ঘড়িয়াল বিলুপ্তির গবেষণা সঠিক নয়
আশির দশকে বাংলাদেশের যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীতে প্রচুর ঘড়িয়ালের দেখা মিলতো। কিন্তু ঘড়িয়ালকে ভয়ংকর প্রাণী ভেবে মানুষ নির্বিচারে মেরে ফেলায় এখন আর তেমন দেখা যায় না। এরা এখন মহা বিপন্ন প্রাণী। আমাদের দেশে ঘড়িয়াল বিলুপ্ত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ২০১৩ সালে কয়েকজন জীববিজ্ঞানী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞ একমত হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ থেকে প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়েছে।
অভিযোগ আছে, দেশি-বিদেশি কিছু গবেষক মাঠে কাজ না করে এবং সঠিক তথ্য না জেনেই প্রকাশ করেন ঘড়িয়াল বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তা যে ভুল ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে গত কয়েক বছরে। সর্বশেষ গত ২৮ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে যমুনা নদীতে মাছ ধরার সময় গভীর রাতে উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলে জেলেদের জালে একটি ঘড়িয়াল ধরা পড়ে।
গবেষকরা বলছেন, যমুনা থেকে ধরা ঘড়িয়ালটির বয়স আনুমানিক ২ বছর। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে এরা এখনো বংশ বিস্তার করছে। এর আগে ২০১৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের পদ্মায় জেলেদের জালে ধরা পড়ে আরেকটি ঘড়িয়াল। অথচ মহা বিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘড়িয়াল ইতোমধ্যে লাল বইয়ে (Red Data Book of IUCN) নাম লিখিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে খুবই সামান্য কিছু ঘড়িয়াল অবশিষ্ট আছে।
> আরও পড়ুন- হারিয়ে যাচ্ছে চশমাপরা হনুমান
শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ঘড়িয়াল বিলুপ্তির পথে। মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশ থেকে এই প্রাণীটি বিলুপ্ত হচ্ছে। এর পেছনে বড় একটি কারণ হচ্ছে, আমাদের জেলেরা অসচেতন। তাই যখন তাদের জালে ঘড়িয়াল আটকা পড়ে; তখন তারা পিটিয়ে মেরে ফেলে। কারণ তাদের ধারণা, যেহেতু ঘড়িয়াল দেখতে কুমিরের মতো, তাই হয়তো তারা কুমিরের মতো ভয়ংকর। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ঘড়িয়ালরা মানুষখেকো হওয়া তো দূরের কথা, এগুলো মানুষের ধারে-কাছেও ঘেঁষে না। ঘড়িয়াল শুধু মাছ, সাপ, ব্যাঙ ছাড়া অন্যকিছু খায় না। এভাবে ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক ঘড়িয়ালকে জেলেদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। যা তাদের বিপন্ন হওয়ার অন্যতম কারণ।
আরেকটি কারণ প্রজননে সমস্যা। ঘড়িয়াল মিঠা পানির প্রাণী হলেও প্রজননকালে ডিম পাড়ে চড়ে উঠে। কিন্তু বাংলাদেশের চড়ে উঠে ডিম পাড়লেও ঘনবসতির কারণে নদী থেকে পাড়ে উঠে থাকতে পারছে না। কখনো মানুষের হাতে মারা পড়ে আবার কখনো মানুষ তাদের ডিম নষ্ট করে ফেলে। এছাড়া কুকুর, শেয়াল ডিম খেয়ে ফেলে।
২০১০ সালে ঘড়িয়াল কনজারভেশন ইন বাংলাদেশের উদ্যোগে একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন রাজশাহী বিভাগের বন কর্মকর্তা মোল্লা রেজাউল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বদলি হওয়ার কারণে আমি আমার প্রজেক্ট চালিয়ে যেতে পারিনি। তবে ধারণা করতে পারছি এখনো দেশে প্রায় ৪০টি ঘড়িয়াল টিকে আছে। পদ্মা নদীর রাজশাহীর পবা, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, যমুনা নদীর চর উত্তর কোন্নাবাড়ি ও চর খিজিরপুরকে ঘড়িয়ালের জন্য সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করলে ঘড়িয়ালের বংশ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।’
> আরও পড়ুন- ঝুঁকিতে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য
ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ও প্রাণিগবেষক আদনাদ আজাদ আসিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘড়িয়াল আমাদের দেশে এখনও প্রজনন করছে। আমাদের উচিত কিছু সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিত করে, সেখানে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। এমনকি স্থানীয় মাঝিদের প্রচুর কাউন্সিলিং করতে হবে।’
জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক প্রাণিবিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেটা ভুল ধারণা। যেহেতু এরা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী, তাই এদের রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’
এসইউ/জেআইএম