মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১০
গোমতীর স্রোত: কতরং
মধুমালতি ডাকে আয়, ফুল ও ফাগুনের এ খেলায়
এই আহ্বান কর্ণকুহর ভেদ করে, হৃদয়মর্মস্পর্শ করে
সন্ধ্যা এগিয়ে এসেছে। আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। প্রকৃতিও নিশ্চল, নিস্তব্ধ। সে এমন ভাব ধরে আছে, ইচ্ছে করলেই যে কোনো মুহূর্তে প্রবলধারে বারি বর্ষণ শুরু করতে পারে। যদি ইচ্ছে না করে তাহলে কয়েক ঘণ্টা স্থগিতও রাখতে পারে।
বিমলা ডেকে বললেন: চন্দ্রা, বৃষ্টি পড়ার আগে চট করে পুকুর থেকে জল তুলে নিয়ে আয় তো মা। বৃষ্টি শুরু হলে তো আর যাওয়া হবে না।
চন্দ্রা হন হন করে পুকুরঘাটের দিকে চলে গেল। ত্যারচাভাবে কৃষ্ণমেঘ জলের সঙ্গে খেলা করছে। ছোট ছোট ঢেউয়ে জলের ওপর নানা রকম চিত্র তৈরি করেছে। কলসি জলে ফেলে এই বিচিত্র চিত্রের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে চন্দ্রা গান শুরু করল। মেঘ থেকে বড় বড় ফোঁটায় জল পড়তে লাগল। ঠিক তখনই চন্দ্রার ভাই রবি দৌড়ে এসে পুকুরঘাটের ওপরে দাঁড়িয়ে বলল, কার অপেক্ষায় গান ধরলি আবার? বৃষ্টিতে যে ভিজে যাচ্ছিস সেদিকে খেয়াল আছে? অবশ্য তোর মিষ্টিগলায় বৃষ্টির গান চমৎকার শোনায়।
গান থামিয়ে ঈষৎ হেসে চন্দ্রা বলল, যার অপেক্ষায়ই গান ধরি না কেন, তুই এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলি যে?
রবি হেসে বলল, তুই গান থামালি কেন? এই মেঘলা দিনে সুরটা ভালোই শোনাচ্ছে। তারপর স্বাভাবিকভাবে বলল, আকাশে মেঘ দেখেই তাড়াতাড়িই ফিরে এলাম। মিছেমিছি বৃষ্টিতে ভিজে লাভ নেই।
কেন রে, তোর শরীর ভালো নেই?
তুই তো জানিস, শরীরের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সময় আমার মতো মানুষের কখনও নেই। শরীর আমার কাছে খুবই তুচ্ছ জিনিস।
তাহলে একটু দাঁড়া। বৃষ্টি শুরু হলে দুই ভাই-বোন ভিজতে পারব।
বৃষ্টিতে ভিজতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না। গত রাতে তোর জ্বর এসেছিল, এখন জলে ভিজলে অসুখ বাড়বে। চল্, শীঘ্র করে চল্।
চন্দ্রা বলল, সেকথাও বটে। শোন্ ভাই, পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে নিলে ভালো হতো। বাড়ি ফিরে জলখাবার খেয়ে তুই বিশ্রাম করতে পারিস।
রবি বলল, বাবার সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ রয়েছে, বিশ্রাম নিলে হবে না।
কী আলাপ! সেই বিষয়টি কি আমাকে বলা যাবে?
যাবে না কেন!
