রাসায়নিক সার ব্যবহার
কমছে জমির উর্বরতা, বাড়ছে খরচ
নওগাঁয় একই জমি থেকে একাধিক ফসল উৎপাদন হওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি কমছে। উর্বরতা বাড়াতে কৃষকরা জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতে একদিকে ফসল উৎপাদন খরচ বাড়লেও অপরদিকে মাটির গুণাগুণ হ্রাস পাচ্ছে। তবে খরচ কমাতে ও মাটির উর্বরতা বাড়াতে পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট।
শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের সীমান্তবর্তী বরেন্দ্র জেলা নওগাঁ। এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল ধান, সবজি ও আম। চাষিরা একই জমি থেকে বছরে একাধিক ফসল উৎপাদন করে থাকেন। একই জমি থেকে একাধিক ফসল উৎপাদন করায় জমি কখনো ফেলে রাখা হচ্ছে না। এতে জমির উর্বরতা শক্তি কমছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৬ হেক্টর (১৯ লাখ ৭০ হাজার ১৪১ বিঘা)। যদি মাটি পরীক্ষা করা হয়, তাহলে কৃষকদের বছরে খরচ বাঁচবে (বিঘাপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে) ২৯৫ কোটি ৫২ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা। সেই সঙ্গে রাসায়নিক সারের ওপর চাপ কমবে। এতে দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: আষাঢ় মাসে পাট চাষে যা করবেন
বছর কয়েক আগেও কৃষকরা জমিতে জৈব সার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতেন। এজন্য বাড়ির পাশে গর্ত করে গবাদিপশুর গোবর, বিভিন্ন উচ্ছিষ্ট, আর্বজনা ও পচা খড় রাখতেন। সেগুলো পচে যাওয়ার পর জমিতে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন জৈব সারের ব্যবহার কমে জেনে বা না জেনে কৃষকরা রাসায়নিক সারের দিকে ঝুঁকছেন। না জেনেই ভালো ফসলের আশায় অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। জমিতে কী পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে, তা তাদের অজানা। এতে জমির উর্বরতা কমছে এবং বাড়তি অর্থের অপচয় হচ্ছে।
মাটি পরীক্ষা করে পরিমাণমতো রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে জমির জন্য যেমন উপকার; তেমনই কৃষকরাও লাভবান হবেন। তবে কোথায় কীভাবে মাটি পরীক্ষা করতে হয়, তা জানেন না তারা। প্রচারণার অভাবে এখনো কৃষকরা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিষয়ে অবগত নন। সরকারি এ সংস্থার কী কাজ অনেকেই এখনো জানেন না। এ সংস্থার বিষয়ে কৃষকদের মাঝে সাড়া জাগাতে ও উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন। ফসল উৎপাদনে যে পরিমাণ সার ব্যবহার করা হয়, মাটি পরীক্ষা করলে তার খরচ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে।
কৃষকরা জানান, প্রতি বিঘা জমিতে ফসলের আবাদে অন্তত ৫ হাজার টাকার রাসায়নিক সার দিতে হয়। এছাড়া কীটনাশক দিতে হয় প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকার। রাসায়নিক সার আর আগের মতো কাজ করে না এবং জমির শক্তিও কমেছে। তবে জৈব সার এখন আর পাওয়া যায় না। জৈব সারে জমির শক্তি বাড়ে, ফলন বেশি হয়, ফসলে পোকা ও জমিতে লোনা ধরে না। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সারের উপকার বেশি হয়।
আরও পড়ুন: লবণাক্ত মাটিতে কেনাফ চাষে সফলতার আশা
বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের কৃষক গোলাম ফারুক বলেন, ‘একই জমিতে পর্যায়ক্রমে বোরো, পাট ও আমনের পর সরিষা বা আলুর আবাদ করা হয়। জমি ফাঁকা থাকছে না। জমিতে রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহার করা হয়। তবে জৈব সার খুবই কম ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক সারে মাটি লোনা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার ফসলে পোকার আক্রমণ হয়ে থাকে। জৈব ব্যবহার করলে মাটি ভালো থাকে এবং ফসলও ভালো হয়। গবাদিপশু কমে যাওয়ায় এখন আর জৈব সার তেমন পাওয়া যায় না।’
