মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৬
গোমতীর স্রোত: কতরং
প্রাণ কান্দে বন্ধু রে, বন্ধু মোর গোমতীতটে
হে বন্ধু হিমশীতল বিচ্ছেদ এখন পরিপূর্ণ
গঙ্গামণি গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। কাঠফাটা রোদ। তার ভার্যা মাথার দিব্যি কেটে বলে দিয়েছিলেন: সাবধানে যেয়ো, বৃক্ষছায়ার সন্ধান না পেলে মাথায় ছাতা তুলে নিয়ো। ছাতা ছাড়া ছায়াহীন পথে হাঁটবে না। তার ভার্যার কথায় স্বীকৃত হয়ে এই ভরদুপুর রোদে বাড়ি থেকে বের হন, স্বীকৃত না হলে তার ভার্যা কোনোমতেই ছেড়ে দিতেন না।
আজ অক্ষয় দাসের বাড়িতে না-গেলেই নয়, জরুরি একটা কাজ আছে। অক্ষয় দাস ধনবান ব্যক্তি, ব্যবসায়ী। তার বাসস্থান গোমতী নদীতটের একটি গ্রামে। তিনি অবশ্য যুবাপুরুষ নন, বয়স পঞ্চাশের কোঠায়।
গঙ্গামণি এগিয়ে চলেছেন। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য তিনি হেঁটে চলেছেন অক্ষয় দাসের বাড়ির দিকে। দীর্ঘ পথ। এবড়োখেবড়ো। পদক্ষেপ মন্থর। কিন্তু দৃঢ়। তার অহংকার ও আত্মবিশ্বাস সেই পদক্ষেপে ঝংকার তুলছে যেন! প্রথম দু-এক রাস্তা নির্বিঘ্নে এগিয়ে যান, কিন্তু গোমতী নদীতটের একটি রাস্তায় উঠতেই দেখতে পান নদীর জল অবিরল প্রবাহিত—ছুটে চলেছে ভাটির দিকে। এই ভাটির পথেই যেতে হবে অক্ষয় দাসের নিবাসে। বাতাস রৌদ্রনৃত্যে নেচে চলেছে। তপ্তরৌদ্র ছাতার সঙ্গে হেসে বেড়াচ্ছে—আবর্তে ডাকছে। কেমন একটা ক্রীড়া চলছে। নদীর অন্য পাশে, বিস্তীর্ণ মাঠে রাখালরা গরু চরাচ্ছে, কেউবা বটবৃক্ষের তলায় বসে আপন মনে গান করছে, কেউবা বিড়ি টানছে। ফসলের ক্ষেত অবশ্য কৃষকবিহীন। তারা বরং গরু ঠ্যাঙাতে ব্যস্ত। জমিতে কোনো ফসল রোপণের আয়োজনও নেই।
নদীঘাটে গঙ্গামণি পৌঁছতেই দেখতে পেলেন: গ্রামের মহিষীরা কলসি, ছেঁড়া কাঁথা, ভাঙা মাদুর নিয়ে জলের সঙ্গে লড়াই করছে। কেউ কেউ কাপড় আছড়াচ্ছে। তাদের পাশে কয়েকজন কামিনী, পরনে ময়লা বস্ত্র, গ্রাম্যনিন্দিত গায়ের বর্ণ, রুক্ষ কেশ নিয়ে জলের সঙ্গে সন্ধিবন্ধনস্থাপনে ব্যস্ত। তাদের মধ্য থেকে একজন তার সঙ্গীকে কাদাজলকেলিতে আহ্বান করে চলেছে। কাদার হাত থেকে রক্ষা পেতে কয়েকজন গৃহবধূ ঘোমটা টেনে জলে ডুব দেয়। তাদের পাশ কাটিয়ে কয়েকটি বালক জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কোন্দলের সুব্যবস্থায়। বালকরা চেঁচাচ্ছে, একে অন্যে কাদা মাখাচ্ছে, সাঁতার দিচ্ছে, একে অন্যের গায়ে জল ছিটাচ্ছে। তাদের পাশেই গঙ্গামণি নদীঘাটে নেমে নিরীহ মানুষের মতো জলে হাত ডুবিয়ে আপনমনে গঙ্গামন্ত্র পড়তে লাগলেন। তিনি একেকবার আকণ্ঠ নিমজ্জিত এক যুবতির দিকে তাকিয়েও নিচ্ছেন।
