পরিবেশের ওপর পাটের প্রভাব
ড. জাকারিয়া আহমেদ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের বর্ষপণ্য এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছে। পাট উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ ১ম স্থান দখল করে আছে। পাট হলো একটি প্রাকৃতিক আঁশ, যার পরিবেশগত অনেক সুবিধা আছে। পাট সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উদ্ভিদ এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। ব্যবসায় সাধারণত পাটের দুটি নাম থাকে, সাদা এবং টোসা। কর্কোরাস ক্যাপসুলারিসকে সাদা পাট এবং কর্কোরাস অলিটোরিয়াসকে তোসা পাট বলা হয়। ভারতে ও বাংলাদেশ রোসেলকে সাধারণত মেস্তা বলা হয়।
পাটের পাতাগুলো ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৩.৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত হয়। এর সামান্য তিক্ত স্বাদ আছে কিন্তু চমৎকার পুষ্টিমান আছে। ফাইবার ফসল হিসেবে পাট একটি দ্রুত বর্ধনশীল ফসল, যা পরিপক্ক হতে মাত্র ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। এই সম্পদ একটি বার্ষিক পুনরায় ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস, যেখানে প্রতি ইউনিট জমির ক্ষেত্রে উচ্চ বায়োমাস উৎপাদন হয় এবং পাটজাত পণ্য জীবনচক্রের শেষে মাটিতে জৈব পচনশীল হয়। এই উদ্ভিজ্জ বাস্ট ফাইবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দিকে বর্তমান বিশ্বে যখন সিন্থেটিক উপাদানগুলোকে অনেক সমস্যার মূল ও অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেখানে প্রাকৃতিক ফাইবার পণ্যগুলোকে এর বিকল্প বলে প্রমাণিত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস এবং প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রাকৃতিক আঁশ হিসেবে পাটের অনেক অন্তর্নিহিত সুবিধা আছে; যেমন দীপ্তি, উচ্চ প্রসার্য শক্তি, কম প্রসারণযোগ্যতা, মাঝারি তাপ ও আগুন প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। এটি একটি বায়োডিগ্রেডেবল এবং পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক আঁশ। পরিবেশ রক্ষা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে পাট বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিশ্বব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে, টেকসই এবং আরও পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশবান্ধব পাট ব্যবহারের সুযোগ বেড়েছে। তাই এই সংকট উত্তরণে নবায়নযোগ্য উদ্ভিদ টিস্যু থেকে প্রাপ্ত লিগনোসেলুলোসিক ফাইবারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
পরিবেশগত সেলুলোসিক পাট আঁশের নানাবিধ মূল্য সংযোজন পণ্য উদ্ভাবন (যেমন- পরিপূরক বা প্রতিস্থাপন সিনথেটিক্স, সজ্জা এবং কাগজ, হোম টেক্সটাইল, ফাইবার রিইনফোর্সড কম্পোজিট, স্বয়ংচালিত শিল্প, বিল্ডিং ও নির্মাণসামগ্রী এবং বায়োডিগ্রেডেবল জিও-টেক্সটাইল) দেশের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। এটি বায়োডিগ্রেডেবল এবং পাট গাছের শিকড় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাট গাছের কার্বন-ডাই-অক্সাইড আত্তীকরণ হার আছে এবং এটি প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বায়ু পরিষ্কার করে। পাট একটি শাকও বটে, যা এশিয়া এবং আফ্রিকায়, পাটের পাতা খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুন: পাটের বৈশিষ্ট্য ও গবেষণায় অগ্রগতি
পাট পাতার প্রতি ১০০ গ্রামে; ৪৩-৫৮ ক্যালোরি, ৮০.৪-৮৪.১ গ্রাম পানি, ৪.৫-৫.৬ গ্রাম প্রোটিন, ০.৩ গ্রাম চর্বি, ৭.৬-১২.৪ গ্রাম মোট কার্বোহাইড্রেট, ১.৭-২.০ গ্রাম ফাইবার, ২.৪ গ্রাম ছাই, ২৬৬-৩৬৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৯৭-১২২ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৭.২-৭.৭ মিলিগ্রাম লৌহজাত, ১২ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৪৪৪ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ৬,৪১০-৭,৮৫০ মাইক্রোগ্রাম বিটা-ক্যারোটিন সমতুল্য, ০.১৩-০.১৫ মিলিগ্রাম থায়ামিন এবং ৫৩-৮০ মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড আছে। পাতায় অক্সিডেস এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিডও বিদ্যমান। তাছাড়া, ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ অন্যান্য ফোলাসিন-সমৃদ্ধ সবজির তুলনায় যথেষ্ট বেশি। পাটের বীজে ১১.৩-১৪.৮ শতাংশ তেল থাকে, যাতে রয়েছে ১৬.৯% পামিটিক, ৩.৭% স্টেরিক, ১.৮% বেহেনিক ইত্যাদি।
পাট শাক
কথিত আছে, পাট শাক বা নালিয়া শাক দিয়ে নাকি বৈশাখ মাসে সূচনা হয়। পাট শাক বাঙালির এক সুপরিচিত খাবার। যে শাকের মধ্যে অনেক প্রকার খাদ্য উপাদান রয়েছে। পাট শাকের মধ্যে পুষ্টি উপাদান অনেক। সেই খাদ্য উপাদান আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পুষ্টিগুণের চাহিদা পূরণ করে ও যার তুলনা নেই। সাধারণত বর্ষাকালে পাট শাক চাষ করা হয়। পাট শাক বাংলা বৈশাখ মাসের প্রথম দিক থেকে বের হয়। পাট শাককে গ্রামীণ ভাষায় নালিয়া শাক বলা হয়। এই শাক গ্রামাঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
