বৃক্ষমেলায় গাছের সমাহার
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
আঠারো ইঞ্চি ছোট্ট টবে আম গাছ। পাকা আম ঝুলে আছে। দেখে খানিকটা চমকে যেতেই পারেন। এতটুকু গাছে এত অল্প জায়গায় এমন সুন্দর পাকা আম হতে পারে? আপনার জানা ছিল না একদম। এখন জেনে এমন একটি গাছ সংগ্রহের জন্য আগ্রহ হলো। এটি বারি-৪ জাতের আম গাছ। ছাদে টবে বা ড্রামে লাগানো যায়। আম দেখতে যেমন সুন্দর, তেমন মিষ্টি। দোকানির কাছে সব তথ্য জেনে আপনার তর সইলো না। কিনেই ফেললেন একটি চারা। যেন এতদিন এমন একটি গাছই আপনি খুঁজছিলেন। এতক্ষণ বলছিলাম বৃক্ষমেলার কথা।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বৃক্ষমেলাজুড়ে গাছের সমারোহ। ফলদ, বনজ, ফুলের—কী চাই? সব ধরনের গাছ আছে। কাগজে কলমে স্টল সংখ্যা ১৩১। সরকারি সাতটি এবং ৯০টি বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসব স্টল দিয়েছে। এবার মেলায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার এবং বৃদ্ধদের বিশ্রামের জায়গা রয়েছে। মেলায় প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই বন অধিদপ্এরর কন্ট্রোল রুম এবং তথ্যকেন্দ্রের দেখা মেলে।
বৃক্ষমেলার স্টলগুলো অন্য মেলার মতো নয়। স্টলগুলো কলোবরে অনেক বড়। অনেক জায়গাজুড়ে সাজানো গোছানো। অনেকটা নার্সারির মতো। গাছের নামসহ ধারাবাহিকভাবে সাজানো। যে গাছটি আপনার পছন্দ, বললেই হলো। নার্সারির লোক তা আপনাকে বের করে দেখাবে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে নার্সারি মালিকরা স্টল দিয়েছেন। তাই বৃক্ষমেলায় গাছের প্রজাতির সংখ্যা যেমন বেশি; তেমনই দরদাম করে কেনা যায়। যদিও এবার গাছের দাম কিছুটা বেশি। বলেন স্কুল শিক্ষক জামাল। তিনি প্রতিবারই বৃক্ষমেলায় আসেন। ছোট্ট একটি ছাদবাগান আছে তার।
আরও পড়ুন: যেখানে রং-বেরঙের ফুলের সমাহার
বৃক্ষমেলায় সব বয়সী মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কেউ ফলের, কেউবা ফুলের চারা কিনছেন। কারো পছন্দ ইনডোর প্ল্যান্ট। যতটা লোক সমাগম, ক্রেতা ঠিক ততটা নয়। বলেন একটি স্টলের মালিক নুর হোসেন। তবে শেষ অবধি বিক্রি ভালোই হবে। এমনটা তার আশা ছিল। ফলদ, বনজ, ওষুধি গাছের পাশাপাশি অসংখ্য ফুলের গাছ মেলার অন্যতম আকর্ষণ। নানা জাতের গোলাপ, জবা, বেলি, টগর, নয়নতারা, মধুমালতি, কামিনী, অ্যারোমেটিক জুঁই, বাগান বিলাস, অলকানন্দা, কাঠগোলাপ, রেইন লিলি, কাঁটামুকুট, রঙ্গন নন্দিনী প্রভৃতি। এত এত ফুলের গাছ। নাম বলে শেষ করা যাবে না। আছে সাদা, কমলা, বেগুনি, হলুদ রঙের গোলাপ। পলিপ্যাকে দিব্যি ফুটে আছে জারবেরা। লাল, গোলাপি ও বাদামি রঙের জবা ফুলের দেখা মেলে। অর্কিড নিয়ে যাদের প্রচুর আগ্রহ। তাদের জন্য মেলায় প্রায় শতাধিক জাতের অর্কিড গাছ আছে। অনেকগুলো স্টলে অর্কিড বিক্রি হচ্ছে। আবার কাঁটাময় ক্যাকটাসের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। দাম পাঁচশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। তবে এক বিক্রেতা জানান, ডেন্ড্রোডিয়াম সনিয়া, ডেন্ড্রোডিয়াম সাথো পিঙ্ক, ডেন্ড্রোডিয়াম সাকুরা পিঙ্ক, ডেন্ড্রোডিয়াম হুয়াইট, রেডবল ইত্যাদি জাতের বিক্রি ভালো হচ্ছে।