আকাশে সাদামেঘ রৌদ্রতপ্ত হাওয়া দিচ্ছে, মিলেও যাচ্ছে। রৌদ্রতপ্ত বাতাসের রেখার নিচে কয়েকটি কৃষ্ণকাক উড়ে গেল, কিন্তু একটি চিল পাশের নিমগাছে বসে, অর্থমন্ত্রীর মতো চারদিক দেখছে, আর কীসে ছোঁ মারা যায় সেই ফন্দিই আঁটছে। নিমগাছের নিচে কাদা ঘেঁটে বেড়াচ্ছে একদল হাঁস, তাদের শাবকরা মাঝেমধ্যে জলে ডুব দিচ্ছে, আবার ভেসেও উঠছে। মনে হচ্ছে তাদের প্রতিই চিলের তীক্ষ্ণদৃষ্টি। হাঁসের ছানাগুলোর ওপর দিয়ে কয়েকটি মাছরাঙাও উড়ে গেল।
নদীঘাটে, হাঁটুজলে নিমজ্জিত নৌকাগুলো হটর হটর করে চলেছে, স্বীয় প্রয়োজনে, আর খেয়ানৌকাগুলো চলছে পরের প্রয়োজনে। অক্ষয় দাসের গুণটানা তিনটি মহাজনি নৌকা অলসবিশ্রামে ঘাটেই বাঁধা—শান্তজলে সাঁতার কাটছে—কোথাও যাওয়ার নেই—প্রয়োজন হলেই এক সময় ভাটির পথে যাত্রা করবে।
আকাশের সূর্য ক্রমশ দৃঢ়তীক্ষ্ণ হতে থাকে। বোধহয় গঙ্গামণির সঙ্গে ইন্দ্রদেবের কিছু বিবাদ আছে, তাই তার রৌদ্রতেজ গুরুতর বেড়ে গেছে, সঙ্গে তপ্তবাতাসও; তবে রৌদ্রের তীক্ষ্ণতা আগে এসেছে। ক্ষণকাল পথের মৃত্তিকার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে তপ্তবায়ুকে ডেকে আনল।
নদীঘাটের পাশেই হাট বসেছে। হাটের চারপাশটা খোলা। মাথার ওপর চাটাইয়ের আচ্ছাদন। নদীর ঢালুতে মুলিবাঁশের চালানের কাছে ক্রেতাদের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। বাঁশের গন্ধ নাকে লাগছে গঙ্গামণির। সমুদ্র উপকূল অঞ্চল থেকে নারকেল ও নুন-ইলিশের চালানও এই হাটে এসে পৌঁছেছে। একটি নৌকা থেকে আখের গুড়ওয়ালা কলসি কচুরিপানার গাদি থেকে টেনে বের করা হচ্ছে।
দূর থেকে চৌধুরীদের শিবমন্দিরটি দেখা যাচ্ছে। তারই উত্তরে একটি প্রাচীন বটগাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমে বাঁশবন ও কাঁটাবেতের ঝোঁপ। কোনো একসময় চৌধুরীবাড়ির বাইরে তিনটি ও ভেতরে তিনটি মহল ছিল। এক-একটি মহল, এক-একটি বৃহৎ পুরী যেন। প্রথমে সদরমহল, তাতে এক ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে হতো, তার চারপাশে ছিল উচ্চ মাটির দেওয়াল। ফটক দিয়ে তৃণশূন্য, প্রশস্ত, রক্তবর্ণ, সুনির্মিত পথে এগিয়ে যেতে হতো। পথের দুই পাশে মনোরঞ্জন-তৃণবিশিষ্ট ভূমিখণ্ডদ্বয় ছিল। সেগুলোর মধ্যে মণ্ডলাকারে রোপিত, সকুসুম পুষ্পবৃক্ষ সকল বিচিত্র পুষ্পপল্লবে শোভা পেত। সম্মুখে উচ্চ আটচালা বৈঠকখানা, যাতে অতিপ্রশস্ত সোপান আরোহণ করে উঠতে হতো। তৃণপুষ্পময় ভূমিখণ্ডদ্বয়ের দুই পাশে সারি সারি একতলা ঘর ছিল। এক সারিতে দপ্তরখানা ও কাছারি; আর-এক