তো বল্।
রবি যেন নিজ অন্তঃকরণের পরীক্ষা করে নিলো। মন কিয়ৎকাল বিরুদ্ধ স্রোতের মধ্যে সাঁতার দিতে দিতে যেন প্রত্যয়ের বেলাভূমিতে উঠে এলো। অবশেষে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, তোর জীবনসঙ্গী নির্বাচনে বাবার বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া উচিত।
চন্দ্রা জানে, রবি কোনো কিছুতেই এই সমস্যা মেটাতে পারবে না। যত চন্দ্রা ভাবছে, ততই নূতনতর সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। রবির প্রবল পরাজয় অনুমান করে সে নিজের অভ্যন্তরীণ চিন্তার বশবর্তী হয়ে রবির প্রস্তাব পরিত্যাগ করতে চাইছে। ফলত, শিরঃপীড়া হচ্ছে। রবির প্রস্তাব মেনে নেওয়া মানে নিজের ব্যক্তিত্বের বিলোপ; অবার রবির প্রস্তাব অস্বীকার করার অর্থ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। এই সমস্যা যে কীরূপ, কী ভয়ংকর অন্তর্দহনের, তা যে না প্রাণে প্রাণে অনুভব করেছে, সে বুঝবে না। সাধারণ লোকের নিকট এটি সাধারণ সমস্যা মাত্র; কিন্তু এটি যার কাছে জীবন-মরণ সমস্যা, তার কাছে মনে হয় যে, এই জাতীয় দ্বন্দ্বভিত্তিভূমিকে কারা যেন এমনভাবে সমূলে নাড়া দেয়, প্রাণসংশয় হয়ে পড়ে। এই সমস্যায় পীড়িত হয়ে চন্দ্রা অন্তরে উন্মত্তপ্রায় হলেও, ভাইয়ের সামনে সহজ থাকার চেষ্টা করল। বলল, জানিস তো—বাবা-মা আমাদের ওপর অন্যায় করতে পারেন না।
ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে রবির মন প্রবলভাবে অশান্ত, বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নিরাময়হীন বিস্ফোটকের মতো তার মস্তিষ্কের ভেতর দপদপ করে জ্বলছে। বলল: দিদি, বাবা যেখানে তোর বিয়ের বন্দোবস্ত করতে যাচ্ছেন, সেখানে কোনোমতেই আমি রাজি হতে পারছি না। হওয়াও সম্ভব নয়।
কেন?
ঘাটের ওপর বসে আছে রবি, জলের ওপর শূন্যদৃষ্টি বিস্তার করে তাকিয়ে আছে। তার চাউনিতে যেন কোনো সাড় নেই। পূর্বে কত কল্পনা তার এই দুই চোখের ভ্রমর পঙ্ক্তিবৎ নেত্রপালক কম্পন করে তুলত—এখন তা নিথর। পূর্বে প্রেমাভক্তির আবেশে এই দুই চোখ চক্ষুজলে প্রণত হয়ে থাকত—এখন তা শুষ্ক। পূর্বে অনেক সমস্যা সমাধান করে তার এই দুই চোখে দীপ্তি বিদ্যুতের শিখার মতো নেচে উঠত—এখন তা নির্বোধ, অস্বচ্ছ। এই শূন্যদৃষ্টি নিয়েই রবি বলল: পার্থের কথা শুনেছি, গান-গল্প-বিলাপ শুনেছি, বক্তৃতা শুনেছি—এই পর্যন্ত। কিন্তু মানুষ তো কথার সমষ্টি নয়। আর, যে বেশি কথা বলে তার চরিত্রে আমার সন্দেহ হয়—যেন ধুলো উড়িয়ে সে আসল জিনিসটাকে ঢাকছে। তাই বলছি, এখানে সম্বন্ধ করলে সমাজে ক্রমেই নানা কথা উঠবে। তাই এটি যত শীঘ্র সম্ভব বন্ধ করা উচিত।
সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই পরিবেশে যাবতীয় অর্থহীনতা নিয়ে রবি বসে থাকে। রবিকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে চন্দ্রার হৃদয়ে প্রবল সহানুভূতি অনুভূত হচ্ছে। তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কলসি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে থাকে। ভাইয়ের কাছে চন্দ্রা পৌঁছানো মাত্র রবি বলল, কলসিটা আমাকে দে।
চন্দ্রা কিছু বলার আগেই রবি তা কেড়ে নিলো। চন্দ্রার মুখশ্রী ঝলমল করে উঠলেও এক মুহূর্ত পরেই মুখভাব মলিন হয়ে গেল, যখন রবি গম্ভীর স্বরে বলল: বাবা এখন কোথায় রে?
বাইরে। ফিরতে দেরি হবে বলে মা’কে বলে গেছেন।
চন্দ্রার মুখশ্রী পাংশুবর্ণ দেখে রবি সস্নেহে জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছিস, দিদি?
