গোলাম রববানীর একগুচ্ছ কবিতা
ভালো শব্দটি বেদখল করলো কে?
জানো তো অক্সিজেন প্রদানকারী গাছটি কত অসুখী:
সাগরের চেয়ে আরো বেশি, ঢেউ ভাঙা হৃদয়ে দুকূল;
কারো ডালভাঙা, শাখা সমেত প্রশাখা, অথবা শিকড়হীন-
কারো বুকে নদীচর, তবুও সান্ত্বনার সমুদ্রে ঢেউহাসি।
জন্মের বৈপরীত্যে মরণ আর মরণের সমার্থকে জন্ম
বেঁচে থাকা সজ্ঞানের তালা, অজ্ঞানেই কষ্টচাবি খোলা...
না থাকাতেই আনন্দ, ভয়ডরের নেই কোনও সম্ভাবনা
ঠিক যেনো আলাভোলা, স্মৃতিভ্রষ্ট, মনে থাকা না থাকা
গোড়ায় গলদ রেখে, জলঘোলা করে আলোর সন্ধানে
নেমে আসা,যা তা স্বচ্ছ জলরাশির ঔপনিবেশিকতা
বৃক্ষের জন্ম জানি না, ছায়ার ছোঁয়াখানি নিই না
কিছু সংস্কার কিছু নমস্কার আমার জীবনেও মনে টানা না
যে সংস্কার শরমের লাজে মুখ ঢাকে তার কিসের অপেক্ষা?
সংস্কার কোথায়, কোথা থেকেই বা এসেছে জানি না..
****
না রূপকথা না অভিনব
বসন্তের ঘোরে কেটে গেছে তখন আমার তেত্রিশ বসন্ত
চৌত্রিশ বসন্তের বাতাস চড়ে কল্পনার পাখাটি ওড়াচ্ছি
ফোটাচ্ছি অলকানন্দের ফুল সুরভিতে উড়ছে কেতন
চারিদিকে রমরমা কথার ব্যবসা, তেল বাদে মা'র পানি
প্যারিস এক্সক্লুসিভ সব বুটিক আর ফ্যাশন-স্ট্রিট
কফির সুগন্ধে ভরপুর এই মাতাল বসন্তের দুপুর
এই আইফেল টাওয়ার, এই সিটি অব লাইটস-
ফাগুনের, আগুনের গনগনে লাল সূর্যের মতো ফুল
নিয়ে এলো মনে বসন্তের কাল- উদাসীন বেসামাল
কচিকাঁচা ধানের ভুঁইয়ে বসন্তের সঙ্গম কৃষক ও কৃষি
মার্চ এলেই মনে পড়ে উত্তাল ঢেউ সেই দিনগুলো
সেই দিনগুলোর এই অধুনা অবহেলায় এই বাংলাদেশ
মুখে মুখে নির্মাণ করছি শান্তির দালান স্মার্ট কলরব
বসন্ত বাতাসে শোকের মাতম এই বৈষম্যের স্বেচ্ছাচারী
পকেট বাহিনী, বেগম নামের পাড়া, আগুনের নীরবতা
হয়তোবা বেইলী রোড়ের মতো কত উপহার অপেক্ষারত
মাটির নিচের শহরের মতো মনের অতলান্ত গোপনে
পিৎজার মজা- রোম, সিস্টিন চ্যাপেল- বসন্ত তেমন
বসন্তের পাখি- ফাগুনের সখী, চল দখিন হাওয়া মাখি
বাংলাদেশের উত্তর পাহাড়ে, পার্বত্য অঞ্চলের প্রেমিকে
দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে, আরও বিশ্ব দীঘতম সি বিচে
সাত মার্চের উত্তাল ঢেউ আগস্টের শোক মহাশোকে
বাদ তো গেল না একাত্তর থেকে আজকের চব্বিশ
কথারা কথা বড়ালে সর্বত্র খুঁজে অযথায় শান্তিধারা
স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এমপায়ার্স স্টেট বিল্ডিং ও টাইমস স্কোয়ারও, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টস
মিস করবেন না যেখানে মেট গালা; মনে বাঙলা ফ্যাসিস্ট
পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঝুলে হ্যাং গ্লাইডিং, কেপ গুড হোপ, কায়াক নৌকা, মারাকানা স্টেডিয়ামটিও দেখার মতো
অশান্তি পাহাড়, অশান্ত দেহ, কবিতা জন্ম কল্পনাদেশ
টোকিও স্কাইট্রি, ডোন্ট মাইন্ড, শীত আসবেই একদিন
দিনের পর দিন, আগামী, আজ, অতীতের তলহীন
কী কবিতা লিখলেন কবি, কবিতা তো চাই জটিলতাহীন
শুনেছি কবিদের দোষও বহুগুণ, কবিদেশ ব্যঙ্গাত্মক।
থোড়া থোড়া কথার থোড় ধরেছে- বাক্কাপথ যেতে হবে
ভালো শব্দটির মরণ হয়েছে:শুধু বাঁচানোর এই অপচেষ্টা!