সারিতে তোশাখানা এবং ভৃত্যবর্গের বাসস্থান ছিল। ফটকের দুই পাশে দ্বাররক্ষকদের থাকার ঘরও ছিল। প্রথম মহলের নাম ছিল কাছারিবাড়ি। তার পাশে সুন্দর প্রস্তরবিশিষ্ট শিবমন্দির, চত্বর, উঠোন ছিল। তারই পাশে ছিল অতিথিশালা। পেছনের দিকে ছিল অন্দরমহল। তখন লোকের অভাব ছিল না। এখন সবই ক্ষয় হয়ে গেছে। গঙ্গামণি বিস্মিতনেত্রে চৌধুরীবাড়ির অপরিমিত ঐশ্বর্য দেখতে দেখতে অগ্রসর হতে লাগলেন।
গ্রামের ঢালুপথটি এঁকেবেঁকে চলে গিয়ে এক সময় শেষ হয়ে গেছে, আর যেখান থেকে ফসলি জমির শুরু, ঠিক তারই আগে চৌধুরীবাড়ির মৃত্তিকার প্রাচীরটি শেষ হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত চৌধুরীবাড়ি পেরিয়ে গঙ্গামণি অগ্রসর হলেন অক্ষয় দাসের বৈঠকখানা অভিমুখে।
নিরাশ্রয়ে, উন্মুক্ত পথে দাঁড়ানো কারো সুসাধ্য নেই। বিশেষ করে আকাশ যখন রুদ্ররোদে পরিপূর্ণ। চারদিকে তপ্ত বাতাস। সুতরাং আশ্রয়ানুসন্ধানে যাওয়া কর্তব্য বিবেচনা করে গঙ্গামণি গ্রামাভিমুখে চললেন। নদীর তীর থেকে গ্রামের ঢালু পথের শেষ সীমানা দূরবর্তী নয়; গঙ্গামণি পদব্রজে কর্দমময় পথে চললেন। পিছু ফিরে তাকালেন না। গ্রাম, গৃহ, প্রান্তর, পথ, নদী—আর লক্ষ্য করলেন না। শুধু হ্রস্বদীপ্তি রোদের ক্রোধপ্রাপ্ত হলেন।
গঙ্গামণি অনেক কষ্টে অক্ষয় দাসের বৈঠকখানার সান্নিধ্যে এসে উপস্থিত হলেন। দেখলেন, এক ইষ্টকনির্মিত বৈঠকখানা থেকে কথাবার্তা নির্গত হচ্ছে। বৈঠকখানার দ্বার উন্মুক্ত। ভেতরে সম্পদলক্ষণ সামান্য নয়। অক্ষয় দাস তার ভৃত্যকে কী যেন আদেশ দিচ্ছেন। বিচক্ষণ অক্ষয় দাস। অক্ষয় দাসের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় গঙ্গামণির। অক্ষয় দাসের দেহভঙ্গি, তার কথার ইঙ্গিতময়তা গঙ্গামণির অজানা নয়। আজ ভৃত্যের সামনে দাঁড়িয়ে অক্ষয় দাস কী কথা জানতে চাইছেন, বুঝতে অসুবিধা হলো না গঙ্গামণির। ভৃত্য চলে যাওয়ার পরই গঙ্গামণি বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। খানিকক্ষণ নীরব থেকে অক্ষয় দাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন গঙ্গামণি। অক্ষয় দাসের তুলনায় গঙ্গামণি চঞ্চল। কোনো প্রশ্নের ঝটপট উত্তর দিতে অভ্যস্ত তিনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও অক্ষয় দাস কথা বলছেন না দেখে কিংবা অক্ষয় দাস কী বলেন, তার জন্য অপেক্ষা না করে গঙ্গামণি বললেন, নমস্কার কর্তা!
অক্ষয় দাস চমকে উঠলেন। তার ক্লান্ত চোখের ঘন পল্লব দ্রুতগতিতে ওপরে উঠে গেল, পরিচিত কণ্ঠস্বর; তিনি বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন: কে?
