীজের ওপর নির্ভর করেন, সেগুলো সংরক্ষণ করা কঠিনতর হয়ে পড়ছে। সৌভাগ্যবশত সরকার কৃষকদের অধিকারের বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। আপনারা কি জানেন, আমাদের সরকার খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে জেনেটিক শস্য সম্পদ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে? তারা বিশ্বের ১৪০টি দেশের সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজটি করেছে। চুক্তিটি আমাদের কৃষি খামারে সংরক্ষিত বীজগুলো সহভাগিতা ও বিক্রি করা এবং আমাদের সনাতন জ্ঞানকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চুক্তিটি বীজ ব্যবহার থেকে উদ্ভুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সহভাগিতার উপকারিতার বিষয়ে আমাদের অধিকারের ব্যাপারটিকেও চিহ্নিত করে।
আরও পড়ুন
কৃষকেরা বলেন, ‘শুধু আমাদের বীজ থেকেই বীজ উৎপাদকরা উপকার পান না বরং আমাদের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থেকেও পান। কারণ আমরা বীজের স্বত্বাধিকারী হিসেবে স্থানীয়ভাবে বীজ উৎপাদন করি বলে তারা আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন। তাই তারা যখন তাদের জাতগুলো নিয়ে আমাদের কাছে আসেন, তারা প্রথম আমাদের অভিজ্ঞতা যাচাই করে দেখেন। তারপর সেগুলো প্রয়োগ করেন। পরিশেষে মনে হয়, তারা তাদের জ্ঞানলব্ধ একটি বিশেষ জাত নিয়ে আমাদের কাছে এসেছেন। কিন্তু আমরাই তাদের সহায়তা করতে পারি। অতএব, আমাদের নিজেদের অধিকার বিষয়ে শেখার ব্যাপারে আমাদেরই নিশ্চিত হতে হবে এবং নিজেদের পক্ষেই আমাদের দাঁড়াতে হবে। সুতরাং আমাদের নিজস্ব স্থানীয় বীজ সক্রিয়ভাবে সংরক্ষণ, প্রয়োগ, বিনিময় এবং বিক্রির ব্যাপারে আমাদের সরকারি আইনগুলোকে সব সময় কাজে লাগাতে হবে।’
কৃষকেরা আরও বলেন, ‘আমি জানি, আমাদের কিছু অধিকার হচ্ছে অন্য উদ্যোক্তাদের মতো; আমাদের, কৃষকদেরও সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের দেশীয় জাতের শস্য সহভাগিতা করার ব্যাপারে একটি উপায় হচ্ছে বীজ মেলা। আমাদের কৃষকেরাও তাদের স্থানীয় বীজ বিনিময় ও বিক্রি করতে আসে। এভাবে ফসল বৈচিত্র্যের সুযোগ সত্যিই অভাবনীয়। আমরা সনাতন শস্যের জাতসমূহ নিয়ে আলোচনা করি। এটি নিশ্চিত করার জন্য, জাতগুলো হারিয়ে যায়নি, আমাদের সন্তানরা এই জাতগুলোর ব্যাপারে জানতে পারবে, সেগুলোকে পাবে এবং সেগুলোকে হারিয়ে ফেলবে না। নারীরা বীজ ও জ্ঞান বিনিময় করে। শুধু শস্য চাষ করার জন্য নয় বরং কীভাবে সেগুলো তৈরি ও খেতে হবে, সে-ব্যাপারেও। বীজ মেলা তরুণদের সুযোগ করে দেয় তাদের জ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে স্থানীয় জাত এবং হারিয়ে-যাওয়া শস্যের জাতগুলো সম্বন্ধে জানতে। এমনকি কেউ-কেউ স্থানীয় জাতগুলোর উৎপাদনে ব্যবসায়িক সুযোগেরও চিন্তা করে থাকেন।
যখন আমি এই বীজ ও খাদ্য মেলা সম্বন্ধে জানতে পারি, তখন আমি অন্যান্য বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য, যেমন- আলু, বাজরা, মেঠো বাদাম এবং শিম উৎপাদনে আগ্রহী হই। এই বীজ মেলা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমি অনেক নতুন জাত দেখতে পেয়েছি। আমি কম বয়সী ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয় জাতের স্থানীয় যব দেখতে পেয়েছি। কিন্তু সেই সাথে আরও দেখেছি কিছু নির্দিষ্ট জাতের শস্য, যেগুলো আমি আগে দেখিনি। আমরা কোনো কিছু হারিয়ে ফেলিনি, কিন্তু আমাদের পিতা-মাতারা যেসব শস্য উৎপাদন করতেন, সেগুলো আমরা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা তরুণ, আমরা এতে অংশ নিতে চাই।’
কৃষকদের অধিকারের প্রতি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে আরেকটি বড় উপায় হচ্ছে কমিউনিটি সীড ব্যাংক। রোপণের সময় যাতে সুবিধা হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষকরা কমিউনিটি বীজ ব্যাংকে স্থানীয় জাতের বীজ জমা করে রাখে। কৃষক বলেন, ‘আমরা যখন বাড়িতে বীজ রাখি, তখন আমরা নির্দিষ্ট কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য এগুলো বিক্রি করার কথা চিন্তা করি। অথবা আমরা মাঝে-মাঝে দেখতে পাই, আপনাদের সন্তানরা রোপণ করার জন্য রাখা বীজ ব্যবহার করে। কিন্তু যখন আমরা বীজ ব্যাংকে বীজ জমা করে রাখি, তখন আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি, আমাদের কাছে বীজ আছে। কারণ যখন বৃষ্টি নামে, তখন আমরা রোপণের জন্য এই বীজ পাই।’
‘কমিউনিটি বীজ ব্যাংক টিকিয়ে-রাখার জন্য সরকারি বীজ আইনে কৃষকদের স্থানীয় বীজ ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া উচিত। দেশের স্থানীয় জাত ও জ্ঞান সম্পদ টিকিয়ে-রাখার জন্য আমাদের সরকারি সমর্থন প্রয়োজন। বীজ সংরক্ষণ এবং সরকারকে তাদের দাবিদাওয়ার কথা শোনানোর জন্য কৃষকদের গ্রুপ বা ক্লাবে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। যাতে তারা যা চায়, তা একই সাথে অনেকের দ্বারা দাবি জানানো হয়। ফলে কৃষকেরা যা চায়, সরকার তা শুনবে। এই গ্রুপগুলো বেসরকারি সংস্থার সাথে একত্রে কাজ করবে এবং একযোগে কথা বলবে। তারা তাদের নিজস্ব স্থানীয় শস্যের বীজ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেবে।’
আসুন, আমরা নিশ্চিত হই, আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণের সময় আমাদের কণ্ঠ যেন জোরালো থাকে। আমরা নিজেদের জন্য যে জাতগুলোর উন্নতি সাধন করেছি এবং আমাদের জন্য যে উপকারী নতুন জাতগুলো প্রচলন করেছি, সেগুলো থেকে যেন আমরা সর্বোচ্চ ফল পাই। সর্বোপরি কৃষকদের অধিকার মানে আমাদেরই অধিকার। আমাদের পরিবার এবং আমাদের দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমরা একত্র থাকবো। কৃষকেরা যদি একসাথে থাকে এবং একই সুরে কথা বলে, তাহলে সরকার কথা শুনবে এবং কৃষকদের অধিকার নিয়ে চর্চা করবে।
এসইউ/এমএস