জেনে নিন আখ চাষের পদ্ধতি : দ্বিতীয় পর্ব
আখ অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। আখ থেকে চিনি, গুড় এবং রস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট আবাদকৃত জমির ২.০৫% আখের আবাদ হয় যার পরিমাণ ১.৭০ লাখ হেক্টর। মিলজোনে ০.৮৬ লাখ হেক্টর এবং ননমিলজোনে ০.৮৪ লাখ হেক্টর। আসুন আখ চাষের পদ্ধতি জেনে নেই-
বীজতলায় চারা উৎপাদন
বীজতলার মাটি ভালোভাবে কুপিয়ে পরিচর্যার সুবিধার জন্য ৪-২৪ ফুট এবং ৬ ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট বীজতলা তৈরি করতে হবে। প্রতিটি বীজতলার মাটিতে ৭৫ কেজি গোবর-কম্পোস্ট সার ৫০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম পটাশ সার মেশাতে হবে। এক একরের জন্য এ রকম ৪টি বীজতলা প্রয়োজন যাতে দু’চোখ বিশিষ্ট ১২ হাজার বীজখণ্ড স্থাপন করা যায়। উঁইপোকা এবং মাজরাপোকা দমনের জন্য প্রতিটি বীজতলায় ৬০ গ্রাম লরসবান এবং ২৫০ গ্রাম ফুরাডান ৫জি মেশাতে হবে।
বীজতলায় ‘বাডচিপস’ দ্বারা চারা উৎপাদন করতে হলে বীজতলায় পর্যাপ্ত ছাই মিশিয়ে বীজতলার মাটি নরম করতে হবে এবং বীজতলার উপর থেকে আধা ইঞ্চি পরিমাণ মাটি পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। এরপর বীজতলায় বাডচিপস ছড়িয়ে দিয়ে চোখ উপরে রেখে পাশাপাশি সাজিয়ে দিতে হবে। এবার সরিয়ে রাখা মাটি বীজতলার বীজের উপর আবার বিছিয়ে দিতে হবে। এবার হালকা পানি ছিটিয়ে খড়-কুটা দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। পরে ২-৩ দিন পর পর পানি ছিটাতে হবে। ১০-১৫ দিন পর খড়-কুটা সরিয়ে নিয়মিত পানি দিতে হবে।
গাছচারা
এ পদ্ধতিতে মূল জমিতে রোপণের প্রায় ৩০-৪০ দিন আগে জমিতে দণ্ডায়মান আখের মাথা কেটে দিলে পার্শ্ব কুশি গজাবে। পার্শ্ব কুশি যাতে বেশি বড় না হয়, সে জন্য মাঝে মাঝে পার্শ্ব কুশির পাতা ছেঁটে দিতে হবে। এ সব পার্শ্ব আখ থেকে আলাদা করে স্টকলেস অবস্থায় প্রয়োজনীয় হরমোন ট্রিটমেন্ট করে মূল জমিতে রোপণ করা যায়। ধানের চারার মতো আঁটি বেঁধে এ চারা সহজেই কম খরচে পরিবহন করা যায়।
আরও পড়ুন- জেনে নিন আখ চাষের পদ্ধতি : প্রথম পর্ব
স্টকলেস চারা
বীজতলা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্টকসহ চারা তুলে নিতে হবে। এরপর ধারালো ছুরি দিয়ে আখখণ্ড থেকে চারাগুলো আলাদা করে পাতার ২-৩ অংশ ছেঁটে দিতে হবে। গাছচারা সংগ্রহ করে একইভাবে পাতা ছেঁটে নিতে হবে। এবার ১ লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম নেফথালিন অ্যাসিটিক অ্যাসিড বা আলফা নেফথালিন অ্যাসিটিক অ্যাসিড দ্রবণে চারার গোড়া ৪৮-৭২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখলে চারার গোড়ায় দ্রুত শিকড় গজাবে এবং ক্ষেতে রোপণ করা যাবে।
চারা রোপণ
চারা ৪ পাতাবিশিষ্ট হলেই জমিতে রোপণ উপযোগী হবে। সাধারণত ১ মাস বা ততোধিক যেকোন বয়সের চারা রোপণ করা যেতে পারে। বীজতলা থেকে চারা উঠানো এবং জমিতে নেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন চারা ভেঙে না যায়। চারা উঠানোর সময় যেটুকু মাটি শেকড়ের সঙ্গে উঠে আসে, তা রোপণ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে চারা দ্রুত লেগে যায় এবং নতুন শেকড় তাড়াতাড়ি গজায়। এ জন্য যে জমিতে চারা রোপণ করা হবে তার