পাটের জৈবিক ও ফার্মাকোলজিক্যাল ক্রিয়াকলাপ
ড. জাকারিয়া আহমেদ
গাছ মানুষ ও প্রাণীর পুষ্টি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় আশি শতাংশ তাদের ওষুধের প্রাথমিক উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক পণ্য এবং উদ্ভিদ ভিত্তিক ওষুধের ওপর নির্ভর করে। সব ওষুধের প্রায় পঁচিশ শতাংশ, বিভিন্ন প্রজাতির পাঁচশ ভেষজ উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত। স্বাস্থ্যসেবার ক্রমবর্ধমান খরচ, সেইসঙ্গে উচ্চমূল্য এবং কিছু রোগের চিকিৎসায় মূলধারার ওষুধের ব্যর্থতার কারণে রোগ প্রতিরোধে ঐতিহ্যগত ওষুধের ব্যবহার বেড়েছে। তাই বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য একটি আরও স্থিতিশীল এবং কার্যকরী ওষুধ বিকাশের জন্য একটি বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান করে আসছে।
পাট পাতা ওষুধে ব্যবহারের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে পাটের ঐতিহ্যগত ব্যবহার আছে। পাটের ভোজ্য প্রজাতির পাতা প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ। পাটের মূল হল ফাইটোমেডিসিনের একটি শক্তিশালী উৎস, যা কার্যকরভাবে কিছু নির্দিষ্ট রোগের সঙ্গে যুক্ত প্রদাহ এবং পাইরেক্সিয়ার চিকিৎসায় কাজ করে। মাইক্রো এবং ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট ছাড়াও এতে বিস্তৃত বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ আছে। যেমন- গ্লাইকোসাইড, ফেনোলিক্স, ফ্ল্যাভোনয়েড, ট্যানিন, স্যাপোনিন, স্টেরল, ট্রাইটারপেনয়েডস, পোর্ট হাইড্রোম এবং এফএএসি।
এ পদার্থগুলোতে শক্তিশালী অ্যান্টিপাইরাটিক, মূত্রবর্ধক, ব্যথানাশক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিফাঙ্গাল, গ্যাস্ট্রোপ্রোটেকটিভ, অ্যান্টিনোসাইসেপটিভ, অ্যানালজেসিক, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিটিউমারের ক্রিয়াকলাপের বৈশিষ্ট্য আছে। অধিকন্তু পদার্থগুলো আলফা-গ্লুকোসিডেস এবং আলফা-অ্যামাইলেজ ক্রিয়াকলাপকে বাধা দেয় এবং লিভারে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস ও বিটা-অক্সিডেশন বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত।
আরও পড়ুন: পাটের বৈশিষ্ট্য ও গবেষণায় অগ্রগতি
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পাটের বীজে পাওয়া বিরল প্রজাতির এন্ডোফাইট ব্যাকটেরিয়ার (স্টাফাইলোকক্কাস হোমিনিস) জিনোম সিকোয়েন্সিং করে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছে। গবেষণা অনুসারে, ওই ব্যাকটেরিয়া থেকে কমপক্ষে পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ অভিনব অ্যান্টিবায়োটিককে হোমিকরসিন নামে নামকরণ করেছে। এ অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে। উন্নত দেশগুলোয় পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। বৃদ্ধি পায় প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা। পাট উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ ১ম স্থান দখল করে আছে। সরকার পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের বর্ষপণ্য এবং কৃষিপণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছে।
অ্যান্টিটিউমার এবং অ্যান্টিক্যান্সার কার্যকলাপ
পাটের পাতায় ফাইটোল (ক্লোরোফিলের একটি পার্শ্ব শৃঙ্খল) নামক সক্রিয় উপাদান এবং মনো-গ্যালাক্টোসিল্ডি, অ্যাসিলগ্লিসারল শনাক্ত করা হয়েছে। ফাইটোল এবং মনো-গ্যালাক্টোসিল্ডি গ্লিসারল যথাক্রমে এপস্টাইন-বার (ইবি) ভাইরাসের প্রাথমিক অ্যান্টিজেনকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করে। পাটের জলীয় নির্যাসে ক্যান্সার কেমো-প্রতিরোধক এজেন্ট আছে। তাই এটি হতে পারে একটি প্রধান যৌগগুলোর উৎস যে, টিউমার প্রতিরোধী ক্রিয়াকলাপে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
গ্যাস্ট্রোপ্রোটেক্টিভ প্রভাব
পেপটিক আলসার হলো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের একটি এলাকার একটি আলসার, যা অতিরিক্ত অ্যাসিড, মিউকোসাল ডিফেন্সকে ভেঙে ফেলে। পাটের পাতার একটি নির্যাস এনজিওজেনেসিস, কোষের বিস্তার এবং গ্রানুলেশন টিস্যুর পরিপক্কতা বাড়িয়ে আলসার নিরাময়কে ত্বরান্বিত করতে পারে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের গতিশীলতা হ্রাস করে গ্যাস্ট্রিক প্রাচীরের ক্ষতস্থানের ক্ষেত্রফল এবং এডিমা বা শোথের অনুপ্রবেশ হ্রাস করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
আরও পড়ুন: পাট ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালিকাশক্তি
