কম জমিতে বেশি ফসলে আ. খালেকের চমক
গ্রামের অন্য দশজন চাষি যখন কৃষি কাজকে অলাভজনক বলে হতাশা ব্যক্ত করেন, ঠিক তখনই একই গ্রামের অন্য একজন চাষি কৃষি কাজ করে দারুণ লাভবান হচ্ছেন। শুধু নিজ গ্রাম ও পাবনার আটঘরিয়া উপজেলায় নয়, তিনি দেশ সেরা চাষির স্বীকৃতি পেয়েছেন। অথচ অন্যদের তুলনায় তার চাষের জমি অনেক কম ছিল। জমির পরিমাণগত দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও উন্নত বীজ উৎপাদন এই চাষি আব্দুল খালেককে এগিয়ে দিয়েছে।
তিনি উন্নত বীজ উৎপাদন ও বিক্রি করায় অন্য চাষিরাও বেশ ফলন পাচ্ছেন। এভাবে তিনি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন। আর এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কৃষিতে সর্বোচ্চ পদক বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক পদক লাভ করেছেন।
চাষি আ. খালেকের এমন সাফল্যের কথা জানতে কথা হয় তাদের খামারে। চাষি আ. খালেক জানান, ১৯৯৮ সাল থেকে অর্থ্যাৎ, গত দুই যুগ ধরে তিনি উন্নতমানের কৃষি বীজ উৎপাদন করে চলেছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কৃষি বীজ উৎপাদন করলেও তার সংগৃহীত বীজ পাবনা জেলার নয়টি উপজেলাসহ সিরাজগঞ্জ ও নাটোর, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চাষিরাও আগ্রহ ভরে কিনছেন। তার বীজে রয়েছে বিশ্বস্ততা ও সর্বশেষ ছাড়কৃত জাতের নিশ্চয়তা। একই চাষি বার বার তার কাছ থেকে বীজ কিনছেন।
চাষিদের আগ্রহ লক্ষ্য করে তিনি সারাদেশে বীজ সরবরাহের পরিকল্পনা করেছিলেন প্রায় দুই যুগ আগে। তার শ্রম সেই স্বপ্নকে সফল করেছে। তিনি এখন ভিত্তি বীজ উৎপাদন করেন। বীজ প্রত্যয়ণ এজন্সি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর তার উৎপাদিত বীজ মানসম্মত বলে সার্টিফাই করে। সে বীজ পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার উত্তরচক গ্রামের চাষি আ. খালেকের সাফল্যের স্বীকৃতিও দেশ দিয়েছে। তিনি ২০১৭ সালে কৃষিতে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক পেয়েছেন। বিদেশেও কৃষি সফরের সুযোগ পেয়েছেন। এর আগে ২০০৮ সালে তিনি চাষি পর্যায়ে উন্নতমানের ধান, গম ও পাটবীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চাষি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কবে থেকে এবং কেন বীজ উৎপাদন শুরু করলেন, কেমন লাভবান হলেন? এর জবাবে শিক্ষিত চাষি আ. খালেক জানালেন, ‘এইচ.এস,সি পাশের পর কৃষি কাজ শুরু করি। শুরু থেকেই ইচ্ছা ছিল কৃষি কাজ করলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই করব।’ ভালো বীজে ভালো ফসল, এই নীতি অনুসরণ করেই কৃষি কাজ শুরু করেছিলাম।’ ব্যক্তিগত জীবনে সাফল্য লাভ করি।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩ থেকে ৪ বিঘা জমিকে দুই যুগের ব্যবধানে ২৫ বিঘায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন বলেও জানালেন তিনি। তিনি আরও জানান চাষি পর্যায়ে মানসম্মত বীজের বড় অভাব। এ বিষয়টির খেয়াল করেই তিনি বাণিজ্যিকভিত্তিতে কৃষি বীজ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হয় তার বীজ উৎপাদন কর্মসূচি।
চাষি খালেক তার খামারে সর্বশেষ ২৫- ২৬ বিঘা জমিতে বীজ উৎপাদন করেছেন। এর মধ্যে তার কিছু জমি লিজ নেয়া রয়েছে। তিনি গত মৌসুমে ব্রি ধান- ২৮, ২৯, ৫৮, ৮৯ এর ভিত্তি বীজ উৎপাদন করেছেন। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট তাকে ভিত্তি বীজ উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে।
তিনি ৩০ বিঘা জমিতে গমের সর্বশেষ ছাড়কৃত বারি- ২৮, ২৯, ৩৩, ৩৬ জাতের বীজ উৎপাদন করেছেন। তিনি বীনা মুগ ৮ এর বীজ উৎপাদন করেছেন। তিনি বারি তিল ৮, মসুর এর বারি- ৬, ৮ জাত এর বীজ উৎপাদন করছেন।
আজ থেকে এক যুগ আগে তিনি তিনি সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো বা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ভিত্তি বীজ সংগ্রহ করতেন। পরে নিজ খামারে বীজ উৎপাদন করতেন। এখন নিজেই ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে কৃষির বীজ বিভাগের কাছে বিক্রি করছেন। এতে তিনি লাভবান হচ্ছেন, অন্য চাষিরাও উপকৃত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে তার উৎপাদিত বীজ তিনবার বাছাই করেন। উত্তমরূপে শুকানোর পরই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করেন।
বাজারজাত করার আগে জার্মিনেশন পরীক্ষা করেন। জার্মিনেশন ৯০ শতাংশের উপরে থাকলে সেটা বাজারজাত করেন। অবশ্য সব সময়ই তার বীজের জার্মিনেশন খুবই ভালো বলে তিনি জানালেন। উত্তমরূপে প্যাকেজিং ও বাজারজাতকরণের জন্য তার নিয়োজিত লোকজন সার্বক্ষণিক কাজ করেন।
অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বীজ উৎপাদন কেমন লাভজনক? এ প্রশ্নে চাষি খালেক জানালেন বীজ উৎপাদন করে তিনি সাধারণ কৃষির তুলনায় দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণ লাভবান বলে জানান। আ. খালেক শুধু একজন আধুনিক চাষিই নন, তিনি একজন সফল প্রশিক্ষকও বটে। আই. পি. এম এবং আইসিএম প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি কয়েক হাজার চাষিকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
শুধু প্রশিক্ষক নন তিনি আইপিএম এর একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী। তার বাড়িতেই দেশের সর্বপ্রথম আইপিএম ক্লাব গঠিত হয়। সে ক্লাব ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ উদ্বোধন করেছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক এম এনামুল হক। সে ক্লাবটিকে কৃষি তথ্য সার্ভিস এখন ডিজিটালাইজড করে দিয়েছে। তিনি এখন আইএফএমসি (সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট) এর প্রশিক্ষক।
চাষি খালেক তার বাড়িটিও একটি অনুপম কৃষি খামারে পরিণত করেছেন। করেছেন বনায়ন, গড়ে তুলেছেন একটি মিশ্র ফলের বাগান। তার সব দৃষ্টান্তমূলক কাজের জন্য ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১ ও ২০০২ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চাষি এবং ২০০৮ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চাষির পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া ২০০৮ সালে পাবনার এক বিশেষ কৃষি মেলায় তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম তাকে বীজ উৎপাদনে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ সেরা চাষির পুরস্কার দেন।
২০০৮ সালে তিনি বীজ উৎপাদনে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চাষির পুরস্কার পান। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাতে থেকে কৃষিতে সর্বোচ্চ পদক বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক লাভ করেন। বিদেশে সরকারিভাবে কৃষি সফরের সুযোগ পান। সাংসারিক উন্নতির পাশাপাশি নিজের সন্তানদেরও শিক্ষিত করছেন। এখন তিনি অনেকটা নির্ভার। বাড়ি থেকে বের হয়ে বীজ প্লট দেখভাল করা, বীজ সংরক্ষণ ও কেনাবেচা করতেই তার সময় কেটে যায়।
শিক্ষিত তরুণ চাষি পলাশ কুমার সেন জানান, তিনি চাষি খালেকের প্রতিবেশী। এজন্য তিনি জানেন চাষি আব্দুল খালেক উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ করে চলেছেন। তিনি নিজেও চাষি খালেকের কাছ থেকে বীজ কেনেন। তার কাছে থেকে বীজ কিনে সব সময়ই ভালো ফলন পেয়ে আসছেন বলে জানান।
পাবনার অন্য এক কৃষি কর্মকর্তা আ. খালেক ( পিপিআই খালেক) জানান, চাষি খালেক অল্প জমি দিয়ে অধিক আয় করা একজন বীজ উৎপাদনকারী। তিনি জানান, চাষি খালেক আইপিএম ক্লাবের একজন প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। তিনি কৃষিতে বীজ উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করে সফল হয়েছেন।
শুধু নিজে সফল নন তিনি দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিরবে অবদান রেখে চলেছেন। তার গ্রামের চাষিরা অনেক সময় সর্বশেষ ছাড়কৃত জাত না পেয়ে পুরোনা জাতের ফসল চাষ করে থাকেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরোনা জাতগুলো ধীরে ধীরে উৎপাদন ক্ষমতা হারাতে থাকে।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের কৃষিতে। কিন্তু চাষি খালেক সর্বশেষ ছাড়কৃত জাত এনে তার চাষ করে বীজ রাখেন। সে বীজ সংরক্ষণ করে চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। এতে উভয় পক্ষই লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে বলে জানান চাষি খালেক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক আব্দুল কাদের জানান, খাদ্য উৎপাদনে পাবনা জেলা এগিয়ে। চাহিদার চেয়ে জেলায় বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয়। এর নেপথ্যে ভালো বীজের ভূমিকা রয়েছে। তিনি জানান, জমিতে চাষ, সার-বীজ ও পরিচর্যা ঠিকমতো করার পরেও যদি ভালো বীজ রোপণ বা বপন না করা হয় তাহলে ভালো ফলন আশা করা যায় না।
এক্ষেত্রে দেশের বীজ উৎপাদনকারী নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে। এছাড়া চাষি পর্যায়েও উন্নত বীজ উৎপাদন করে চলেছেন অনেকে। তিনি জানান, এক্ষেত্রে সবার আগে আটঘরিয়ার চাষি আব্দুল খালেকের উদাহরণ দেয়া যায়। তিনি উন্নত বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন বলে জানান।
আমিন ইসলাম জুয়েল/এমএমএফ/এমএস