****
প্রিয়
ক.
তারে দেখলে আমার দেখার ইচ্ছে বাড়ে
না দেখলে আরও জ্বালা বহুগুণ-
মনেপ্রাণে ধরে; সে কী আর আমার বোঝে
খ.
সে আমার দিকে ফিরে চাই না
যেন লুকিয়ে রাখে মুখ, মুখের সম্মুখে
গ.
প্রিয় থাকলে পলকে পলকে নিমেষেই আমি
অপলক হতাম, যুগলচোখের পাতাজুড়ে...
ঘ.
অথচ আমরা আমাদের জীবনকে
সৌন্দর্য, প্রাচুর্য আর বিত্তবৈভবের মতো দেখি,
যার কারণে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়;
পরিচালনা করা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়।
ঙ.
পাহাড়িয়া পাখি আর প্রজাপতিটি যদি আমার হতো
তোমার আপন ঠিকানায় আমি টিলা হয়ে যেতাম
****
বিশ্বাস, বিষফোঁড়া আর এক পিতার আর্তনাদ
চৌত্রিশটি বছর কেবল এভাবে বিশ্বাস করেই গেলাম
পদে পদে শুধুমাত্র লাঞ্চিত হলাম বঞ্চিত হলাম
আরও হলাম ভাগ্যাহত;তিনি ভাগ্যনিয়ন্তা ভাগ্য বাঁচান।
তবে কপালের দোষ দিয়ে বলুনতো আর হবেডা কী!
এই কপাল আর কত আঙুলইবা হবে?
বড়জোর তিন/চার আঙুলেরই কপাল!
ক্ষমতার কি'বা বোঝে!
তাই বলে কী কপাল বৈষম্য বারুদের বারুদানলে পুড়বে?