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়াকলাপ
আমাদের দেহের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কারণে মুক্ত (ফ্রি) র্যাডিক্যালগুলো প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়। স্বাভাবিক বিপাকীয় প্রক্রিয়ায়, মুক্ত র্যাডিক্যাল জীবিত কোষের ভেতরে এবং বাইরের বিভিন্ন জৈবিক যৌগের সঙ্গে তাদের মিথস্ক্রিয়ার ফলে রোগগত পরিবর্তন ঘটায়। ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং ক্যানসারের মতো অক্সিডেটিভ স্ট্রেস-সম্পর্কিত রোগের ঝুঁকি কমাতে দেখা গেছে যে, পাটের পাতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতার উচ্চ মাত্রা আছে।
কার্ডিওভাসকুলার ক্রিয়াকলাপ
কর্কোর্টক্সিন (স্ট্রোফ্যানথিডিন) হলো একটি কার্ডিয়াক এবং পাটের বীজ কার্ডিয়াক কার্যকলাপ প্রদর্শন করে। কার্ডিয়াক সমস্যায় ব্যবহৃত সবচেয়ে সক্রিয় ওষুধ হলো অলিটোরিসাইড এবং কর্কোরিসাইড, যা পাট থেকে পাওয়া গেছে।
অ্যান্টিডায়াবেটিক এবং বায়োঅ্যাডরবেন্ট বৈশিষ্ট্য
যেসব উদ্ভিদ প্রোটিনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার এবং কার্বোহাইড্রেট-হাইড্রোলাইজিং এনজাইমগুলোকে দমন করার ক্ষমতাসহ বিভিন্ন পলিফেনলিক যৌগ সমৃদ্ধ, তাদের অ্যান্টিডায়াবেটিক প্রভাবের সম্ভাবনা থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সম্ভাব্যতা ছাড়াও, পাটের সম্ভাব্য অ্যান্টিডিয়াবেটিক ক্রিয়া আছে।
আরও পড়ুন: পাটের গবেষণায় নতুন দিগন্ত
হেপাটোবিলিয়ারি, রেনাল এবং হেমাটোলজিকাল ক্রিয়াকলাপ
ডায়াবেটিস মেলিটাস প্রতিবন্ধী লিভারের কার্যকারিতা হেপাটিক ডেল্টা-অ্যামিনোলেভিউলিনিক অ্যাসিড ডিহাইড্রেটেস কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাটের পাতার নির্যাসে হেপাটোপ্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে লিভারের প্রদাহ উপশম এবং লিভারকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ও সেইসঙ্গে কিছু জটিল এনজাইম সিস্টেমের কার্যকলাপের উন্নতি করে থাকে।
অ্যান্টিকনভালসেন্ট ক্রিয়াকলাপ
পাটের বীজের মিথানোলিক নির্যাস ক্যাটোকোলামাইন এবং মস্তিষ্কের অ্যামিনো অ্যাসিডের মাত্রা পরিবর্তন করে কেমো-কনভালসিভ এজেন্ট প্রভাবিত করে খিঁচুনি থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করে। আর্সেনিক দ্বারা সৃষ্ট মায়োকার্ডিয়াল আঘাতের বিরুদ্ধে পাট পাতার নির্যাস একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার করতে পারে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ক্রিয়াকলাপ
মিউকিলাজিনাস পলিস্যাকারাইডের নির্যাস সব ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া বিরোধী কার্যকলাপের একটি অন্যতম উদাহরণ। পেট্রোলিয়াম ইথার নিষ্কাশিত পাট পাতার নানা প্রকার ব্যাকটেরিয়ার ও হামের ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্রিয়া আছে।
আরও পড়ুন: পাটের আঁশ সংগ্রহের নতুন কৌশল
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী কার্যকলাপ
পাটের একটি জলীয় নির্যাস ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের (প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম) বিরুদ্ধে ও মশার আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী প্রতিরোধ প্রদর্শন করে।
ফাইটোকনস্টিটিউট এবং জৈবিক ক্রিয়াকলাপের কারণে পাটকে ফার্মাসিউটিক্যাল এবং নিউট্রাসিউটিক্যাল শিল্পে একটি বিকল্প উপাদান হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাব্য আছে। এটির অসংখ্য বায়োঅ্যাকটিভ উপাদানের উপস্থিতির কারণে এবং তাদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিক্যানসার, অ্যান্টি-আলসার, অ্যান্টিডিয়া প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন রোগের বিস্তৃতিরোধের কার্যকলাপের কারণে পাটকে ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থে, অ্যান্টিবায়োটিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা প্রাকৃতিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অধিকন্তু তাদের পুষ্টির মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এবং ফোলেটের জন্য মূল্যবান উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, ক্যানসার, আলসার, ডায়াবেটিস, প্রদাহ, নিউরোইনফ্লেমেশন এবং মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে পাটের ব্যবহার মূল্যায়ন করার জন্য আরও সময় উপযোগী ও জনকল্যাণধর্মী গবেষণা প্রয়োজন।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
এসইউ/জেআইএম