নিম্নস্বরে চন্দ্রা বলল, শোন্, আমাকে নিয়ে তুই বাবার সঙ্গে কোনো ঝামেলা করবি না।
রবি একটু মৃদু হাসল। সে জানে: ধৈর্য জিনিসটা স্থিতিস্থাপক, বাড়ালে সেটি বাড়ে, কিন্তু প্রাণপণ টানতে থাকলে কেন্দ্রটিকে সেটি ছেড়ে চলে আসে। বেশি টানলে ছিঁড়ে যায়। রবির কপালে যেন বিদ্যুৎ খেলে উঠল। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, তুই এটা নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি শান্ত মাথায়ই কথা বলবো।
বাইরে বৃষ্টিভেজা নিবিড় পরিবেশ। ভেতরে নিস্তব্ধ নিশ্চুপ। চন্দ্রা দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। দর্পণে যে যুবতির প্রতিবিম্ব পড়েছে তাকে তরুণী বলেই মনে হয়। প্রায় ডিম্বাকৃতি কিন্তু লম্বা ধরনের মুখ। ভুরু দুটিতে যেন নিখুঁত তুলির টান। ঘন পালকে ঘেরা টানাটানা দুই চক্ষু। চোখের কালো মণি দুটি স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল। ছোট কপাল। সরু চিবুক। পাতলা নাক। হাত-পা-আঙুল-গলা সবকিছু নিটোল। শরীরে অনাবশ্যক মেদ একটুও নেই। বর্ণ সামান্য চাঁপা রঙের। সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারিণী চন্দ্রাকে ঘিরে রয়েছে এক মায়াবী দ্যুতি। এটিই তার আকর্ষণ শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার দৃষ্টি, ঠোঁটের মৃদু হাসি—সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে যেন অদৃশ্য চুম্বক। যে কোনো পুরুষ এই মুহূর্তে তার দিকে তাকালে মুগ্ধ হয়ে যাবে।
দর্পণে কয়েক পলক নিজেকে দেখে নিলো চন্দ্রা। উগ্র সাজ বা পোশাক তার অতি অপছন্দের। হালকা রঙের শাড়িই পরে সে। আজও তার পরনে রয়েছে হালকা বেগুনি রঙের একটি শাড়ি। দুই ভুরুর মাঝখানে আঁকা একটি বিন্দু। আশ্চর্য এক ভালোবাসায় যেন তার মন ভরে উঠল। মনে হলো, কে যেন আশেপাশে বাঁশিতে সুর ভাঙছে। এই সুরটি যেন ধীরে ধীরে তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এক সময় সে দর্পণের সামনে থেকে সরে পড়ে। দেওয়াল-ঘেঁষা আলমারির দিকে অগ্রসর হতেই হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি চলে যায়। বৃষ্টির শব্দে কিছুক্ষণ আগে তার হৃদয়ে যে বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছিল তা হঠাৎই থেমে গেল। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার। দ্বিধান্বিতভাবেই সে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। এখন যদি সুকান্ত আসত!
রমেশ চক্রবর্তী তার পুত্র রবির সঙ্গে আলাপ শেষ করে চন্দ্রার সন্ধান করতে এখানে এসে উপস্থিত হলেন। পিতার পদশব্দে চমকে উঠল চন্দ্রা। জানালার দিক থেকে ফিরে এলো। পিতার দিকে তাকিয়ে চন্দ্রা বলল, বাবা!
রমেশ চক্রবর্তীর সংক্ষিপ্ত উত্তর, হ্যাঁ।
চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে রইলেন রমেশ চক্রবর্তী, পলকহীন দৃষ্টিতে। দুই চক্ষে অনন্ত বিস্ময় ও মুগ্ধতা। চন্দ্রা তার ভুরু সামান্য তুলে জিজ্ঞেস করল, অমন করে কী দেখছ বাবা। কিছু কি বলবে?
রমেশ চক্রবর্তী বললেন, তোকে দেখছি মা। কত বড় হয়ে গেছিস তুই! তোকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। তুই কি এতক্ষণ একলা ছিলি?
