বিপর্যয়ের মুখে উপকূল
১৬টি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, জোয়ার-ভাটা উপকূলীয় অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সাথে লড়াই করেই উপকূলের মানুষ টিকে আছে। এর মাঝে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে উপকূলের মানুষ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের ১০টি জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের শীর্ষ ঝুঁকিতে। ১০টি জেলার মধ্যে উপকূলের জেলাই ৭টি! ঝুঁকির শীর্ষে থাকা উপকূলের সাতটি জেলা হলো- কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, বরগুনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। যা শুধু উপকূল নয়, সমগ্র বাংলাদেশকে মহাসংকটে ফেলে দিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। বদলে গেছে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ধরনও। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ও বজ্রপাতের তাণ্ডবও বেড়ে গেছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু উপদ্রুত এলাকা (হটস্পট), জীবনমানের ওপরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে।
চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ ক্ষতির দিক থেকে শীর্ষে থাকবে। বরিশাল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপেয় পানির সংকটও তীব্র। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা যোগ হয়ে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলবে।
> আরও পড়ুন- ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর হবে সুনামি
সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি, দরিদ্রতা ও বিপুল পরিমাণ অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে উপকূলের সর্বদক্ষিণের জনপদ কক্সবাজারের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই জেলার আর্থিক ক্ষতি ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ার বিপদই বেশি।
সমুদ্রপৃষ্ঠের একদম কাছাকাছির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর, তেল শোধনাগারসহ অনেক বড় বড় অবকাঠামোও বেশ হুমকির মুখে। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার পরিমাণও বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবেলার সক্ষমতাও এই বিভাগের মানুষের খুব কম।
বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। এই বিভাগে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসও সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে। অতীতের ধ্বংসলীলা তাই প্রমাণ করে। ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১২ সালে মহাসেনের আঘাত এখানকার জনজীবনকে বিপন্ন করেছে। এখনো এর ক্ষত বয়ে চলতে হয় এ অঞ্চলের মানুষকে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের প্যনেল, নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। বিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা না গেলে বিপর্যয় দেখা দেবে। তাপমাত্রা এর নিচে রাখার বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও সুযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিয়ন শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা। সম্মেলনে ১৯৫টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
> আরও পড়ুন- হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির বাসা
আইপিসিসির সহ-সভাপতি অধ্যাপক জিম স্কেয়া বলেছেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রির চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে পারলে ব্যাপক উপকার পাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব কমাতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শক্তিব্যবস্থা, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানো যাবে।’ এর আগে জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। তবে এবার গবেষকরা বলছেন, শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।
ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘এতে খরা, জলোচ্ছ্বাস, অতিরিক্ত গরম ও লাখো মানুষের দারিদ্র্যের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও জীবিকায় বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে। মানুষ বাড়ি-ঘর হারিয়ে শহরে আশ্রয় নেবে। আমরা এ সংকট মোকাবেলায় কতটুকু প্রস্তুত? এ সংকটা দিন দিন আরো বেড়েই চলছে।’
উপকূলবন্ধু রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তনে উপকূল অঞ্চলের মানুষ চরম নিগ্রহের সাথে বসবাস করছে। দ্বীপ-চরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় এখানকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয়। অতএব জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এখনই দ্রুত প্রদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
এসইউ/এমএস