তিস্তাপাড়ের কৃষকরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন
প্রতি বছর তিস্তাপাড়ের মানুষ বন্যা, নদীভাঙন ও খরার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এ বছরও কয়েক দফা বন্যার পর শেষ মুহূর্তে এক বন্যায় কৃষকের আশার গুড়ে বালি পড়েছে। গত ২০ অক্টোবরের আকস্মিক বন্যায় তিস্তা-তীরবর্তী পাঁচ উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
নদীভাঙনের সঙ্গে উঠতি ফসলের ওপর বালুচাপা আর কোথাও ভাঙনে ভেসে গেছে আবাদি জমি ও ফসল। এতে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। তারপরও তিস্তায় সব হারানো কৃষকরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
ডিসেম্বরের শেষ মুহূর্তেই তিস্তার পানি শুকিয়ে গেছে। মরা তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে ধু-ধু বালুচর। যৌবনহারা বালুময় তিস্তার বুক সবুজ হতে শুরু করেছে। সেই সবুজে ফসল বুনতে শুরু করেছেন কৃষকরা। কপালে চিন্তার ভাঁজ থাকলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের।
এবার তিস্তাবেষ্টিত পাঁচ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২৮ হাজার কৃষককে প্রণোদনার আওতায় এনেছে সরকার। পাঁচ উপজেলায় এবারের বন্যায় ২ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমির রোপা আমন, ১০০ হেক্টর জমির ভুট্টা, ৯০ হেক্টর জমির কাঁচামরিচ, আলু, পেঁয়াজ, ১০০ হেক্টর জমির চিনাবাদাম, কুমড়া, ডালক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। এতে ২০৪৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে।
সরেজমিনে লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর, আদিতমারি উপজেলার চর গোবর্ধন, বালাপাড়া, কুটিরপাড় এবং কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা, চর বৈরাতী, ভোটমারী, শৈইলমারী, হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি, গড্ডিমারি, পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ি, সিন্দুর্না, সানিয়াজান,পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম তিস্তার চরসহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দেখা গেছে তিস্তার আকস্মিক বন্যার পর পানি নামার ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠেছে।
আশপাশে এখনো পড়ে আছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর। তিস্তার বালুতে চাপা পড়ে আছে কৃষকের ফসলি ক্ষেত। কৃষকরা কাঁচি ও কোদাল দিয়ে সেই বালু সরানোর চেষ্টা করছেন। পানি সরে যাওয়ার পর বালু সরিয়ে নতুন করে ফসল বুনতে শুরু করছেন কৃষকরা। কোথাও কোথাও শীতকালীন সবজির ক্ষেতসহ মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, পেঁয়াজ, আলুসহ নতুন ফসল রোপণ করছেন কৃষকরা। এর মধ্যে তিস্তার চরে গজাতে শুরু করছে বিভিন্ন ফসল।
সবজি ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত রহিমা বেওয়া বলেন, ‘এক বন্যায় সব ভাসি গেইছে এখন নতুন করে চরের মধ্যে আলু, পেঁয়াজ, কুমড়া, ভুট্টা লাগাছি। আলু তোলার পর বাদাম লাগামো। হামার কষ্ট ১২ মাস। বন্যা আর খড়ায় হামাক কষ্ট করে ফসল ঘরে তুলতে হয়। আবাদ না করলে খামো কি? হামার মতো গরিবের আর কোনো উপায় নাই।’
কালীগঞ্জ উপজেলার চর বৈরাতী, ভোটমারী ও শৈইলমারীর কৃষকরা বলেন, অসময়ে তিস্তার আকস্মিক বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি। তাদের ধান, আলু, সবজি, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেনায় পড়েছেন অনেক পরিবার। তারপরও নতুন করে চাষাবাদ শুরু করেছেন। বালুচর এখন তাদের জন্য আশীর্বাদ। এই চরের বালু মাটিতেই ফলবে সোনার ফসল। ঘুরে যাবে করোনা আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাগ্যের চাকা।
ভোটমারির কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ভালো বীজ পাওয়া যায় না। এ্যলা বীজের সমস্যা। তারপরও ভুট্টা লাগাইছি দুই একর মাটিত। বর্তমানে সারের দাম বাড়ছে। সরকার যদি এটা নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে হামারগুল্যার আবাদ সুবাদ করতে সুবিধা হইবে। চরের বুকোত এ্যলা যত আবাদ দেখোছেন, সোগে অভাবী মানুষেরা করছে। এই আবাদের ফসল ব্যাচে হামাক সংসার চলা লাগবে।’
সিন্দুর্না চরের আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভুট্টা চাষ করার জন্য ১০ বিঘা জমি তৈরি করছি একদিনে বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। পরি গিয়ে দেখি জমিতে বালু পড়েছে এক হাঁটু পর্যন্ত। এখন হাতাশায় ভুগছি।’
তিস্তার পাড়ের কৃষক জামাল হোসেন বলেন, ‘হামার একটা দাবি তিস্তা নদীর বাঁধ চাই। সরকার হামার তিস্তা নদীর শাসন না করিলে এই রকম ক্ষতি হইতে থাকপে।’
একই এলাকায় সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘হামার আবাদি জমি সোগ তলে গেচলো। আলু, শাক-সবজি, কুমড়ার ক্ষেত পচি গেইছে। অসময়ে বানোত হামার মেলা ক্ষতি হইলে কিন্তু কায়ো হামাক তাকায় না। কৃষি অফিস থাকি নাম লেখি নিয়্যা গেইছে।’
হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার চরাঞ্চলে ফসলের আবাদ ভালো হয়েছিল। আকস্মিক বন্যায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সাধারণত এসময় বন্যা হয় না। তবে এখন কৃষকরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। তাদের কৃষি অধিদপ্তর থেকে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, লালমনিরহাটে রবি মৌসুমে ছয়টি ফসলের যেকোনো একটির জন্য ২৮ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ উপজেলার প্রায় ১৬ হাজার কৃষক এই প্রণোদনার আওতায় আসবে। এতে কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন ফসলের সার ও বীজ সহায়তা দেওয়া হয়।
রবিউল হাসান/এমএমএফ/এমএস