আজকাল ইনডোর প্ল্যান্টের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছেই। মেলায় অনেকগুলো স্টলে অসংখ্য জাতের, বয়সের ইনডোর প্ল্যান্ট সত্যিই আপনার মন কেড়ে নিতে পারে। মানিপ্ল্যান্ট, নানা রকম পাতাবাহার, লাকি বাম্বু, ইঞ্চ ইত্যাদি গাছ পটে সেট করা অবস্থায় কেনার সুযোগ আছে। বাসায় নিয়ে জায়গামতো ঝুলিয়ে দিলেই কাজ শেষ। গাছ তো কিনলেই হয় না। এর জন্য সার, কীটনাশকের প্রয়োজন তো আছেই। অবশ্য টেনশনের কিছু নেই। দেশের সব বড় বড় সার, কীটনাশক কোম্পানির স্টল আছে। সেখান থেকে যা দরকার, একটু কম দামেই কিনতে পারবেন। সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পাবেন একদম ফ্রি। দেশীয় প্রায় সব ফলের গাছ মেলায় পাবেন। যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু, কামরাঙ্গা, করমচা, জলপাই, আমড়া, শরিফা, ডালিম, জামরুল, সফেদা, কলা, আতাফল। বয়সী গাছের ডাল থেকে কলম করা। এ ধরনের গাছের বাড়তি সুবিধা আছে। এমনটাই বলছিলেন নার্সারি মালিক আব্বাস। তিনি জানান, কলমের গাছে দ্রুত ফলন আসে। যেটা বীজ থেকে হওয়া গাছে আসবে না। অবশ্য হাতে নিয়ে দুই ফুট লম্বা একটা আম গাছ দেখালেন। যেটাতে আমের কড়ি এসেছে। জাত, বয়সভেদে ফলের গাছের বিভিন্ন দাম। সর্বনিম্ন ১০০ টাকা। একটা কথা না বললেই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কেন্দ্রে তুলনামূলক দাম কম। কম যত্নে ছাদে প্রচুর আমের ফলন সম্ভব। সাত থেকে আটটি জাতের আমের গাছ থাকলে প্রায় সারাবছর আম খাওয়া সম্ভব। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ সূর্যডিম এবং ব্রুনাই কিং আম গাছের প্রতি। ব্রুনাই কিং আম ওজনে এক কেজির বেশি হয় বলে জানা গেলো। কেরালা জাতের নারিকেল চারা পাওয়া যায়, দাম ৮০০ টাকা। সুপারি গাছ প্রতিটি ১২০ টাকা।
আরও পড়ুন: গাছ যেভাবে মানুষের উপকার করে
বৃক্ষমেলায় ওষুধি গাছের সমারোহ রীতিমতো নজর কাড়ার মতো। জানা যায়, ১২৯ প্রজাতির ওষুধি গাছ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আকন্দ, ফণিমনসা, নিম, অর্জুন, বাসক, হরিতকি, আমলকি, বহেড়া, কালো তুলসি, কাসুন্দি, লজ্জাবতী, শতমূল। মসলা প্রজাতির গাছের মধ্যে রয়েছে মরিচ, দারুচিনি, আদা, পুদিনা, এলাচ, বিলাতি ধনে আরও কত কী!
তথ্যকেন্দ্রের সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ হাজারের মতো গাছ বিক্রি হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হবে বলেই ধারণা করা যায়। ৫ জুন শুরু হওয়া মেলা চলেছে ২৬ জুন পর্যন্ত। ঈদ উপলক্ষে কয়েকদিন বন্ধ ছিল। ১ জুলাই আবার শুরু হয়েছে, যা শেষ হবে ১২ জুলাই। লম্বা সময় ধরে চলা এ মেলায় পরিবার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। বৃক্ষমেলা ছাড়া এক জায়গায় এত বিপুল গাছের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। গাছ কিনে তা রিকশা, ভ্যান, সিএনজিতে করে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। অবশ্য গাছের সংখ্যা অনেক বেশি হলে নার্সারি মালিক পিকআপ ঠিক করে দেন। খরচটা দিলেই হবে।
লেখক: বৃক্ষপ্রেমী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।
এসইউ/জেআইএম