দীর্ঘ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে অক্ষয় দাসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন গঙ্গামণি এবং অনুভব করতে লাগলেন কেবল নিজেকে। তারপর শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন: আজ্ঞে, আমি গঙ্গামণি।
গঙ্গামণিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার দেখে নিয়ে এবং আকাশ থেকে পড়া কণ্ঠে অক্ষয় দাস বললেন, বসুন। আজ আবার কী প্রয়োজন পণ্ডিত?
পা ঝুলিয়ে তক্তপোশে বসলেন গঙ্গামণি। তক্তপোশের কিনারাটা আঙুল বাঁকিয়ে চেপে ধরে উপরের দিকে টানতে লাগলেন; টানতে টানতে হাত দুইখানা তার টান টান হয়ে সমস্ত দেহটিই খাড়া হয়ে, দেখতে দেখতে আড়ষ্ট শক্ত হয়ে উঠল। তখনই তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। অতঃপর গভীর চোখে সামনে উপবিষ্ট অক্ষয় দাসের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, দেশে ধর্মকর্ম বলে কিছুই রইল না কর্তা।
কেন? কী হয়েছে? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন অক্ষয় দাস।
অক্ষয় দাসের প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর না দিয়ে, ম্লান চোখ দুটি তার মুখের ওপর রেখে গঙ্গামণি বললেন: কী হয়নি তা-ই বলুন!
অক্ষয় দাস তার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার বুদ্ধিতে তিনি এই বুঝলেন যে, গঙ্গামণির অন্তরে যেন সুমতি আর কুমতির তুমুল একটা যুদ্ধ বেঁধেছে। বললেন, কী হয়েছে তা-ই বলুন।
আজ্ঞে, পূর্বপাড়ার শ্রীনারায়ণ রায় তার মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চশিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। বলি, মেয়েমানুষকে এত পড়াশোনা করিয়ে কী লাভ!
মানে?
তাকে তো শেষপর্যন্ত রান্নাঘরেই বন্দি থাকতে হবে, তাই না! পড়াশোনা করিয়েছেন ভালো কথা, কিন্তু...
কিন্তু আবার কী! কী হয়েছে, খুলে বলুন।
কী আর হবে! সমাজ যায়-যায়! যায়-যায় নয় বরং সমাজের পতন কোনো ভাবেই থামানো যায় না। এই পতন অনিবার্য। শুধু অনিবার্য নয়, অপরিহার্যও। শুনেছি, সে একজন যবনের হাত ধরে পালিয়েছে। শহরে গিয়ে নাকি একসঙ্গে বসবাস করেছে।
মানুষের কপাল যখন পোড়ে; তখন এমন করেই পোড়ে।
ঠিক, ভগবান যখন মারেন; তখন এমন করেই মারেন। কিন্তু শ্রীনারায়ণ রায়ের জন্য কষ্ট হয় না, হয় তার সোনার প্রতিমা স্ত্রীর জন্য।
বিস্মিত কণ্ঠে অক্ষয় দাস বললেন, স্ত্রীর আবার কী হলো?
আহা, ঠাকুর অমন স্ত্রীর কপালে এত কষ্ট লিখে দিলেন!
কীসের কষ্ট?
গঙ্গামণি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, কষ্ট কি এক রকম? এক রকম নয়! কত রকমের যাতনা তা বলা যায় না। জাত-পাত বলে একটা কথা আছে না! তাকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে।
বিদ্রুপমাখা চোখে গঙ্গামণির দিকে তাকালেন অক্ষয় দাস। নিজের দুই হাত উলটে বললেন, আরে রাখেন ওসব কথা! পরের কথা শ্রবণে আমার কোনো লাভ নেই।
গঙ্গামণি বিমর্ষভাবে, ভেজা বেড়ালের কণ্ঠে বললেন: লাভ আমারও নেই। তবে চোখকান বন্ধ রেখে তো চলা যায় না, পারিও না। এই দেখুন-না, কয়েকদিন আগে...
অক্ষয় দাস হেসে, বিগলিত কণ্ঠে বললেন: কয়েকদিন আগে আবার কী হলো!
