পোষা পাখির সঙ্গে একদিন
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
বসন্তের মৃদু হাওয়া বইছে। রোদ থাকলেও সেটা তেমন আর লাগছে না গায়ে। কড়কড়ে রোদ যাকে বলে তা নয়। এমন দিনে সাত সকালে বেড়িয়ে পড়লাম শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে। মেডিকেলে ভর্তি বা অন্য কোনো পরীক্ষার জন্য নয়। পোষা পাখির মেলা হচ্ছে। যা আয়োজন করেছে এভিয়ান কমিউনিটি অব বাংলাদেশ। উদ্দেশ্য মেলা দেখা। সঙ্গে ছোট মেয়েকেও নিয়েছি। পাখি বিষয়ক জানাশেনা থাকলে তার জন্য ভালোই হবে। কে জানতো কাকতালীয়ভাবে মেলার দিনেই মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমন অভিভাবক; তেমন পরীক্ষার্থী। প্রচুর ভিড় ঠেলে ঢুকতে হলো।
ভেতরটায় বড় বড় নানা রকম গাছ। সবুজের কমতি নেই এতটুকু। কিছুটা পথ যেতেই পাখি মেলার বড় সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। সেখানে এভিয়ানের বড় লেগোও ছিল। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ ছবি তুলে নিচ্ছিলেন। আর দশ কদম পড়েই সেই ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, যেখানে পাখির প্রতিযোগিতা ও মেলা হচ্ছে। দেরী না করে ঢুকতেই চোখ আটকে গেলো। ডানে সুন্দর এক মঞ্চ। বড় পর্দায় এভিয়ানের নানা কার্যক্রম দেখানো হচ্ছে।
এভিয়ান কমিউনিটি অব বাংলাদেশ হলো পোষা পাখিপ্রেমীদের সংগঠন। যারা পোষা পাখির উন্নয়নেই শুধু নয় বরং বন্যার সময় অসহায়দের, করোনার সময় দুস্থদের সাহায্য করার মতো মানবিক কাজ করেন। আবার বন্যপাখি যেন মানুষ না পোষে; সে জন্যও তাদের কাজের শেষ নেই।
আরও পড়ুন: ফাহমিদার শখের পাখিতে সফলতা
হল রুম পেরিয়ে ভেতরে যেতেই মনে হলো, যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি। পোষা পাখির ডাকে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। লম্বা টেবিলের ওপর খাঁচায় সুন্দর করে সাজানো নানা রঙের পাখি। হাতের ডানপাশে ফিঞ্চ, ককাটেল প্রজাতির পাখি, মাঝের সারিতে বাজরিগার, টারকুইজিন, ম্যাকাওসহ কত শত পাখি। ককাটেল পাখিগুলো মিষ্টি সুরে শিস দিয়ে যাচ্ছিলো। দুটি লাভবার্ড একে অপরের গা খুটে দিয়ে ভালোবাসার জানান দেয়। ম্যাকাও কড়া সুরে ডেকে হয়তো বলছিলো, ‘এত মানুষ তার ভালো লাগছে না।’ গোল্ডিয়ান ফিঞ্চের নৃত্য মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো মানুষ। একজন তো বলেই বসলেন, ‘এত সুন্দর গেয়ে নেচে মেয়ে বন্ধুকে আহ্বান তো মানুষও করে না।’
দশনার্থীদের কেউ কেউ পাখির সঙ্গে খুনসুঁটিতে মেতে ওঠেন। ফিঞ্চ, বাজরিগার, লাভবার্ড, ককাটেল, নিওফেমা প্রজাতির পাখিগুলো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছিল। তাদের জন্য উপেযোগী খাঁচায়। পাখির সঙ্গে থাকা এক্সপার্ট দিচ্ছিলেন দশনার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব। আন্তজার্তিক পাখির শোগুলোয় ঠিক এভাবেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী পাখি সাজানো থাকে। ঠিক সে কারণেই কি না এভিয়ানের কর্মকর্তারা বলছিলেন, এটি আন্তজার্তিক মান বজায় রেখে করা হয়েছে। পাঁচ ধরনের পাখির প্রতিযোগিতায় যাদের বিচারক করা হয়েছে। তাদের অনেকেই বিশ্বখ্যাত পোষা পাখি এক্সপার্ট দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিচারের কলা-কৌশল তারা ভালোই জানেন। এমনটিই এভিয়ানের কর্মকর্তারা জানান।