একই গ্রামের শাহজাহান আলী বলেন, ‘মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের নাম কখনো শুনিনি। এর কাজ কি জানি না। জমির মাটি কখনো পরীক্ষা করা হয়নি। আমরা ধারণার ওপর জমিতে সার দিয়ে ফসল উৎপাদন করছি। বাপ-দাদার আমল থেকে এভাবেই চাষাবাদ করছি। মাটি পরীক্ষা করলে অব্যশই আমাদের জন্য সুবিধা হবে। সারের খরচও কমবে আমরা লাভবান হবো।’
মহাদেবপুর উপজেলার খোর্দ্দ নারায়ণপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘রাসায়নিক সার আগে যেভাবে কাজ করতো, এখন আর সেভাবে কাজ করে না। আগে জমিতে ১৫ কেজি ইউরিয়া সার দিয়ে আবাদ করা হতো। এখন ২৫ কেজি দিতে হয়। এর গুণগতমান কমে গেছে। জমিতে পরিমাণেও বেশি দিতে হচ্ছে। জমিতে ৩ বার ইউরিয়া সার দিতে। এতে টাকাও বেশি খরচ হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: ভারতীয় মিষ্টি আঙুর চাষে সফল লাভলী
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ অফিসার এ কে এম মনজুরে-মাওলা বলেন, ‘জমিতে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার নিয়ম। তবে প্রতিনিয়ত কমছে তার পরিমাণ। বাংলাদেশে এর গড় পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৩ এর মধ্যে আছে। যা কয়েক বছর আগেও ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। নানা কারণে জমির উর্বরতা কমেছে। কৃষকদের গো-সম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়ায় কমেছে জৈব পদার্থের পরিমাণ। ফসলের নিবিড়তা বিশেষ করে একটি ফসল উৎপাদনের পর আরেকটি ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। এ সময়ের মাঝে জমি রেস্টিং প্রিয়ড (আরাম) পাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘জমিতে একের পর এক ফসল উৎপাদন হওয়ায় প্রতিনিয়ত কমছে জৈব পদার্থের পরিমাণ। কৃষকরা মনে করেন, জমিতে রাসায়রিক সার ব্যবহার করলেই ফলন বেশি হবে। আসলে ফসল উৎপাদন ও জমির উর্বরতা বাড়াতে জৈব সার এবং রাসায়নিক সার সমন্বয় করে ব্যবহার করা প্রয়োজন। ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্ট সারের বাণিজ্যিকীকরণ বেড়েছে। সেখানে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়া জমিতে ধর্ঞ্চা বা ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ করে জমিতে অংশ বিশেষ মিশিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
নওগাঁ আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘বর্তমানে জমিতে ফলনের পরিমাণ কমে গেছে। মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে কৃষক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফলন পাবেন এবং ফসল উৎপাদনের খরচও কমে যাবে। এতে কৃষক দুই ভাবে লাভবান হবেন। জমিতে সুষম মাত্রায় সার দেওয়ায় খরম কমছে এবং বেশি পরিমাণ ফলন পাওয়ায় লাভবান হচ্ছেন।’
আরও পড়ুন: আষাঢ় মাসে ফসলের যত্ন
তিনি বলেন, ‘সরকার ভর্তুকি দিয়ে মাটি পরীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করছে। মাত্র ৬৩ টাকায় মাটির বা জমির ১১টি উপাদান পরীক্ষা করা যায়। এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় ১ হাজার সচেতন কৃষক মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করে আবাদ করছেন। রবি ও খরিপ মৌসুমে বছরে দুইবার ২৫ টাকা ফিতে ভ্রাম্যমাণ সয়েল টেস্ট করা হয়। তবে জনবল কম থাকায় প্রচার-প্রচারণা কিছুটা ধীরগতিতে হচ্ছে।’
আব্বাস আলী/এসইউ/জেআইএম