শ্রী পরমেশ্বর দাস গত হলেন। আহা, লোকটা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।
বর্ধিষ্ণু অক্ষয় দাস বললেন, তা কি আর বলতে আছে পণ্ডিত! সকলেই তার কথা জানে।
দুঃখিতভাবে গঙ্গামণি বললেন, তার শেষকৃত্যকার্য আমিই সম্পন্ন করি। কিন্তু তার ছেলে, বাবা, জাতে বজ্জাত, হাড়কিপটে, দুই টাকা অতিরিক্ত দিলো না। হায় রে, ছেলেটি বুঝলই না, ব্রাহ্মণকে দিলে তাদের পিতাই স্বর্গে তুষ্ট থাকবে।
সে কি আর বোঝে বেদবাণী!
ঠিকই বলছেন কর্তা! ছাগল দিয়ে কি আর বলদের কাজ করানো যায়?
না, তা যায় না। তবে আপনাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। এখন বলুন তো কতটা অগ্রসর হয়েছেন?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে কী যেন কী ভেবে নিয়ে গঙ্গামণি বললেন, কোন্ কাজের কথা বলছেন কর্তা?
দেখছি আপনি ভুলে বসে আছেন। আমার পুত্রের শ্রীবৃদ্ধি বিষয়ে আমি সন্দিহান নই! তার বিচারবুদ্ধি, ভূয়োদর্শন, বাক্চাতুর্ষ প্রভৃতি—সবই আছে। তার দেহে কান্তি আছে, সৌষ্ঠব আছে, সর্বাঙ্গে কার্তিক বিরাজ করছেন; তার অশেষ গুণ; তার বাক্য প্রাণস্পর্শী, গাম্ভীর্য শ্রদ্ধেয়, জ্ঞান অসাধারণ। তার জন্য ভালো একটি পাত্রীর সন্ধান করতে বলেছিলাম। তার কী করলেন?
গঙ্গামণি ঘাড় নেড়ে অক্ষয় দাসের ওপর গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় স্বরে বললেন: আজ্ঞে, ভালো পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি।
কোথায়?
রমেশ চক্রবর্তীর কন্যা। আপনার পুত্রের জন্য উপযুক্তই বটে।
রমেশ চক্রবর্তী, তার সঙ্গে একটা পুরোনো শত্রুতা আছে, পারিবারিক শত্রুতা।
এই সুযোগে শত্রুতা চিরতরে অবসান করে নিতে পারবেন।
অক্ষয় দাস কিছুক্ষণ বিস্মিত চক্ষে গঙ্গামণির দিকে তাকিয়ে বললেন, রমেশ চক্রবর্তীর অবিবাহিত কন্যা আছে?
আজ্ঞে আছে। আমি চাঁদ এনেছি—একেবারে পূর্ণচন্দ্র, ষোলোকলা। কন্যাটি গুণবতী, রূপবতী। তপ্তকাঞ্চনের মতো বর্ণ। পদ্মফুলের মতো মুখখানি। ভুরু দুটি যেন তুলির টানে আঁকা। গোলাপের পাপড়ির মতো পাতলা দুটি ঠোঁট। তবে রমেশ চক্রবর্তীর আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল। সম্পত্তিও বোধহয় তেমন নেই। দেনদেনা আছে কি না তা বলতে পারব না। তবে তিনি তার কন্যাকে সুপাত্রে অর্পণ করতে চান।
একটু ইতস্তত করে অক্ষয় দাস বললেন, জাতের মিল আছে এমন পাত্র কিন্তু আমার ঘরে নেই।
মৃদু হেসে গঙ্গামণি বললেন: বিলক্ষণ জানি, সমজাতের না হলেও আপনি আর্থিকভাবে তার ওপরে অবস্থান করছেন। আপনি ধনী, লক্ষ্মী আপনার ঘরে অচলা হয়ে আছেন। কত দরিদ্র, আতুর আপনার অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে। আপনার অর্থকড়ির সঙ্গে রমেশ চক্রবর্তীর পেরে ওঠার কথা নয়। ঘাটে তিনটি মহাজনি নৌকা যার রয়েছে তাকে দেশে-দশে মান্য করে, সেকথা কে না জানে, বলুন!
