নির্ঝঞ্ঝাট দুপুরের বায়না এবং অন্যান্য কবিতা
নির্ঝঞ্ঝাট দুপুরের বায়না
জীবনের সমস্ত দুপুর যদি কাটিয়ে দিতে পারতাম এক নির্ঝঞ্ঝাট বাড়ির আঙিনায়। যেখানে শব্দ বলতে কেবল নীরবতা অথবা থেমে থেমে ভেসে আসা পাখি-পোকাদের বিস্ময়কর সুর। ভাবি—বাড়ির দক্ষিণে একটা সরু খাল যেটা চৈত্র এলেই শুকিয়ে খাক হয়ে যাবে আমার বারোমাসি বুকের মতো। বাড়ির সামনে এক গম্ভীর পুকুর, যার একপাড়ে হিজলের ঘন ঝোপ, জলে গোলাপি ফুলের নরম গালিচা, অন্যপাড়ে একজোড়া তালগাছ পার্থিব দুঃখকে ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে মেঘের দিকে মুখ করে। আমিও কি যেতে চাই ওর সাথে? থমথমে পুকুর, হঠাৎ বাতাসে কেঁপে উঠলো ঢেঁউয়ের ছলনায়। তীব্র আলো আমার ভালো লাগে না। সেখানে হোক মেঘাচ্ছন্ন দিনের অবিরাম মহড়া। বাড়ির পেছনে অতিঘন বাঁশঝাড়, স্যাঁতসেঁতে মাটির বুক। চতুর্দিকে বইছে মেঘ ভেজা ঠান্ডা বাতাস। তখন হয়তো আমি উপুড় হয়ে শুয়ে—তোমাকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়বো, নিমি।
****
যোগাযোগ
আমাদের সম্পর্কের একটা নাম দেবো ভেবেছি। দেওয়াটা জরুরি। না দিতে পারলে বুকের খসখসানি কেবল বাড়বে আর বাড়বেই। আমি চাই না আমাদের নামহীন সম্পর্ক থাকুক। কী নাম দেবো! ভেবেছি বহুবার। আমাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল না কখনো। প্রেম তো দিগন্তের ওপারে অচেনা মুলুক। বন্ধুত্ব? নাহ। আমাদের সম্পর্কটাকে স্রেফ যোগাযোগ বলা যেতে পারে। যোগাযোগ ব্যতীত কিছুই নয়। যেমনটা থাকে রেললাইনের দুইপাশের দুই পাতের সঙ্গে। বহুপথ একত্রে চলে তবু দূরত্ব চির ধ্রুব। কাছে আসা হয়ে ওঠে না কখনোই। আমাদের সম্পর্কটাও তেমন দৃঢ় আবছা যোগাযোগ। না পারছি কাছে ঘেঁষতে না পারছি দূরে সরতে।
আমাদের যোগাযোগের সেতু বোধহয় মায়া।
যেমন মেঘ ও মাটির মধ্যে সেতু—বৃষ্টি।
****
তোমার সঙ্গে দেখা
অনেকদিন পরে আজ তোমাকে দেখলাম। স্বপ্নে। শেষ রাতের দিকে। চেনা একটা নদী। নদীর ভাঙা পাড়। পাড় ঘেঁষা মেঠোপথ। পথের পাশেই নাম না জানা ঘাসফুল। পড়ন্ত দিন। তুমি হেঁটে চলে যাচ্ছো, বিদায়ী সূর্যের দিকে মুখ। পরনে হালকা হলুদ জামা। খোলা লম্বা চুল, দখিনা বাতাসে উড়ছে বেসামাল। তুমি পেছন দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলে। কিন্তু কোনো কথা বললে না, যেমন বলো না গত চল্লিশ মাস। আমার তখন প্রেমিক প্রেমিক মন, দারুণ বিমর্ষতায় তাকিয়ে রইলাম শুধু। তোমাকে না পাওয়ার শোক নদীর মাতাল উত্তাল তলে ভীষণ স্পষ্ট।
তুমি কেবল দূরে চলে যাও!
কেন যাও—স্বপ্নে ও বাস্তবে?
****
জীবনচক্র
নদীর বাঁকের মতো তোমার কোমর আমাকে ডাকল। আমি নদীর কাছে ছুঁটে যেতেই তুমি মায়ার মেঘ হয়ে আকাশে উড়লে। তোমার শীতলতা পেতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হাওয়ায় ভাসলাম। তখনই তুমি বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লে। আমি ভূপাতিত হতে হতে তুমি মিশলে মাটিতে। মাটি খুঁড়ে তোমাকে খুঁজে দেখি তুমি ফের নদীর বুকে। শরীরে মরণ মাটি নিয়ে আবার ছুটি নদীর কাছে। ততক্ষণে তুমি ফের মেঘ। দৌড়ঝাঁপ করে আমি ক্লান্ত ভীষণ, তাকিয়ে রইলাম জলের চোখে।
এই তো আমার জীবনচক্র।
শুধু পিছু ছোটার বেসুরো সুর—তুমি দূর থেকে বহুদূর।
এসইউ/এমএস