মা বলছিল তুমি আমাকে খুঁজছো। মায়ের সঙ্গে আলাপে রত ছিলাম, তাই যেতে পারিনি।
তোকে একটা কথা বলার ছিল।
কী কথা বাবা!
লক্ষ্মী মা আমার, আমি যে তোর বিয়ে ঠিক করেছি।
চন্দ্রার বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে উঠিল; সে একটু অপ্রস্তুতই; আতঙ্কে শঙ্কিত চিত্ত যেন; ভুরু দুটি অনেকটা ওপরে উঠে গিয়েছে; কয়েক পলক আতঙ্ক জড়ানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর বলল: তোমার যা ইচ্ছে বাবা।
অক্ষয় দাসের নাম তুই নিশ্চয় শুনেছিস। তার ছেলে পার্থ। ছেলেটা দেখতে সুপুরুষ। অর্থকড়িতে ওরা অনেক বড়। বল্ তো এখন আমি কী করি?
একথা শুনে চন্দ্রা আশ্চর্যান্বিত হয়, হতাশ নয়, ক্ষুণ্ণ হলো—পিতার স্থূল দৃষ্টি কেবল স্থূল বস্তুর চাকচিক্য দেখে। তিনি সেটি আঙুলের আঘাতে শূন্যে আবর্তিত করে সম্ভোগ করতে চান—আত্মার অনুভূতির নিগূঢ় সম্বন্ধ তিনি মানতে জানেন না। কিন্তু চন্দ্রার মধ্যে প্রবল এক ব্যক্তিত্ব রয়েছে। প্রচণ্ড মনের জোর তার। অসীম ধৈর্য। ধীর, স্থির, বুদ্ধিমতী। কোনো কারণেই সহজে বিচলিত হয় না সে। সমস্যা যত তীব্রই হোক, সেসব তার কৌশলে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। অপ্রতিভ হয়ে কর্তব্যে অবহেলা করা তার অভ্যাসে নেই; বলল: বাবা তুমি যা ভালো মনে করো তাই কোরো।
তুই তো তাকে দেখিসনি।
সর্বাঙ্গে মুহুর্মুহু শিহরণ জেগে উঠল। এই শিহরণ থামার পরই চন্দ্রা বলল, তাতে কী! তুমি তো সবই ভালো বোঝো।
দ্যাখ্ চন্দ্রা, চিরজীবনের কথা, তাই খুব ভেবেচিন্তেই পার্থের সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে চাই। ফস করে একটা খেয়ালের মাথায় কিছুই করতে চাই না। তাছাড়া রবির সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তাই চিন্তার অনেক কিছু রয়েছে।
কণ্ঠে বেদনা ঘনীভূত করে নিয়ে চন্দ্রা বলল, আমি জানি তুমি ভালোভাবেই ভেবেচিন্তে কাজে পদার্পণ করবে। আমার আর কী বলার থাকতে পারে!