সত্যই একটা দ্বন্দ্ব চলছে অক্ষয় দাসের অন্তরে। যত দূর অধঃপতিত এবং হীনতার মান বলে তার জানা তা একেবারেই ভুল না হলেও, দুর্বিপাকে তার মনে রমেশ চক্রবর্তীর অতীত একটা ঘটনার কু ও সু-এর কলহ ঘটছে। নিরতিশয় ক্লেশকর অপমানবোধের সঙ্গে তার মনে হতে লাগল, মানুষের মনে কত দূর নিঃসংশয় অবনতি ঘটলে একজনের অর্থলোভ আসতে পারে। ভিখারিরও কাণ্ডজ্ঞান আছে: অভাবের তাড়নায়ও গৃহ ও পরিবার রক্ষা তার ধর্ম; তারও ঘৃণার বস্তু পৃথিবীতে আছে; তার নিবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা আছে; পরলোক, পাপ-পুণ্য সে মানে; শ্রদ্ধার দাবি সেও করে; কিন্তু কোন্ অধঃপতনের অতল গহ্বরে নেমে গেলে মানুষ সমাজ-জাত এক ধারে ঠেলে দিয়ে কেবল অর্থকেই প্রাপ্তির চরম বলে মনে করে! তিনি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তার অতীতে। চোখে পড়ল, জীবনের অতীত ইতিহাসের সমস্তটা—তার যত দুষ্কৃতি, যত অপকার্য, যত অধর্ম; কিন্তু তার মনে হলো, তারাও যেন একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে তাকে নিতে পারেনি। সমতলভূমির ওপর শিলাস্তূপের মতো কঠিন হয়ে উঠল তার মন। তিনি কখনোই কারো সর্বনাশ করেননি; নিরাশ্রয় অন্নের কাঙাল করে কাউকে পথেও বসাননি। তবুও তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন গঙ্গামণির প্রস্তাব থেকে। চমকে উঠে বললেন: আমি পারব না, পণ্ডিত। সমাজ-জাত বলে একটা কথা আছে। সেখানে মিলন হওয়ার কথা নয়।
আপনার আপত্তি না থাকলে বলি, একটু ভেবে দেখুন। দু-চারদিন সময় নিন। পরে উত্তর দেবেন। আমি সময় করে এসে জেনে নেব।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একটা অবাচ্য অস্ফুট শব্দ কণ্ঠে প্রকাশ করলেন, তারপর অক্ষয় দাস বললেন: তবে তাই হোক।
বিস্ময়দৃপ্তলোচনে অক্ষয় দাসের ওপর তীব্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে গঙ্গামণি বললেন: আপনি এবার বছর যেতে-না-যেতেই মহাব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। আর তাই রমেশ চক্রবর্তী চান এরকম এক ব্যবসায়ীর ঘরে কন্যাদান করতে। তাছাড়া...
তাছাড়া?
তাছাড়া কন্যার কুষ্ঠি আমি নিজেই দেখেছি। লক্ষণ উত্তম। এমন কুষ্ঠির কন্যাকে সহজে হাতছাড়া করা উচিত নয়।
তাই!
আজ্ঞে। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, এই সম্বন্ধ হয়েই গেছে।
সম্বন্ধ হয়েই গেছে—মানে?
এটি যে প্রজাপতির নির্বন্ধ।
শুভলক্ষণের কী অপূর্ব রহস্য! গুরুজিও আমার ছেলের হাত দেখে বলে গেছেন, সে রাজপুত্র হবে। কুষ্ঠির পরিণত ফলটা আপনি যেচে আজ তার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। গুরুজি এও বলে গেছেন, এই বছরই সে স্ত্রীলোকঘটিত অর্থলাভে সুপ্রসন্ন হবে। বৃষরাশির রাজসম্মান লাভ করবে। পণ্ডিত, পরশুদিন একবার আসুন। যা বলার তখনই বলব।
মুহূর্তের জন্য চক্ষু অবনত করে গঙ্গামণি যখন চোখ তুললেন, তখন অক্ষয় দাসকে ছাপিয়ে শুধু তার খরতাপ কণ্ঠই যেন দৃষ্টির সম্মুখে বিরাজ করছে, এবং সেই কণ্ঠকে উদ্দেশ্য করে গঙ্গামণি বললেন: নারায়ণ, নারায়ণ! আমি তাহলে...
