ভিডিও EN
  1. Home/
  2. কৃষি ও প্রকৃতি

চারা রোপণ ও রিলে পদ্ধতি

পাট চাষে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির সম্ভাবনা

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৪২ পিএম, ০১ অক্টোবর ২০২৩

মুজিবুল হাসান চৌধুরী

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। এটি মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে। বিবিএস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১১.২২ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হলো পাট। কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্যমতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫.০২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপন্ন হয়। পাট প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে আমাদের জন্য আশীর্বাদ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, ১ হেক্টর জমিতে চাষকৃত পাট ১০০ দিনে প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ও প্রায় ১২ টন অক্সিজেন পরিবেশে নির্গত করে। এসডিজি লক্ষ্য ২ এবং টার্গেট ২.৩ অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ২০২১-২০৪১ অনুযায়ী আগামী দুই দশকের মধ্যে কৃষি উৎপাদনের বাণিজ্যিকীকরণকে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বিপরীতে কৃষি জমি বার্ষিক প্রায় ০.১৯ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। কৃষি গবেষকদের মতে, অনুভূমিক (এলাকা সম্প্রসারণ) এবং উল্লম্ব (ফলন বৃদ্ধি) সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে অন্যতম প্রচলিত শস্য বিন্যাস হচ্ছে বোরো-পতিত-রোপা আমন। বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্য বিন্যাসের আওতাধীন ২৩,০৬,০০৫ হেক্টর মাঝারি উঁচু জমি ৮০-৯০ দিন বোরো ও রোপা আমন ধানের মাঝে এলাকাভেদে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত পতিত থাকে। ওই সময়ে বিজেআরআই উদ্ভাবিত উন্নত শস্য বিন্যাস বোরো-পাট-রোপা আমন; বোরো বা পাট-রোপা আমন; বোরো-রোপা পাট-রোপা আমন; প্রতিস্থাপন করে ক্রপিং সিস্টেমের উন্নয়নের মাধ্যমে আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কারণ পাট জাতীয় আঁশ ফসল সাধারণত ১২০ দিন বা ৪ মাস বয়সে সংগ্রহ করা হয় আর পাট বা কেনাফ ফসল বোরোর সাথে ২০-২৫ দিন রিলে আবাদ করে ১১০-১২০ দিনের ফসল কাটা সম্ভব হবে। এছাড়াও ৩০-৩৫ দিনের চারা রোপণের মাধ্যমেও পাট ও কেনাফ আবাদ করা যায়। সে ক্ষেত্রে রিলে ও চারা রোপণের মাধ্যমে এ বিশাল পতিত জমিতে পাটকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দেশের শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পাটের ভিত গড়েছেন বঙ্গবন্ধু

ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, রংপুর, যশোর, বগুড়া, জামালপুর, শেরপুর ইত্যাদি জেলার মোট ফসলি জমির ৩৫-৭০% বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্য বিন্যাস বিস্তৃত। ওই অঞ্চলের শস্য নিবিড়তাও কম। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অন্য অঞ্চলের তুলনায় নিম্নমানের। অর্থাৎ এ অঞ্চলের বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্য বিন্যাসে পাট ফসল অন্তর্ভুক্ত করলে ফসলের উৎপাদনশীলতা ও নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের দরিদ্রতা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে।

এছাড়া একই জমিতে ফসলের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগের অধীনে কৃষকের প্রচলিত শস্য বিন্যাস বোরো-পাট-রোপা আমনের বিকল্প চার ফসলি উন্নত শস্য বিন্যাস বোরো বা পাট-রোপা আমন বা সরিষা (বিকল্প শস্য বিন্যাস-১) এবং বোরো-রোপা পাট-রোপা আমান বা সরিষার (বিকল্প শস্য বিন্যাস-২) তুলনামূলক শস্য বিন্যাস ভিত্তিক ফলন, আয় ও ব্যয় পরীক্ষা করা হয়। ধানভিত্তিক চার ফসলি শস্য বিন্যাসে বোরোর সাথে রিলে এবং রোপা পাট পদ্ধতিতে সফলভাবে চাষ করা সম্ভব হয়েছে। ওই শস্য বিন্যাসের চারটি ফসল মিলে ধানের সমতুল্য মোট ফলন প্রতি হেক্টরে বিকল্প শস্য বিন্যাস-১ এ পাওয়া যায় ১৮.০০ মেট্রিক টন ও বিকল্প শস্য বিন্যাস-২ এ পাওয়া যায় ১৯.৬৬ মেট্রিক টন। অপরদিকে কৃষকের বোরো-পাট-রোপা আমন শস্য বিন্যাসের তিন ফসল মিলে ধানের সমতুল্য মোট ফলন প্রতি হেক্টরে ১৬.৪৫ মেট্রিক টন। কৃষক অনুসৃত তিন ফসলভিত্তিক শস্য বিন্যাসের চেয়ে প্রতি হেক্টরে বছরে মোট আয় ও মুনাফা বোরো বা পাট-রোপা আমান বা সরিষা শস্য বিন্যাসে ৮-৯ শতাংশ এবং বোরো-রোপা পাট-রোপা আমান বা সরিষা শস্য বিন্যাসে ২০-২২ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। নগদ খরচের ভিত্তিতে রিলে ও রোপা পাট পদ্ধতি অনুসৃত শস্য বিন্যাসে এমবিসিআর ২.৫ এর বেশি রেকর্ড করা হয়। সামগ্রিক ফলন এবং অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে কৃষক অনুসৃত তিন ফসলি শস্য বিন্যাসের চেয়ে চার ফসলি উন্নত শস্য বিন্যাস অনুসরণ করে বেশি লাভ করা সম্ভব।