রমেশ চক্রবর্তী চমকে উঠলেন; যেখানে কার্যকারণের কোনও যোগাযোগ নেই সেখানে তর্ক করবেন কী কারণে? অমাবস্যার সঙ্গে কি কুস্তি চলে? তবে রমেশ চক্রবর্তী ঠিকই বুঝেছেন: চন্দ্রার বুকের ওপর কী যেন একটা পাথর চেপে রয়েছে, তাই আর কথা না বাড়িয়ে প্রস্থান করলেন।
অকলঙ্ক শশিমুখী, সুধাপানে সদাসুখী
তনু তনু নিরখি, অতনু চমকে
কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।
ঘোর অন্ধকার।
চারদিক নীরবতায় আচ্ছন্ন।
গ্রামটি শয্যার ক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
পথে তেমন কোনো লোকের চলাচল নেই।
পার্থের চোখে কোনো নিদ্রা নেই। সে এই নীরব-নির্জন অন্ধকারে ভূমিশয্যায় শুয়ে অন্য রাত্রির মতো আজও তার ব্যর্থদগ্ধ জীবনের কথা ভেবে চলেছে। সুশীলার কথা ভাবলেই তার সমস্ত হৃৎপিণ্ড মথিত করে একটা হাহাকার ওঠে। হায়, সুশীলা, আমার দুঃখিনী প্রেমিকা, কোনো দিনই সুখ-শান্তি কাকে বলে তা জানতে পারল না। আমিও দিতে পারিনি। অসহ্য দারিদ্র্য ও দুর্দশা যেমন তোমার জীবনের অভিশাপ তেমনই আমারও। সমাজ তোমাকে দুশ্চরিত্র বলে অপবাদ দেয়, ঘৃণা করে; তাই তোমাকে লাভ করার ইচ্ছে থাকলেও ভয়ে এড়িয়ে চলছি, কিন্তু তোমার দুর্দশার জন্য যেমন সমাজ দায়ী তেমনই আমিও কি কম দায়ী! তোমার দরিদ্র পিতা অনাহারের অপঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন, সমাজ তার মৃতদেহের সৎকারে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেনি। যেটুকু করেছে তা আমার অনুরোধেই করেছে। সমাজের কী পৈশাচিক হৃদয়হীনতা! আমার যদি সাধ্য থাকত তাহলে এই সমাজকে ভেঙে চুরমার করে দিতাম। কিন্তু আমার সেই সাধ্য নেই। আমি একান্ত নিরুপায়, অসহায়। সুশীলা, আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু বাবা আমাকে অন্য স্থানে বিবাহবন্ধনের প্রস্তাব দিয়েছেন। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে জাত। এখন আমি কী করি? হায় রে কপাল। প্রেমমিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল বাবা। জাতের কাছে হেরে যাচ্ছে জীবন!
সুকান্তকেও ব্যর্থজীবন আঘাতের-পর-আঘাত করতে থাকে। জগৎ-সংসারে তার বলে কেউ নেই। সে স্বাধীন। সে উন্মুক্ত। জন্মসূত্রে পিতা দিয়ে গেছে শুধু জাতের গৌরব। পিতা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায়ই তার দক্ষতা ছিল। তিনি তার পুত্রকেও সেইভাবে প্রস্তুত করে গিয়েছেন। তার কয়েক পূর্বপুরুষ, সুলতানি আমলে, চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকার পাহাড় গড়েছিলেন। তারা কেবল অর্থের পেছনে উন্মাদের মতো ছুটেছিলেন। রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাদীক্ষায় তাদের বিপুল আগ্রহ ছিল। এসবেরই মধ্যেই তারা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেসব এখন শুধু ইতিহাস। সুদূর কোনো স্বপ্নের মতো। মোগল আমলের শেষদিকে পারিবারিক ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বংশধরদের লেশমাত্র আর আগ্রহ থাকেনি। ফলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে ওঠে বংশধররা। এখন যে দশ-বারো বিঘা জমি রয়েছে তা দিয়েই সুকান্তকে চলতে হয়। অবশ্য সে বাস্তবসিদ্ধ পুরুষ, তবে গ্রামের অর্ধেক লোক তাকে পাগলা-সুকান্ত বলে। পণের অর্থ জোটেনি, তার দোহাই দিয়ে এখনো পর্যন্ত সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। সে রামপ্রসাদি গান গেয়ে, এবাড়ি-ওবাড়ি করে নিজের মতোই দিন কটিয়ে দেয়। তার কেউ না-থাকায় হয়তো-বা গ্রামের লোক তাকে আপন করে নিতে পেরেছে, যদিও রমেশ চক্রবর্তী তাকে সহ্য করতে পারেন না। তারপরও সকলই তার আপন, সকলই