গ্রামে গ্রামে লিচুর উৎসব, চাষিদের মুখে হাসি
‘জ্যৈষ্ঠের গরম আর গগণের ডাক/ এলো বুঝি বৃষ্টি বুনো হাঁসের ঝাঁক/ ঝড়ো ঝড় বাতাসে ফুটলো কদম/ শালিকের ঝাঁকগুলো তুললো রিদম/ প্রকৃতির সাজে আজ জ্যৈষ্ঠের কৃষ্টি/ আম-জাম-কাঁঠালের অপরূপ দৃষ্টি।’ কবি কবিতার ছন্দে জ্যৈষ্ঠের বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন। গ্রীষ্মের দ্বিতীয় মাস জ্যৈষ্ঠ। বাহারি রঙের বিভিন্ন ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরে তুলেছে চারপাশ। বছরজুড়ে কম-বেশি ফল পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এ মাসে। সুস্বাদু ফলের সরবরাহ বেশি থাকায় সবার কাছে মাসটি ‘মধুমাস’ নামেই পরিচিত। মধুমাসের ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম লিচু। রসে টইটুম্বুর এ ফলের নাম শুনলেই জিভে জল আসে। আর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে এখন লিচু ঘিরেই চলছে ব্যস্ততা। এ যেন লিচুর উৎসব।
বাদুড়ের কবল থেকে লিচু রক্ষায় রাত জেগে পাহাড়া দেওয়া, দিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গাছ থেকে লিচু নামানো ও থোকা বাঁধার পরে তা গাড়িতে করে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যাওয়া। লিচুকে ঘিরে এমনভাবে ব্যস্ত গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গ্রামের সাধারণ মানুষ। উঁচু চালা জমি সমৃদ্ধ শ্রীপুরের রসালো লিচুর কদর রয়েছে দেশজুড়েই। জেলাজুড়ে প্রায় ৫০ হাজার কৃষক এই লিচুকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে শ্রীপুরের কিছু এলাকায় লিচুর ভালো ফলনের পথে প্রতিবন্ধকতা হলেও অন্যান্য এলাকায় ফলন হয়েছে অন্যবারের চেয়ে ভালো। জ্যৈষ্ঠ মাসের ভরা মৌসুমে এখন লিচুকে ঘিরেই এখন ব্যস্ত গাঁয়ের কৃষাণ-কৃষাণী।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, জেলার সবচেয়ে বেশি লিচুর আবাদ হয় শ্রীপুর উপজেলায়। এছাড়াও কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, কালিয়াকৈর ও গাজীপুর সদর উপজেলায় লিচুর আবাদ হলেও স্বাদের দিক দিয়ে শ্রীপুরের লিচুর ভিন্নতা থাকায় এর চাহিদাও বেশি। এবার জেলাজুড়ে ১৪শ’ ৩৭ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত হয়েছে ২৭ হাজার ৩৭৫ মেট্রিক টন। এদিকে প্রতিনিয়ত গাজীপুরের লিচুর চাহিদা বাড়ায় প্রতিবছরই জেলাজুড়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে লিচু চাষ। এ চাষে কৃষকের রুচির ভিন্নতার সাথে জাতেরও পরিবর্তন হয়। এখানে আবাদ হচ্ছে চায়না-৩, বোম্বাই ও পাতি লিচু।
আরও পড়ুন > পেয়ারা চাষ করে যেভাবে সফল হলো দুই বন্ধু
শ্রীপুরের টেপিরবাড়ি গ্রামের লিচু চাষি আজমল হুদা বলেন, ‘এবার লিচু গাছে মুকুল আসার পর ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক চাষি। আমাদের গ্রামসহ পাশের কেওয়া গ্রামেও গাছ থেকে লিচু পাওয়া যায়নি। তবে অন্যান্য এলাকায় লিচুর ভালো ফলন হয়েছে। লিচুর ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। বাজারে এখন প্রতিটি লিচু বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা থেকে ৩ টাকা দরে।’
বারতোপা গ্রামের স্কুল শিক্ষক কবির হোসেন বলেন, ‘ফলনের দিক দিয়ে এবার লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। বাগানে উৎপাদিত লিচু কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বাগান থেকে সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য নিয়ে যান স্থানীয় বাজারগুলোতে। তবে অনেকে ভালো দাম পাওয়ার আশায় চলে যান রাজধানীতেও। জ্যৈষ্ঠ মাস পুরোটা সময়ই লিচু পাওয়া যায়। এবার অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভালো ফলন ও দাম পাওয়া যাচ্ছে।’
রাজাবাড়ি গ্রামের লিচু চাষি আহাম্মদ আলী জানান, লিচু চাষ ঘিরেই তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এখানকার লিচুর কদর থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা মুকুল আসার সাথে সাথে বাগান কিনে নেন। তিনি এবার তার বাগানের ২০টি গাছের লিচু বিক্রি করেছেন লক্ষাধিক টাকায়।
দক্ষিণ বারতোপা গ্রামের গৃহবধূ আকলিমা খাতুন জানান, তাদের ৩টি গাছ রয়েছে। তাই পরিবারের লোকজন নিয়ে নিজেরাই গাছ থেকে লিচু সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। এবার শ্রীপুরের বাজারগুলোতে লিচু আসছে প্রচুর।
আরও পড়ুন > একটি আমের দাম ৬ হাজার টাকা
কাপাসিয়ার রাণীগঞ্জ বাজারের লিচু ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পরিপক্ক হওয়ার পর গাছে বেশি দিন লিচু রাখা যায় না, লিচুর মৌসুমও হয় সংক্ষিপ্ত। একসময়ে সব লিচু বাজারে আসায় আশানুরূপ দাম পাওয়া যায় না। তাই লিচু সংরক্ষণে সরকার উদ্যোগ নিলে সবাই উপকৃত হতো।’
গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কৃষকদের লিচু চাষ সম্প্রসারণে উদ্বুদ্ধ করায় প্রতিনিয়ত বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে লিচু চাষ। এবার জেলাজুড়েই লিচুর ভালো ফলন হয়েছে। ভোক্তা পর্যন্ত বিষমুক্ত লিচু পৌঁছার ব্যাপারে আমরা প্রথম থেকেই নজরদারি করেছি। লিচু চাষ থেকে কয়েক কোটি টাকা আয়ের মাধ্যমে গাজীপুরের গ্রামীণ অর্থনীতির ভীত শক্তিশালী হচ্ছে।’
শিহাব খান/এসইউ/জেআইএম