আসুন। একথা বলে কীসে যেন অক্ষয় দাসের কণ্ঠ বুজে এলো, তা তিনি নিজে ছাড়া গঙ্গামণি গ্রাহ্য করা দূরে থাক, লক্ষ্যও করলেন না। তবে তিনি লক্ষ্য করলেন অক্ষয় দাস তাড়াতাড়ি তার চক্ষু নত করছেন; যেন তাকে আর তার সহ্য হচ্ছে না।
কথা বাড়াতে গঙ্গামণির সাহস হলো না। তিনি হতভম্ব। ভীত। সন্ত্রস্ত। মনে দ্বিধা। কেমন যেন উদাসীন। করুণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। গঙ্গামণির অন্তরের খবর অবশ্য অক্ষয় দাস জানেন না। আগে গঙ্গামণির জীবন ছিল খরস্রোতা গোমতীর মতো। যৌবনকালে অর্থের রঙে রাঙাতে চাইলেও এখন কোনো অর্থ-রং তাকে ছুঁতে পায় না। অর্থের আকর্ষণেই ছুটে বেড়াচ্ছেন। অতৃপ্ত অন্তরে ছুটছেন গ্রামের গণ্যমান্য ও অর্থবান সকলের কাছে। তার বড্ড অর্থাভাব, কিন্তু অর্থ মিলছে না, মিলছে কেবল অসহিষ্ণু কঠিন বাস্তবতা। বুভুক্ষু আত্মা ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। তা যে কত বড় ব্যর্থতা আর শূন্যতা তা কেবল সে-ই জানে যার ঘটে।
পথ ভাঙতে ভাঙতে গঙ্গমণির মনে হলো: অক্ষয় দাস নিষ্ঠুর একজন মানুষ। ভীষণ নির্দয়। একটি কড়িও আজ দিলেন না। তার অর্থ-উপার্জন আজ আর হলো না। তখনই সম্মুখ দিয়ে ভেসে গেল জীবনের নিগূঢ় ইঙ্গিত—পথের ধারে ঝিঙেফুল ফুটে আছে, দিগন্ত পর্যন্ত স্বর্ণপ্রভাতের মতো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, যেন সম্মুখে কত রঙের স্তর স্তরে-স্তরে সাজানো, রঙের শেষ নেই—স্তরের প্রান্তরেখায় তরল স্বর্ণের ঢেউ; অসংখ্য সূক্ষ্ম পড়ন্ত সূর্যরশ্মি ছুটে এসে ঝিঙেফুলকে স্পর্শ করেই মিলিয়ে যাচ্ছে, বায়ুর হিল্লোলে লাস্যনৃত্য করে চলেছে ঝিঙেলতাগুলো। এই দৃশ্যটি গঙ্গমণির চোখে আগে কখনো ধরা পড়েনি। এই রূপবর্ণাঢ্য দৃশ্যটি দেখে গঙ্গামণির মনে মাঝেমধ্যে সুখচিন্তা জেগে উঠছে, সুখচিন্তা যেন অধর প্রান্তে উথলে উঠছে, তাই হয়তো পড়ন্ত সূর্যকিরণ তার মুখে পড়তে থাকে, তার চক্ষু দুটি কৌতুকোজ্জ্বল, সর্বাঙ্গে গতির লীলাতরঙ্গ; মৃত্তিকা যেন তাকে হাওয়ার ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; একটুখানি হাসিও তার অধরে দেখা দিয়েছে, যেন স্বর্গচ্যুত অমৃতের কণা। তাই তিনি মনে-মনে বলতে থাকেন: জাতে ওঠার লোভে অক্ষয় দাস ঠিকই পুত্রদান করবেন। ইচ্ছে না-থাকলেও নতিস্বীকারে বাধ্য হবেন। তখন নাহয় বেসাতি অর্থকড়ি আদায় করে নেব। গঙ্গামণির মনে হলো জীবনের অন্তহীন ধারা একটিমাত্র স্তবকে এসে—একটি রেখার সম্মুখে এসে গতি লাভ করছে। এই রেখাটি উত্তীর্ণ হতেই গঙ্গামণির পদদ্বয় দ্রুতগতিতে পথ ভাঙতে লাগল। একটুতে নেতিয়ে যাওয়ার মানুষ নন তিনি।
চলবে...
- আগের পর্ব পড়ুন
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০২
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৩
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৪
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৫
এসইউ/জিকেএস