স্বকীয়তায় শিল্প-সৃষ্টি সার্থক হয়, অনুকরণে নয়

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২৪ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২৪

আমিনুল হক

পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মতো কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো কেন চলিস?
তোর নিজস্ব সর্বাঙ্গে তোর দিলেন দাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুকু বাজে হলি, গৌরব কিছু বাড়ল তাতে?
—কামিনী রায়

প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। একজনের সঙ্গে অপরজনের মিল সত্ত্বেও কিছু বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। এই বৈসাদৃশ্যই ব্যক্তিকে আলাদা করে তোলে। আর এ বৈসাদৃশ্যটুকুই ব্যক্তির নিজস্বতা বা স্বকীয়তা। মানুষ অপরকে অনুকরণ করতে গিয়ে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। লেখালিখির ক্ষেত্রে নিজস্ব স্টাইল না থাকলে স্বকীয়তা বলে কিছু থাকে না। আর স্বকীয়তা না থাকলে ব্যক্তিত্ব হারিয়ে যায়।

ব্যক্তি সাহিত্য ও জাতীয় জীবনে স্বকীয়তার গুরুত্ব অপরিসীম। অপরের ছাঁচে ঢালাই করে নিজেকে গড়ার মধ্যে কোনো মৌলিকতা নেই। অবশ্য সেটাকে গড়া বলাও যায় না। ‘আমার’ এই শব্দটির মধ্যে যতটা আনন্দ আছে, ‘তোমার’ এর মধ্যে নেই। যেমন—আমার সন্তান, আমার স্ত্রী, আমার জমি, আমার প্রাসাদ, আমার প্রেম, আমার বংশ কিংবা আমার বই ইত্যাকার কথা মানুষের মুখে খুব আন্তরিকতার সাথে বলতে শোনা যায়। অর্থাৎ ‘আমার’ এর মধ্যে ব্যক্তি যতটা গৌরবান্বিত হন, অন্যকিছুতেই ততটা হন না। ‘আমি’ যদি ‘তুমি’ হয়ে যায়, তা হলে ‘আমার’ শব্দটির বিশেষত্ব কী! ‘আমার’ থেকেই তো নিজস্বতা বা স্বকীয়তার সৃষ্টি। তা হলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিংবা লেখালিখির ক্ষেত্রে অপরকে টেনে আনবো কেন? অপরের মতো করে আমিও কেন লিখবো? যদি লিখি তবে আমার শিল্প-সৃষ্টি হবে কীভাবে! অপরের সৃষ্টিকর্মের কৌশল ভাবনায় আসবে ঠিকই; কিন্তু তা গলাধঃকরণ করা যাবে না।

লেখালিখির প্রথমদিকে মাথায় যেভাবে আসে হয়তো সেভাবে লেখা যায়। কেননা কড়া নিয়মের মধ্যে ওইটুকু ভাবও পরে আসে না। তবে অব্যবহিত পরে তাকে খেয়াল রাখতে হবে যে, লেখাটা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে—নিজস্বতা বলে কিছু আছে নাকি অপর লেখকের মতো করে লিখে যাচ্ছেন। বাংলা সাহিত্যে কতিপয় বিখ্যাত লেখক আছেন, তারা কবিজীবনের সূচনালগ্নে অন্য কবির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ পড়লেই বোঝা যায়, তিনি কবি নজরুলের দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। জীবনানন্দ বুঝতে পারলেন ঝরা পালক তাঁর কবিতার ভিত্তিস্থল কিংবা আসল জায়গা নয়; তাই ঝরা পালকের অব্যবহিত পরে কবি সৃষ্টি করলেন নিজস্ব এক কবিতার জগৎ—‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। কেবল ধূসর পাণ্ডুলিপিই নয়; বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা কিংবা বেলা অবেলা কালবেলায় সত্যিকারের জীবনানন্দকে খুঁজে পাওয়া যায়। কবি আবুল হোসেন প্রথমদিকে রবীন্দ্রধারায় কবিতা লিখলেও পরে স্বীয় কাব্যজগতে প্রবেশ করেন। কবির ভাষ্য—‘১৯৩৯ সালের আগে যে কবিতাগুলি লিখেছি সেগুলিতে রবীন্দ্রনাথের ধারা ছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সাল থেকে লেখায় রবীন্দ্রধারা ছিল না। কবিতা পত্রিকায় ‘নবযুগ’, ‘বাংলার মেয়ে, বাংলার ছেলে’, ‘ট্রেন’—এসব কবিতা যখন বেরোলো তখনই আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। ১৯৩৯-কে আমি যাত্রার শুরুর কাল মনে করি। (কালি ও কলম, ভাদ্র ১৪২৯)

