বিষধর সাপের নাম রাসেল ভাইপার
পৃথিবীর সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে কিন্তু একমাত্র কিলিংমেশিন খ্যাত রাসেল ভাইপারের সে বৈশিষ্ট্য নেই। বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেল ভাইপারের অবস্থান ৫ নম্বরে কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে তার অবস্থান প্রথমে। এরা আক্রমণের ক্ষেত্রে এতই ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের ভেতরে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই রাসেল ভাইপারের কামড়ে মারা যায়। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। রাসেল ভাইপারের বিষ হোমটক্সিন, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়।
ভয়ংকর এই রাসেল ভাইপারের বাংলা নাম চন্দ্রবোড়া। তবে রাসেল ভাইপার নামেই বেশি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii। এরা একেবারে সামনে থেকে মাথা উঁচু করে কামড় বসায়। এদের বিষের এত তিব্রতা যে, খুব কম রোগী বাঁচে। যে স্থানে কামড় দেয়; সে স্থানে পচন শুরু হয়। অনান্য সাপের বেলায় ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলে রোগীকে নিরাপদ ভাবা হয় কিন্তু রাসেল ভাইপারের বেলায় রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে মারা গেছে এমন রেকর্ডও আছে।
রাসেল ভাইপার যে মানুষকে কামড়ায় তাকে বাঁচানো খুবই কষ্টকর। অনেক সময় বিষ নিস্ক্রিয় করা গেলেও দংশিত স্থানে পচন ধরে। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগী মারা যান। পচা অংশ কেটে ফেলার পরেও জীবন বাঁচানো যায় না। দ্রুত পচন ধরে সারা শরীরে। এর অসহিষ্ণু ব্যবহার ও লম্বা বিষদাঁতের জন্য অনেক বেশি লোক দংশিত হন। সাপটির বিষক্রিয়ায় অত্যাধিক রক্তক্ষরণ ঘটে এবং অনেক যন্ত্রণার পর মৃত্য হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে হার্ট অ্যাটাকে অনেকের মৃত্যু হয়।
> আরও পড়ুন- পরিবেশের জন্য বাঘ বাঁচাতে হবে
অন্যান্য সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে কিন্তু হিংস্র রাসেল ভাইপারের শিকারকে শুধু একা নয়, তার পুরো পরিবারসহ খেতে ভালোবাসে। তাই অন্যান্য সাপ যেমন একটি ইঁদুরকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে, রাসেল ভাইপার সে ক্ষেত্রে কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড বিষের যন্ত্রণায় ইঁদুর যখন তার গর্তের দিকে ছুটে চলে রাসেল ভাইপার তার পিছু পিছু গিয়ে সে গর্তে ঢুকে সব ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে।
এরা দেখতে অনেকটা অজগরের মত। তবে এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪ থেকে ৫ ফুট হয়। তবে চলতি মাসে চাপাইনবাবগঞ্জে এলাকাবাসী একটি রাসেল ভাইপারকে মেরে ফেলে যার দৈর্ঘ্য ৮ ফুট। এত লম্বা রাসেল ভাইপার পৃথিবীর কোথাও এর আগে দেখা গেছে এমন কোন তথ্য নেই। বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র এলাকাসহ পদ্মার তীরবর্তী প্রতিটি এলাকায় এদের দেখা যায়। গত কয়েক বছরে এদের উপস্থিতি খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ধারণা ছিল, এরা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাঝে ২৫ বছর এদের দেখা মেলেনি কিন্তু প্রায় ২৫ বছর পর আবার দেখা মেলে ২০১২ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে। সে বছর এর বিষে শুধু চাপাইনবাবগঞ্জে মারা যায় ১৫ জন। গবেষকদের ধারণা, ২৫ বছর বিলুপ্ত থাকার পরে বন্যার পানিতে ভেসে ভারত থেকে এই সাপ বাংলাদেশে এসেছে। কারণ পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় এ সাপের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
২০১৩ সালে আবারো রাজশাহীতে দেখা মেলে সাপটির। এ পর্যন্ত এসব অঞ্চলে গত কয়েক বছরে এ সাপের কামড়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষক। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হয়েছে ধানক্ষেতে। তবে সাধারণত ঝোঁপ-ঝাড়, শুকনা গাছের গুড়ি, ডাব গাছের নিচে, গোয়াল ঘরে এ সাপ থাকতে বেশি পছন্দ করে।
তবে চরিত্রগতভাবে এ সাপ স্থলে যতটা ক্ষিপ্র, পানিতে ততই দুর্বল থাকায় বন্যার পানিতে ভেসে আসা নিয়ে বিতর্ক আছে। রাসেল ভাইপার বংশ বিস্তার করে খুব দ্রুত। অন্যান্য সাপ যেখানে ২০ থেকে ৪০টা ডিম দেয়, সেখানে একটি রাসেল ভাইপার ৮০টা পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে রাসেল ভাইপার।
> আরও পড়ুন- হারিয়ে যাচ্ছে চশমাপরা হনুমান
পনেরো বছর যাবৎ ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির পাশাপাশি বন্যাপ্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন আদনান আজাদ আসিফ। তিনি জাগো নিউজকে জানান, সাপুড়ে বা অন্য কোন মাধ্যম থেকে এই সাপকে দেখে এর ধারণা পাওয়া যাবে না। তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘এ পর্যন্ত চারবার বুনো পরিবেশে এ সাপের মুখোমুখি হয়েছি। সামনা-সামনি না দেখলে বোঝা যাবে না এ সাপ কতটা ভয়ংকর এবং দুসাহসী।’
তিনি আরও জানান, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে এ সাপের আক্রমণ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ওই এলাকার মাটি এবং রাসেল ভাইপারের গায়ের রং প্রায় এক। তাই অনেক সময় না দেখেই মানুষ কাছে চলে যায়। তাই এ সাপ দেখলে নিরাপদে সরে যাওয়াই উত্তম। তবে কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে এর থেকে বাঁচা সম্ভব-
১. আশেপাশে পরে থাকা পুরাতন গাছের নিচে খেয়াল না করে হাত দেবেন না।
২. ধান কাটার সময় গামবুট ব্যবহার করবেন।
৩. ধান কাটা শুরুর আগে হাড়ি-পাতিল বা অন্য কিছু দিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করবেন, যেন সে ভয়ে পালিয়ে যায়।
৪. যেহেতু এরা খুবই হিংস্র, তাই যেসব এলাকায় বেশি দেখা যায়; সেসব এলাকায় সচেতনভাবে চলাফেরা করা।
৫. এ সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে সামনে থেকে সরে যাওয়া।
জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে জানা যেত না, তাই হয়তো জানতে পারতাম না কখন কোথায় কোন সাপের দেখা মেলে। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের কারণে মুহূর্তেই জানতে পারছি এবং পরিচয়ও শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। ২৫ বছর বিলুপ্ত ছিল এই মতের সাথে আমি একমত নয়। তবে রাসেল ভাইপার খুবই হিংস্র। এদের থেকে বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে।’
ভিডিও দেখুন-
এসইউ/জেআইএম