সোনালি আঁশের সোনালি দিন
দেশের সোনালি আঁশখ্যাত পাট-শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘ ১০ বছর খাতা-কলমে সম্পর্ক ছিল। এ ১০ বছর হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার সময়। এ সময়ে ধাপে ধাপে পাটের রচনা মুখস্থ করেছি। পাটের গুরুত্ব সম্পর্কে জেনেছি। পাটকে যে বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল বলা হয় সেটাও জেনেছি।
আমরা জানি, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অর্থাৎ এ দেশে হয়তো অন্য দেশের মতো খুব বেশি খনিজ সম্পদ নেই। আমাদের সম্ভাবনার জায়গা আছে। সেই সম্ভাবনা আমার দেশের মাটি। আমরা এ মাটিকেই সোনার চেয়ে খাটি বলে আখ্যায়িত করি। কারণ এ মাটিতেই তো সোনা ফলে। কৃষিপ্রধান দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ এ মাটি।
কাজেই দেশের সম্ভাবনাময় কৃষিখাত অন্য দেশের জন্য রোল মডেল হওয়া প্রয়োজন। আমি যেহেতু অর্থকরী ফসল পাট দিয়েই শুরু করেছি; সেহেতু একটু পাট নিয়েই বিস্তারিত বলতে চাই। বাংলাদেশের পাটের বাজার মূলত দেশের বাইরে। কাজেই পাট রফতানি করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করায় রফতানিতেই জোর সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশের বাজারেও পাটের চাহিদা আছে।
এ বছর করোনা মহামারিসহ নানা সংকটের মধ্যে পার হচ্ছে দেশের কৃষিখাত। বিভিন্ন জেলায় বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, অতি বর্ষণ এবং শিলাবৃষ্টির কারণে ব্যাহত হয়েছে কৃষি উৎপাদন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের সোনালি আঁশ খ্যাত পাটশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। চলতি অর্থবছর রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানেও রয়েছে পাট।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনা মহামারির মধ্যেও পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯.২৬ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯.২৬ শতাংশ বেশি। এ শিল্পে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১১.৮৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করে, যা ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮.১০ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের তিন মাসে ২১ কোটি ৮ লাখ ২ হাজার ডলারের পাটসুতা রফতানি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ ৫ হাজার ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩.৬১ শতাংশ। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৯ হাজার ডলার। আয় বেড়েছে ৩৮.৩৩ শতাংশ। পাট ও পাটসুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২ হাজার ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.৬৩ শতাংশ।
এ ছাড়া ২ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ডলার পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮.১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটসুতা রফতানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রফতানি ৬৪ শতাংশই এসেছিল পাটসুতা রফতানি থেকে। কাঁচাপাট রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছিল ১৯ কোটি ডলার।
দেশের পাট-শিল্পের এমন ঘুরে দাঁড়ানোর সাফল্য বলে দিচ্ছে, মানুষ এখন পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এ বাজারের চাহিদাও বাড়ছে। আমাদের কাঁচা পাটও রফতানি বাড়ছে। পাশাপাশি পাটের তৈরি ব্যাগ, চট, থলেসহ পাট ও পাটসুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রফতানিও বাড়ছে। আমাদের এখন সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। শুধু পাট-শিল্পই নয়, দেশের কৃষিখাতের আরও সম্প্রসারণ করা খুব জরুরি। আমাদের যা নেই তা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই, যা আছে তার পরিচর্যা করা উচিত। তার শতভাগ ব্যবহার করা উচিত।
আমরা যদি নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি, কৃষকদের প্রয়োজন মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি তাহলে আমাদের কৃষি শিল্পের সম্প্রসারণ করতে পারব। কৃষিখাত সম্প্রসারণ হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ কৃষিপণ্য চাহিদার ব্যাপারে অন্য দেশ থেকে আমদানির কথা ভাবতে হবে না। কৃষিপণ্যে কারও ওপর নির্ভর করে চলতে হবে না। আমরা এ শিল্পকে বৈদেশিক বাজারেও সম্প্রসারণ করতে পারব। দেশের মাটি যে সোনার চেয়েও খাটি, তা একটু একটু করে বিশ্বে দেখাতে পারব।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।
এসইউ/এএ/জেআইএম