আশেপাশেই বীজতলা তৈরি করা উচিত। চারা শুকিয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য রোপণের আগে সমস্ত চারার পাতার ২-৩ অংশ অবশ্যই কেটে দিতে হবে। ৮-১০ ইঞ্চি গভীর নালায় চারা রোপণ করে দেড়-দুই ইঞ্চি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে রোপণের পর পরই সেচ দিতে হবে। সেচ সুবিধা না থাকলে চারার গোড়ায় ২-৩ দিন কলসী বা ঝাঝরি দিয়ে সেচ দিতে হবে। অক্টোবর মাসের মধ্যেই চারা মূল জমিতে রোপণ করা উত্তম। কারণ এ সময়ে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। চারা রোপণের ৮-১০ দিনের মধ্যেই কোন চারা মারা গেলে বোঝা যাবে। শূন্যস্থান পূরণের জন্য ১০% চারা মজুদ রাখতে হবে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত চারা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে।
চারার ঘনত্ব
হেক্টরপ্রতি প্রয়োজনীয় চারার সংখ্যা নির্ভর করে সারি থেকে সারি ও চারা থেকে চারার দূরত্বের ওপর। আর এ দূরত্ব নির্ভর করে রোপণের সময়ের ওপর। আগাম চাষের বেলায় এ দূরত্ব নামলা চাষের চেয়ে বেশি হবে, অর্থাৎ আগাম চাষে কম চারার প্রয়োজন হয়।
আরও পড়ুন- দক্ষিণাঞ্চলের বড় সুপারির হাট
সারের মাত্রা
বিএআরসি প্রকাশিত ‘ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন গাইড-১৯৯৭’ ও বিএসআরআই’র গবেষণালব্ধ ‘এইজেড’ ভিত্তিতে অনুমোদিত সারের মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।
বেলে মাটির জন্য
আখ রোপণের আগে সম্পূর্ণ ফসফেট, জিপসাম, জিংক, ম্যাগনেসিয়াম এবং এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও অর্ধেক পটাশ সার প্রয়োগ করে কোদাল দ্বারা হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও অর্ধেক পটাশ সার আখের কুশি উৎপাদন সময়ে অর্থাৎ ১২০-১৫০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া প্রথম উপরি প্রয়োগের একমাস পরেই দ্বিতীয় দফায় উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
এঁটেল মাটির জন্য
আখ রোপণের আগে সম্পূর্ণ ফসফেট, জিপসাম, জিংক ও ম্যাগনেসিয়াম সার নালায় প্রয়োগ করে কোদাল দ্বারা হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও পটাশ সার চারা রোপণের আগে না প্রয়োগ করে চারা রোপণের ২০-৩০ দিন পর অর্ধেক ইউরিয়া ও পটাশ সার চারার গোড়ায় স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও পটাশ সার আখের কুশি উৎপাদনের সময়ে (১২০-১৫০ দিনের মধ্যে) উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার উপরি প্রয়োগের সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা জরুরি। সেচের ব্যবস্থা না থাকলে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। উপরি প্রয়োগের পরপরই সারগুলো মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
আরও পড়ুন- পেঁপে উৎপাদন করবেন যেভাবে
জৈব সার প্রয়োগ
জমির উর্বরতা ও আখের ফলনশীলতা সংরক্ষণের জন্য হেক্টর প্রতি ১২.৫ টন গোবর-প্রেসমাড অথবা ৫০০ কেজি খৈল জৈব সার হিসেবে রোপণের আগেই নালায় প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। জৈব সারের কোন নির্দিষ্ট প্রয়োগ মাত্রা নেই। ক্ষেতে যত বেশি জৈব সার প্রয়োগ করা যাবে, ফসলের অবস্থা তত বেশি ভালো হবে।
চলবে-
এসইউ/এমএস