অনেকেই মনেপ্রাণে চান না যে, শিল্পে স্বকীয়তা ফুটে ওঠুক। ফলে তাদের অন্ধ অনুকরণ নতুন শিল্পসৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটায়। অপর শিল্পের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে অভিনব সৃষ্টি অসম্ভব। শিল্প মানেই যদি নকল হয়, সে ক্ষেত্রে অনুকরণকে কী বলা যায়—খাস্তা, মেকি প্রভৃতি। লেখালিখির বিষয়ে স্টিফেন হকিং উপদেশ দিয়েছেন, ‘অন্য কোনো লেখককে হুবহু অনুকরণ করে লিখবে না। নিজের স্টাইল তৈরি করো। নিজের ধ্যানধারণা থেকে নিজের মতো করে লিখো, স্বকীয়তা নিয়ে।’

নতুন লেখকদের প্রতি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের নিবেদন, ‘কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।’

কথায় বলে, ‘দুই নৌকায় পা রাখলে পানিতে পড়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে’। সাহিত্যের বেলায় এক লেখকের কাছ থেকে একটু অপরজন থেকে আরেকটু ধার নিলেও একই দশা হয়। ইমার্সনের মর্মবাণী: ‘স্বকীয়তা ধর। অনুকরণ ছাড়। অনুকরণ আত্মহত্যার শামিল। স্বকীয়তাতেই মুক্তি।’

অনুকরণে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটে না। অনুকরণ করা মানে নিজেকে সংর্কীণ করা, অন্ধ ঘরে বন্ধ করা এবং প্রকৃত শিল্পীর মাগনা কাজ করা। অনুকারীর কোনো কৃতিত্ব থাকে না বরং মূল শিল্পীকে আরও উপরে তোলা হয়। তাই অনুকারীকে বলা যায় মাগনা কামলা (বিনা বেতনের শ্রমিক)। অনুকারীর শ্রম পণ্ড হয়। একটা দৃষ্টান্ত দিই: আম্মাজান গানটি পূর্বাপর মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছে, সন্দেহ নেই। মানুষের জীবনে পিতার অবদান অপরিসীম; এ কথা কেউ অস্বীকার করেন না—করবার জো নেই। তবুও আব্বাজান গানটি মানুষের মনে রেখাপাত করেনি। ‘নকল’ শব্দটিই আব্বাজান গানকে ম্রিয়মাণ করেছে। কেউ কেউ যখন আব্বাজান গানটি শোনেন; তখন কানে ধ্বনিত হয় ‘আম্মাজান’ শব্দটি।

প্রবাদে আছে, ‘সাত নকলে আসল খাস্তা’—অর্থাৎ নকল হতে হতে আসল বিকৃত হয়ে যায়, আসলটা খুঁজে পাওয়া যায় না। আসল আর নকল দুটো এক জিনিস নয়। আসল-নকলকে স্বর্গ-নরকের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। উভয়ের মধ্যে কত ব্যবধান তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: টাকার অনেক মূল্য সত্ত্বেও জাল টাকার কোনো দাম নেই; বরং উল্টো এর নঞর্থক দিকটাই উন্মোচিত হয়। তা ছাড়া ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট কখনোই অরিজিনাল সার্টিফিকেটের সমমর্যাদা পায় না।

আমরা জানি যে, পরপর প্রয়োগকৃত কাছাকাছি চেহারার শব্দই অনুকার শব্দ। এতে প্রথম শব্দটি অর্থপূর্ণ হলেও প্রায় ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শব্দটি অর্থহীন হয় এবং প্রথম শব্দের অনুকরণে তৈরি হয়। যেমন—আম-টাম, ছাগল-টাগল ইত্যাদি। এখানে দেখা যাচ্ছে, আম আর ছাগলের মূল্য থাকলেও টাম আর টাগলের কোনো মূল্য নেই। কারণ শব্দ দুটো মূল শব্দের অনুকরণে গঠিত হয়েছে। বস্তুত টাম আর টাগল বলতে কোনো জিনিস নেই। শিল্পের ক্ষেত্রেও তেমনি। মৌলিক লেখকের মূল্য সর্বদাই থাকে; কিন্তু অনুকারী অর্থহীন, মূল্যহীন।