পাট শাক বা নালিয়া শাক সাধারণত দুই ধরনের দেখতে পাওয়া যায়। এ শাকের পৃথক পৃথক স্বাদ আছে। পাট শাকের পাতার মধ্যে থাকা লাল রঙের পাতাটি মিষ্টি হয় আর সাধারণ রঙের পাতাটি তিক্ত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ তিক্ত পাট শাক সবাই পছন্দ করেন। পাট শাক একটি মুখরোচক খাদ্য। এ শাক শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। পাট শাকে প্রচুর পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফরফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, নিয়াসিন, সেলেনিয়াম ও ভিটামিন বি৬ আছে। পাট শাকে উচ্চমাত্রায় ক্যারোটিন, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও প্রচুর খাদ্য আঁশ থাকে, যা শরীরে খাদ্যগুণ জোগান দিতে সাহায্য করে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাট শাকে পানির পরিমাণ ৮৩.৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, খাদ্যশক্তি বা এনার্জি ৬২ শতাংশ ক্যালোরি, আমিষ বা প্রোটিন ২.৬ গ্রাম, শর্করা বা সুগার ১২.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১৩ মিলিগ্রাম।
পাটের পরিবেশবান্ধব প্রভাব
পরিবেশের ওপর পাটের অনেক ইতিবাচক প্রভাব আছে। এটি অনেক দিক থেকে একটি পরিবেশবান্ধব ফাইবার। এটি পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। পাটের সবুজ পাতা সবজির উৎস এবং শুকনো পাতা জমির উর্বরতা বাড়ায়। পাটের শিকড় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, পাতা ও শিকড় কীটনাশক হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুন: পাট ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালিকাশক্তি
পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশে ২৫% বনভূমি থাকা উচিত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মাত্র ৮% থেকে ৯% বনভূমি। পাটের কাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যা কাঠের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে বন উজাড় কমায়। পাট বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। যা ওজোন স্তরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এটাও বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন নির্গত করে। যা মানব জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করে।
পাট গাছ বাতাসকে বিশুদ্ধ করে
পাট গাছগুলো বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন বায়ুতে নির্গত করে, যা বাতাসের বিশুদ্ধকরণ ঘটায়। পাট গাছ গড়ে ৭৩০২.৩৮ হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। প্রতি বছর বাতাসে ৫৩০৯.৯১ টন অক্সিজেন নির্গত করে।
জমির উর্বরতা
জমিতে পাটের পাতা ও গোড়া পচে জমির উর্বরতা বাড়ায়। পাট গাছে বছরে গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাতা এবং ৪২৩.৪ হাজার টন মূল থাকে, যা পচে মাটির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, জিপসাম, ডলোমাইট, ফেরাস সালফেট প্রদানের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। পাটের আঁশ, কাঠি ও শুকনো পাতা নাইট্রোজেন, ফসফরাস পেন্টক্সাইড এবং পটাশিয়াম অক্সাইড নির্গত করে।
জৈবিক দক্ষতা
পাটের গড় উৎপাদন লাঠি প্রতি বছর ২৪৮০.৬২ হাজার টন। কাঠের জায়গায় পাট দিয়ে কাগজের পাল্প তৈরি করলে উৎপাদন খরচ কমবে। বছর প্রচুর পরিমাণে পাট কাঠি সজ্জা, কাগজ এবং গৃহস্থলির জ্বালানির জন্য ব্যবহৃত হয়।
অন্য শস্যের ওপর প্রভাব
পাট গাছের চাষের জন্য অল্প পরিমাণে সার প্রয়োজন। পাট গাছের গোড়া ও পাতা মাটিতে সতিতে হিসাবে কাজ করে, যা অন্য ফসলের উৎপাদন এবং সারের ব্যবহার কমায়।
আরও পড়ুন: পাটের গবেষণায় নতুন দিগন্ত
শাকসবজি
পাটের পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা সারাদেশে সবজির চাহিদা পূরণ করতে পারে। এতে রয়েছে পুষ্টিগুণ ও হারবাল ওষুধ। পাট পাতায় ভিটামিন-সি বিদ্যমান। এছাড়া আয়রন ও ক্যালসিয়াম আছে। এটি গ্যাস্ট্রিক, আমাশয়, জ্বর ইত্যাদির জন্য হারবাল ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জিও-টেক্সটাইল
কম খরচে প্রকৌশল ক্ষেত্রের ল্যান্ডস্কেপের ক্ষয় রোধ করতে জিও-টেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়। জিও-টেক্সটাইলে আছে অবক্ষয় রোধের বৈশিষ্ট্য। এ সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যটিকে নদী বাঁধ, রাস্তা নির্মাণ, বাঁধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বায়োগ্যাস নির্গমন
পাট পচনের সময় প্রতি কেজি পাটের ফাইবার থেকে গড়ে ১.৪২৮ কেজি মিথেন নির্গত হয়। এটি পরিবারের জ্বালানি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বায়োডিগ্রেডেবিলিটি
পাটজাত পণ্য শতভাগ বায়োডিগ্রেডেবল এবং রিসাইকেবল। সুতরাং এটি একটি পরিবেশবান্ধব এবং পাট সিন্থেটিক ফাইবারের চেয়ে অগ্রাধিকার রাখতে পারে।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
এসইউ/জেআইএম