এভিয়ান কমিউনিটির প্রচার সম্পাদক সাইফুর রহমান মিল্টন জানান, পাখির জন্য কেজ, লাঠি, পানির ফিডার, খাবারের বাটি এবং মিনারেল ওয়াটারের ব্যবস্থা তারা করেছেন। মিলনায়তনের হাতের ডানে ম্যাকাও পাখিসহ নানা রকম বড় পাখি দেখা যায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাখির দোকানের মালিক হাসান রাজ বলছিলেন ম্যাকাও পাখি নিয়ে নানা কথা। ম্যাকাও অন্য সব পাখির মতো বাংলাদেশে ভালোই ডিম, বাচ্চা দিচ্ছে। পোষা পাখিপ্রেমীদের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে তিনি জানান। হাসান রাজের স্টলে সব বড় বড় পাখি দেখা যায়। দর্শনার্থীরা প্রচুর ভিড় করছিলেন সেখানে।
আরও পড়ুন: কবুতরের প্যারাটাইফয়েড রোগ প্রতিরোধের উপায়
পোষা পাখিমেলায় লরি, কনুইর, কাকাতুয়া, ডায়মন্ড ডোভ, ফরপাস, রিংনেক, ম্যাকাওসহ অনেক দৃষ্টিনন্দন পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক পাখিপ্রেমী তাদের সেরা পাখিগুলো নিয়ে মেলায় এসেছেন। বরিশাল থেকে আসা মনির জানান, বিভিন্ন প্রজাতির পোষা পাখি দেখার সুযোগ সব সময় হয় না। এই মেলা সে সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি একদমই তা মিস করতে চাননি।
গৃহবধূ ইশরাত জাহান ইভা তো সারাবছর অপেক্ষায় থাকেন। কখন এমন মেলা হবে। তিনি বাসায় ফিঞ্চ পাখি পোষেন। শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ মেলায় দেখা যায়। এদিকে মেয়ে পাখি পছন্দ করে। তাই সরকারি কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন মেলায় এসেছেন। মেলা যেন তার মন ভরিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখানে না এলে কোনো দিন জানাই হতো না। এমন সুন্দর সব পোষা পাখি আমাদের দেশে আছে।’
মেলার নানা জায়গায় পোষা পাখি নিয়ে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, টিভি মনিটরে পাখি দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। পাখি দেখতে দেখতে গলা শুকিয়ে গেলে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য আছে খাবারের দোকান। তবে দাম বাইরের দোকানের মতোই। একদমই বেশি না। মিলনায়তনের মধ্যে সামনের দিকে ছোট্ট দুটি পাখি সবার নজর কাড়ে। টেম বার্ড (পোষ মানানো) পাখি দুটি যে কেউ হাতে নিয়ে ছবি তুলতে পারছিলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা চললেও ভরদুপুরেই পাখিপ্রেমীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ধরনের মেলা শুধু পোষা পাখি সম্পর্কে মানুষকে উৎসাহিতই করে না, পাশাপাশি যারা পাখি উৎপাদন করেন; তাদের আগ্রহী করে তোলে। করোনাসহ নানা কারণে পাখির ব্রিডারদের মধ্যে ঝিমুনিভাব চলে এসেছিল। যা এখন কেটে যাবে। এমনটাই বলছিলেন মির্জা ফেরদৌস গালিব। তিনি অর্গানাইজিং সেক্রেটারি এভিয়ান কমিউনিটির।
আরও পড়ুন: যেভাবে কোয়েল পালন করলে বেশি লাভবান হবেন
সৌখিন পাখিপ্রেমীদের সংগঠনটি গত ১০ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো এভিয়ান এক্সেটিক বার্ড শো এবং ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩ আয়োজন করে। এভিয়ান কমিউনিটি ২০১৫ সালে ফেসবুক গ্রুপ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত পাখিপ্রেমীরা এভিয়ানের এ সুন্দর আয়োজনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই পোষা পাখি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। বাংলাদেশেও এমন সুযোগ আছে। পোষা পাখি পালনে বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। আবার গৃহিণী ও শিক্ষার্থীরা পাখি পালন করে হাতখরচের টাকা আয় করতে পারেন। এ রকম নানা সম্ভাবনার কথা বলছেন এভিয়ান কমিউনিটির অভিজ্ঞ পাখি পালকরা।
মধ্য দুপুরে মেলা থেকে বের হলেও মন চাইছিল আরও কিছুটা সময় থাকি। এমন পাখিময় পরিবেশ যেন মনে এক পশলা শান্তির পরশ বইয়ে দিয়েছিল। এক পৃথিবী ভালো লাগা নিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালাম। কামনা করি, ভালো থাকুক পোষা পাখি। ভালো থাকুক পোষা পাখিপ্রেমীরা।
লেখক: পোষা পাখি পালক।
এসইউ/এমএস