তার আত্মীয়। সকল গৃহের দ্বারই তার জন্য উন্মুক্ত। সে তার মায়ের আদর্শ, শিক্ষা, শালীনতাবোধ পেয়েছে। তাই হয়তো তার কাছে বিত্তের লোভ মূল্য পায় না। সুকান্ত কালীদেবীর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মনে-মনে বলতে লাগল: আমি একজন প্রেমিকই বটে। চন্দ্রা আমার প্রেমিকা। একই গ্রামের, একই জাতের মেয়ে সে। তার সঙ্গে আমার সুদীর্ঘ সম্পর্ক। বাল্যকাল থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। প্রথম যৌবনেই দুইজন দুইজনের প্রেমে পড়ে যাই। সে যেন এক লাস্যময়ী ময়ূরী। ছন্দে, বর্ণে, তালে, সুরে, বিভঙ্গে আমার সমস্ত জগৎ ভরিয়ে তোলে! কখন-যে সে আমার মনের আসনটি চিরদিনের জন্য দখল করে নিয়েছে তা বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পারি, তখন দেরি হয়ে যায়। এরই মধ্যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি অশুভ অসুন্দরের ছায়া এসে পড়েছে। ছায়ার আত্মপ্রকাশ যেন অতিরঞ্জনে দূষিত; আর, একটা তীক্ষ্ণচক্ষু এবং বক্রচক্ষু যেন সাবধানে ওঁৎ পেতে আছে! শুনেছি চন্দ্রার সঙ্গে পার্থের বিবাহবন্ধনের আলাপ চলছে। বিত্তের অহংকার আর শক্তির দাপট পার্থের মতো যুবকের একমাত্র যোগ্যতা। আমাকে এখন কিছু একটা করতেই হয়। যে কোনো মূল্যেই হোক-না কেন, চন্দ্রাকে উদ্ধার করতে হবে। চন্দ্রার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন না হয় সেই জন্য বাধা দিচ্ছেন স্বয়ং ধর্মব্যবসায়ী পণ্ডিত গঙ্গামণি। তিনি পার্থের বাবার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের লোভেই এমনটা করছেন। কিন্তু শুনেছি, পার্থের বন্ধু অমিত এই পরিকল্পনার বিপক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। শেষপর্যন্ত কী হয় তারই অপেক্ষায় রইলাম। আলো-ছায়া-ঘেরা প্রভাতে নতুন জীবনের প্রত্যাশায় আমি ও চন্দ্রা কি নূতন পথে যাত্রা করব, না এই প্রেমকাহিনির এখানেই সমাপ্তি হবে!
নিজের ঘরে, নিজের শয্যায় ফিরে এসে পার্থ পুনরায় নৈঃশব্দ্যের মুখোমুখি হয়। রাত্রি কেটে গিয়ে প্রভাত হয়। প্রভাত পেরিয়ে মধ্যদিনে পৌঁছল। জলস্থলব্যাপী বিরাজ করে প্রচণ্ড সূর্যের খরতাপ, সমগ্র নিসর্গপ্রকৃতি যেন চিত্রার্পিত হয়ে আছে। কাকগুলো উঠোনের ওপর দিয়ে শূন্য পথে উড়ে যায়, কিন্তু সূর্যের ভীষণ উত্তাপে যেন আর অগ্রসর হতে পারেনি। গাছের ডালে এক বিন্দুতে স্থির হয়ে বসে আছে। অন্যদিকে, নদীর স্রোত সম্মুখে বইতে বইতে কঙ্করের আঘাতে প্রতিহত হয়ে যেন পেছন ফিরে আসছে। পল্লিব্যাপী একই গতি: স্তব্ধতা ও প্রত্যাগমনের খেলা। অভিসারিকার ব্যাকুলতা বুঝি-বা কীসের বাধায় বহু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে পুনরায় প্রত্যাবৃত হয়েছে। যতবার বাধা পায়, ততবার ব্যাকুলতার বেগ তীব্রতর হয়ে ওঠে। আর্তি যত তীব্র, বাধাও ততই অধিক। কে যেন সুদূরে—বটতলে বসে বাঁশিতে বিরহ-সংগীত বাজাচ্ছে। এই সুর শুনতে শুনতেই পার্থের চোখের সম্মুখে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল—সন্ধ্যাকাশের যুগল তারকার মতো—সুশীলার চক্ষু দুটি। সে দেখছে, সুশীলার উৎকণ্ঠিত চক্ষু দুটি যেন প্রাণ ঢেলে দিয়ে তার চেতনাসঞ্চার নিরীক্ষণ করছে।
চলবে...
- আগের পর্ব পড়ুন
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০২
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৩
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৪
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৫
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৬
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৭
এসইউ/জিকেএস