আরও পড়ুন: মানব চিকিৎসায় পাটের ব্যবহার

এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, উৎপাদন বাড়িয়ে কী লাভ? প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে পাটের অবদান ত্বরান্বিত করার অপার সম্ভবনা রয়েছে। এ প্রাকৃতিক তন্তুর রয়েছে নানামুখী ব্যবহার। পাট থেকে তৈরি হচ্ছে বস্তা, চট, জিও ব্যাগ, ওল, হ্যান্ডমেইড পেপার, পাল্প, বিভিন্ন প্রকার প্রসাধনী, জুতা, টিস্যু বক্স, পর্দা, জুটিন, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ নানাবিধ পণ্য। প্রতি বছর বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা আয় করে। পাট থেকে তৈরিকৃত পণ্য পরিবেশের জন্য ভালো। কারণ এটি সহজে মাটিতে মিশে যায় অর্থাৎ জৈব পচনশীল। পাটের আঁশে ৬০-৬৫ শতাংশ সেলুলোজ থাকে। সেই সেলুলোজকে কাজে লাগিয়ে পাট ও পাট জাতীয় আঁশ থেকে মাইক্রোক্রিস্টালাইন তৈরি করা হচ্ছে। যেটি ওষুধ শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পাটকাঠি থেকে এক্টিভ্যাটেড কার্বন এক্সট্রাকশন করে প্রিন্টার ও ফটোকপির কালি উৎপাদন করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির খসড়ায় ২০৪১ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। পাট শিল্পে উৎপন্ন পাটের বর্জ্য ব্যবহার করে জ্বালানি তৈরি করা হচ্ছে। যা আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে কাজ করবে। শুধু আঁশ হিসেবে নয়, পুষ্টির চাহিদা পূরণেও পাট ভূমিকা রাখছে। শাক হিসেবেও পাটের অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে এবং পাটের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ চা। বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) এটি চুকুর হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। এর মাংসল বৃতি (শাঁস) কনফেকশনারি খাদ্যসামগ্রী, যেমন-জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্য খাদ্য উপাদান থাকে।

এলডিসি থেকে ২০২৬ বাংলাদেশের চূড়ান্তভাবে উত্তরণ হবে। এলডিসি থেকে চূড়ান্তভাবে বের হওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণ একটা চ্যালেঞ্জ। সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রতি বছর ২.৭ বিলিয়ন ডলার কমার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ১২% কর সুবিধা হারাবে ইউরোপীয় বাজারে, ৬.৭% বাড়তি ট্যারিফ গুনতে হবে রপ্তানির ক্ষেত্রে। এ প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য পরবর্তী সময়গুলোতে জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট), দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়ন, প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ (প্রিফেরেনসিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট), বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ দক্ষ শ্রমিক শক্তি তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। পাট ও পাটজাত পণ্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা। বাংলাদেশের যে ৫টি পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে, তার মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য অন্যতম। আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০-৮৫% আসে তৈরি পোশাক থেকে। একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। রপ্তানিপণ্য ও বাজারে বৈচিত্রায়ন আনতে হবে। রপ্তানিপণ্যকে সম্প্রসারণ ও উৎসাহীকরণের জন্য ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার বর্ষপণ্য ঘোষণা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালকে ‘পাট বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। যা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে ও উদ্বুদ্ধ করবে।

আরও পড়ুন: পাটের হলুদ মাকড় দমনে নিম পাতা ও বীজের ব্যবহার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করায় অন্য কৃষি ফসলের মতো অল্প সুদে ঋণ সুবিধা ভোগ করবে পাট চাষিরাও। পতিত জমিতে পাট অন্তর্ভুক্তি, রোপা ও রিলে পদ্ধতির মাধ্যমে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণে প্রাকৃতিক তন্তু পাটের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা, আধুনিকীকরণ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বহুমুখীকরণের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। যা ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪১ সালে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথকে প্রশস্ত করবে।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন