জেনে নিন আখ চাষের পদ্ধতি : শেষ পর্ব
আখ অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। আখ থেকে চিনি, গুড় এবং রস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট আবাদকৃত জমির ২.০৫% আখের আবাদ হয় যার পরিমাণ ১.৭০ লাখ হেক্টর। মিলজোনে ০.৮৬ লাখ হেক্টর এবং ননমিলজোনে ০.৮৪ লাখ হেক্টর। আসুন আখ চাষের পদ্ধতি জেনে নেই-
রস পরিষ্কারক
৩০০-৩৫০ গ্রাম বনঢেঁড়স বা শিমুল গাছের শেকড় ও ছাল থেতলে ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রাপ্ত নির্যাস প্রতি কড়াই (২০০-২২৫ লিটার) আখের রসের সঙ্গে মিশিয়ে উন্নত গুড় উৎপাদন করা যায়। রস জ্বাল দেওয়ার সময় কড়াইতে প্রচুর গাঁদ ভেসে ওঠে। দ্রুত হাতল দিয়ে সরিয়ে ফেলার পর ভেষজ নির্যাস ব্যবহার করতে হবে। এতে রস স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অধিকতর স্বচ্ছ হয় এবং গুড়ের সার্বিক গুণগত মান বাড়ে।
হাইড্রোজ ব্যবহার
স্বাস্থ্যহানীকর এ রাসায়নিক দ্রব্য পৃথিবীর কোনো দেশেই খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহারের অনুমতি নেই। এ রাসায়নিক দ্রব্য গুড়ের রং উজ্জ্বল করতে অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হাইড্রোজযুক্ত গুড় দেখতে বেশি পরিষ্কার, সাদা রঙের। গুদামে রাখলে অল্পদিনেই কালচে রং, উৎকট গন্ধ ও তিক্ত স্বাদযুক্ত হয়।
মান সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণ
বর্ষা মৌসুমে বাতাস থেকে পানি শোষণ করে গুড়ের মান নষ্ট হয়। এ অবস্থা থেকে গুড়ের মান ও স্বাদ বজায় রাখা, বেশিদিন ধরে গুড় মজুদ এবং সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে-
গুড় সংরক্ষণের তুলনামূলক খরচ কম, বিধায় অধিকাংশ গুড় প্রস্তুতকারীগণ মাটির পাত্রেই গুড় সংরক্ষণ করেন। রং করা মাটির পাত্রে মোম বা মাটি দ্বারা পাত্রের মুখ ভালো করে বন্ধ করে গুড় সংরক্ষণ করলে দীর্ঘদিন গুড় ভালো থাকে। পাটের ছালার ভেতরে স্বচ্ছ স্যালোফেন কাগজ বিছিয়ে প্যাকেট করে গুড়ের মান রক্ষা করা যায়। আখের শুকনো পাতা, ধানের তুষ ইত্যাদি গুদামে রক্ষিত গুড়ের বিভিন্ন স্তরে ব্যবহার করে, বর্ষাকালে ধানের তুষ পুড়িয়ে গুদামে ধোঁয়া দিয়ে গুড়ের মান ভালো রাখা যায়। গুদামে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড বা কালিচুন আর্দ্রতারোধক হিসেবে ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে গুড় গুদামজাত করা যেতে পারে।
চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ
বর্তমান দেশে আবাদকৃত জাতসমূহের মধ্যে সার্বিক বিবেচনায় উৎকৃষ্ট সিও-২০৮, বনপাড়া গ্যান্ডারি, অমৃত, সিও-৫২৭, মিশ্রিমালা, কাজলা জাতগুলো চাষ হয়। উঁচু জমি উত্তমরূপে চাষ করে সারি থেকে সারি ১.২৫ মিটার এবং চারা থেকে চারা ১.০০ মিটার দূরে চারা রোপণ করতে হবে। এতে প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০ হাজার চারার প্রয়োজন হবে। দেরিতে রোপণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে চারার দূরত্ব কমাতে হবে। চারা রোপণের আগে পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করতে হবে। এলাকা ভিত্তিক সারের মাত্রা তারতম্য হলেও ভালো ফলনের জন্য ইউরিয়া-২৭০, টিএসপি-২০০, জিপসাম-১৫০, দস্তা-৮ কেজি ব্যবহার করতে হবে। জৈব সার এবং টিএসপি সমুদয়, ইউরিয়া এক-তৃতীয়াংশ এবং পটাশ অর্ধেক রোপণের আগে, বাকিিএক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক পটাশ উপরি প্রয়োগ করতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রতি ঝাড়ে ৮-১০টি কুশি বের হলে গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। আখের পুরনো পাতা ছড়িয়ে প্রতিটি গাছ পরিষ্কার রাখতে হবে। হেলে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে একাধিক ঝাড় একত্রে বেঁধে দিতে হবে। খরার সময়ে সুযোগ থাকলে জমিতে ৩-৪ বার সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইপ্সিত ফলনের জন্য পোকা এবং রোগ দমন ব্যবস্থা অপরিহার্য। চিবিয়ে খাওয়া আখের বলয়ে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রতিটি আখ পৃথকভাবে বাছাই করে বিক্রি করা হয়। উঁইপোকা, আগাম মাজরা পোকা, শেকড়ের মাজরা পোকা ও কাণ্ডের মাজরা পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। উঁইপোকা দমনের জন্য লরসব্যান, কাণ্ডের মাজরা পোকার জন্য ফুরাডান ব্যবহার করা যায়। এছাড়া পাতা ও আক্রান্ত গাছ কেটে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের মাধ্যমে ও সন্তোষজনকভাবে পোকা দমন করা সম্ভব। রোগ প্রতিরোধী জাতের সুস্থ-সবল রোগমক্ত তাপ শোধিত বীজের বংশজাত বীজ ব্যবহার করে, রোপণের আগে বীজআখ ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে এবং আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ভাদ্র মাস থেকে চিবিয়ে খাওয়া আখ কর্তণ ও বাজারজাত শুরু হয়, যদিও আজকাল সারা বছরই কমবেশি আখ পাওয়া যায়। আখ কাটার সময় মাটির সমতলের ৩-৬ ইঞ্চি নিচে কোদালের সাহায্যে কেটে ডগাসহ কয়েকটি পাতার অর্ধেকাংশ রেখে ভালোভাবে পরিষ্কার করে বাজারজাত করা হয়।
যে আখ চাষ লাভজনক
একবিঘা বা ৩৩ শতাংশ জমিতে চিবিয়ে খাওয়া আখের আবাদের আয়-ব্যয় হিসেব করলে তা সহজেই বোঝা যাবে। রোপা পদ্ধতিতে ৩৩ শতাংশ জমিতে ২,৫০০ আখের চারা রোপণ করা যায়। প্রতিচারা থেকে ৫টি করে আখ উৎপাদন করতে পারলে মোট ১২ হাজার ৫শ’টি বিক্রয়যোগ্য আখ উৎপাদন করা যাবে। যার উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা। বাজারে একটি চিবিয়ে খাওয়া আখ ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। উৎপাদনকারী পাইকারদের কাছে অনায়াসে প্রতিটি আখ ১০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তাহলে একবিঘায় উৎপাদিত ১২ হাজার ৫শ’টি আখের বিক্রয় বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে প্রায় ১ লাখ টাকাই লাভ।
এসইউ/জেআইএম