লালন সাঁই কেন আমাদের ‘মনের মানুষ’

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৬:৩৪ পিএম, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

আমি বরাবরই লালনগীতির ভক্ত ছিলাম। কোথাও এই গান শুনলেই উতলা হয়ে উঠতাম। হাটে-বাজারে যেখানেই শুনতাম; দাঁড়িয়ে যেতাম। মনে মনে প্রায়ই গাইতাম, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে-যায়?’ কিন্তু তখনো জানতাম না, এই লালনগীতির স্রষ্টা কে? ধীরে ধীরে বিভিন্ন বই পড়ে জানতে পারি, লালন এক আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি একাধারে ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।

যাকে ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও চিনতে শুরু করি। কলেজের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে ভর্তি হয়ে চোখ অনেকটাই খুলে যায়। সবচেয়ে বেশি জানতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষের বানানো ‘মনের মানুষ’ সিনেমাটি দেখে। এ পর্যন্ত আমি চারবার দেখেছি সিনেমাটি। দেখার পরামর্শ দিয়েছি অনেককে। যতবারই দেখি, আমার অন্তর্চক্ষু খুলে যায়। অন্য এক মানুষকে আবিষ্কার করি। খুঁজে ফিরি আমার মনের মানুষকে।

ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবিটি ২০১০ সালে মুক্তি পায়। এতে দুই দেশের বিভিন্ন শিল্পী অভিনয় করেন। সিনেমায় লালন ফকিরের জীবন ও কর্মের কিছু চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে জমিদারী করতে এসে দেখা পান লালনের। জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর পদ্মা নদীর বজরায় বসে লালনের একটি স্কেচ তৈরি করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হলেন শহুরে বুদ্ধিজীবী, তিনি লালনের সাথে বাউলের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার মাধ্যমেই লালনের জীবন চলচ্চিত্রের দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয়।

যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তবে লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসূত্র তার রচিত ২৮৮টি গান। কিন্তু লালনের কোনো গানে তার জীবন সম্পর্কে তথ্য রেখে যাননি। কয়েকটি গানে নিজেকে ‘লালন ফকির’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই আমরা তাকে সন্ধান করেই যাবো।

লালন ফকিরের জন্ম কোথায়, তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কেননা লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাঁহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না।’

বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত ‘মাসিক মোহম্মদী’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’ লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লালনের গানের জন্য উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

মনের মানুষ বলি আর মহাত্মা বলি, লালন আসলে লালনই। আর তুলনা আর হতে পারে না। গানে গানে মানুষের মনে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে গেছেন তিনি। অজর, অমর, অক্ষয় হয়ে আছেন তিনি। লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা অনেক বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রভাবিত হয়েছেন। লালনের সংগীত ও ধর্ম-দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। তার মৃত্যুদিবসে ছেউড়িয়ার আখড়ায় স্মরণ উৎসব হয়। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ লালন স্মরণোৎসব ও দোল পূর্ণিমায় আধ্যাত্মিক সাধকের দর্শন অনুস্মরণ করতে প্রতি বছর উপস্থিত হন।

লালন সাঁইজিকে নিয়ে অনেক রচনার সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর জীবনীর নির্ভরযোগ্য তথ্য ও লালন-দর্শনের মূল কথা নিয়ে সাইমন জাকারিয়া রচনা করেছেন ‘উত্তরলালনচরিত’ শীর্ষক নাটক। রণজিৎ কুমার লালন সম্পর্কে ‘সেনবাউল রাজারাম’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরেশ ভট্টাচার্য রচনা করেন ‘বাউল রাজার প্রেম’ নামে একটি উপন্যাস। ১৯৩৬ সালে সুনির্মল বসু ‘লালন ফকিরের ভিটে’ নামে একটি ছোটগল্প রচনা করেন। শওকত ওসমান ১৯৬৪ সালে রচনা করেন ‘দুই মুসাফির’ নামের একটি ছোটগল্প। এছাড়া লালনকে নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে।

লালন ফকির বেঁচে থাকবেন আমাদের মর্মে। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে। মানুষ যতদিন থাকবে; ততদিন খুঁজবে তার মনের মানুষকে। আজ ১৭ অক্টোবর লালন সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ৩ দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেখানে হবে গান, লালনের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা। বসবে লালন ভক্ত-অনুরাগীদের মিলনমেলা।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।