লেখার স্টাইল তো প্রকৃতি-প্রদত্ত, নিজের বাণীভঙ্গিকে হীন মনে করে অপরেরটা উৎকৃষ্ট ভেবে নকল করা ঠিক নয়। বরং নিজের লেখার যে ধরন আছে তারই উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি করতে হয়। তা ছাড়া, নিজস্ব-বলয় থেকে বের হলেই যে আহামরি জিনিস সৃষ্টি হবে এমন গ্যারান্টিও তো দেওয়া যায় না। সমালোচকরা কবি জসীম উদ্দীনকে তাঁর কবিতার ছন্দ পাল্টানোর উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ওঁদের কথায় কান না দিতে বলেছিলেন, ‘ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার করো। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মত। তাতে কোনো প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।’ কবি যদি অপরের কৌশল করায়ত্ত করতেন তা হলে আমরা প্রকৃত জসীম উদ্দীনকে পেতাম না।

পুতুলকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই নাচানো যায়। কলের পুতুলে লেখকের মাথায় সুচিন্তার উদ্রেক ঘটে না। তাই তাদের কাছ থেকে কল্যাণকর কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। আর তাদের প্রতি সাহিত্যসমাজের সুদৃষ্টিও থাকে না।

শিশুকে যদি বলি, এটা কার খেলনা? সে সহাস্যে বলে, ‘আমার’। সে আনন্দিত হয়। কিন্তু খেলনাটা যদি অন্য শিশুর হতো, তাহলে তার মুখে হাসির রেখা ঝিলিক দিতো না। অন্যদিকে আরেক শিশুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া বা চুরি করা খেলনাটা যদি সে আমার বলে চালিয়ে দিতো, তাহলেও সে এতটা আনন্দিত হতো না; অবোধ মনে একটা শঙ্কা লেগেই থাকতো। মাধুকর লেখকের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়ে থাকে। মাধুকরীবৃত্তি যাদের পেশা তাদের লেখক বলা যায় না।

বাহ্যজগতের দিকে তাকালে দেখা যায়, একজন যে-রঙের জামা কিনে অপরজন সে-রকম কিনতে চায় না; একটু ব্যতিক্রমী হতে চায়। তাই সে ভিন্ন ধাঁচের পছন্দ করে, যাতে দশজনের সামনে তার জামার বিশেষত্ব থাকে। কাজেই শিল্পেও যেন বিশেষত্ব থাকে। সেদিকে শিল্পীর খেয়াল রাখা উচিত।

কোনো লেখকের অক্ষরে অক্ষরে অনুকরণ করাটাও সঙ্গত নয়, অন্যায়। কোনো সমালোচক যখন কোনো লেখকের রচনাশৈলী যাচাই করেন; তখন প্রথমেই তার মাথায় আসে—রচনাটি অনুকৃত-অনুসৃত কি না। তা ছাড়া, অনুকৃত রচনা পাঠকেরও কানে পীড়া দেয়। অনুকৃত-অনুসৃত রচনা দিয়ে প্রকৃত সাহিত্য তৈরি হয় না।

অনুকরণে শিল্প-সৃষ্টি সার্থক হয় না—এমনকি সৃষ্টিই হয় না। প্রসঙ্গত, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের অভিমত স্মরণীয়: ‘অনুকরণে সৃষ্টি সম্ভব নয়’ কিংবা ‘পরানুকরণে শিল্প-সৃষ্টি সম্ভব নয়’। অনুকরণ করে কত লেখক কালের গর্ভে হারিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। শিল্প-সাহিত্যে যাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন; তাঁরা প্রাতিস্বিক প্রতিভার বলেই হয়েছেন, অনুকরণ করে নয়। আর যাঁদের রচনায় স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর নেই; তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।

একই উৎস থেকে উৎপত্তি হয়েও দুই নদীর স্রোত দুই দিকে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। কাজেই একজন লেখকের রচনায় অপরজনের সাযুজ্য থাকতে পারে; তবে রচনাটি যেন সামগ্রিকভাবে স্বাতন্ত্র্যের চেহারা লাভ করতে পারে, সেদিকে সাহিত্যশিল্পীর নজর রাখা চাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।