তিন কূলে একমাত্র পুত্র ছাড়া কিছুই ছিল না তার;
ছিলনা বেঁচে থাকার কোনও নিবিষ্ট সাধনার বিশেষ কারণ
১৯৯১ আর ২০১১ কোনও ভাবেই ফেলে দেবার মতো না
বাকিটা ছলনা আর রঙঢঙ; বিশ্বাস ও বিষফোঁড়া
একপিতার আর্তনাদে চোখের ভেতর দিয়েই ভাপ ওঠে
যেন গ্রামের সেদ্ধধানের পাত্রে ধোঁয়া ওঠার মতো
অথবা গ্রীষ্মের দুপুরের খা খা সীমান্তের চোখ রাঙানি
অথবা তীব্র কনকনে শীতের মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার মতো
একপিতার আর্তনাদেও সহনশীলতা ক্ষমাশীলতার ঢেউ
তারই ছায়ায় আশ্রয় আমার ভালো, থেকো প্রিয় আব্বা।
****
শরৎকাব্য
এই শরতে নাগর দেখে শহুরের শরতের কাশফুল
এই শরতে চক্ষুখুলে কানাবাজার দেখে সর্ষেফুল
এই শরতে শরত ফুলে গন্ধেভেজা তপ্তদুপুর
নিরানন্দের হাওয়ায় চড়ে চলে আসছে
পূজার বছর
শরতের ফুল শরতের সুর আয়ুহীন পদ্মপাতার জল
শুভ্রমেঘে নীলাকাশ যেনো কাফনকাপড় অবিকল
শরৎকাব্য বুক ও বিশ্বে অনবদ্য আখ্যানকাব্যে
শরৎপূজা বিশ্বজোড়া মেতে আছে বাংলা কাব্যে
হরেক রকম গাছগাছালি মাথা উঁচোয় ছুঁয়ে দিতে
নীলসাদা ঐ সঙ্গমের বাদল ডিঙানো আকাশটাকে
এই শরতে শরৎ স্বরূপ চেয়ে থাকে অপরূপে
মোহনীয় চাঁদনী রাত আর অন্ধে বুকচির জোনাক্টাযে
শরৎপ্রেমে শরৎটানে ঘর পালালো আজ কে ওরে
শারদ সন্ধে পূজোর ফুলে পুষ্পার্ঘ্য দে আজ তারে!
পদাবলির ভাদর রাতে হিমেল ঘোমটা খুলে গেলে
কোন সে দেশে কোন সে বেশে
শরৎস্মৃতি স্নিগ্ধ মেখে...
****
তীব্র অনুভূতি
ভোরের নির্মল বাতাস এখানে
পুলকিত হতে আসে, পুলকিত হই আমি
ঠিক যেন এই পৃথিবীর নিচে
হারিয়ে ফেলছি নিজেকেই উদাসীন
আমরা দুজন অসম বয়সী
হয়ত মনের সাথে মনের মনমালিন্য করে
ইবাদত মন উপসনালয়ে
তুমি আর আমি ধীরে ধীরে একত্রিত হব বলে
গোপন ভালোবাসার সম্ভাবনা উড়ে
গোপন আরাধনার নিরাপদ মনে
যেখানে থাকে না কোনও প্রাচীর কোনও সীমানা
কী যে দুঃসহ যন্ত্রণা নাচে অকৃত্রিম বাতাসে
হারিয়ে যেওনা তুমি, তুমিই আমার তীব্র অনুভূতি
শুধু তুমিই আমার ইবাদতকারিণী সম্রাজ্ঞী ।
****
কথামালা
ক.
মা-বাবা ও শিক্ষকের উপর যাদের ভক্তি নাই,
তারা আর যাই হোক না কেন, তারা মানুষ না।
খ.
আসুন, আমরা কোন সমস্যাকে জটিল না করে-
বরঞ্চ সহজ সরল সুন্দরভাবে সমাধানের পথ খুঁজি।
গ.
জীবন সুন্দর- যদি আমরা সুন্দরের সংবর্ধনা করি।
ঘ.
কিছু অমানুষের কারণে অতিক্ষুদ্র বিষয়ও
মহাজগতের চেয়ে বিশাল আকার ধারণ করে।এই সমস্ত অমানুষগুলো না জেনে না বুঝে কিছু অর্থের বিনিময়ে হাজারো সাজানো সংসার তচনচ করে ছাড়ে। পক্ষান্তরে, অমানুষগুলোর ঘরেও যে আগুন লাগে তারা কী তা বোঝে?
ঙ.
কোনও বিষয়ে নাক গলানোর আগে,
ঘিলু-টিলুকে আগে ভালো করে গালান;
দেখবেন হাইপ্রেশারটা কনট্রোলে থাকবে।
চ.
এককথার মানুষগুলো প্রচন্ডরকমের
ভণ্ডপ্রতারক কোয়ালিটির হয়ে থাকে। দেখতে মানুষের মতো হলেও পরিপূর্ণ শ্বাপদসঙ্কুলে।
ছ.
যাকে তাকে মনের কথা বলতে নেই
কেএসকে/জিকেএস