মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০২
গোমতীর স্রোত: রাজমালা
উর্বরতা অনার্য মন্দির ত্যাগ করে যায়
পুষ্পকুঞ্জবনে কৃষ্ণবাঁশি শুরু হয়
ঋষি বশিষ্ঠের কন্যা গোমতী। তার নামানুসারেই রাখা হয় গোমতী নদী। ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্বপ্রান্তীয় পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর (শিবের হস্তস্থিত ডুমুর) নামক স্থান থেকে উৎপন্ন। একাদশীতে গোমতী নদীতে স্নান করে শাপমোচন করা সম্ভব। তালিবন শ্যাম উপকণ্ঠের ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী তিনটি—ময়নামতি, রাঙ্গামাটি ও উদয়পুর—গোমতী নদীতীরে অবস্থিত। আঁকাবাঁকা প্রবাহপথে সাগর-তীরবর্তী কমলাঙ্কের উত্তরপ্রান্ত ও ময়নামতির পূর্বপ্রান্ত অতিক্রম করে বয়ে চলেছে। প্রবাহপথের উত্তরদিকে বুড়িচং স্থানটিকে ডানে রেখে এটি দেবীদ্বারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমদিকে বাঁক নিয়ে শেষাবধি মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
ময়নামতি এক শক্তিশালী রাজ্যের রাজধানী হওয়ার মতো তার ভৌগোলিক অবস্থান, বিশেষ করে রাজ্য-সম্প্রসারণের জন্য এই স্থানটি সুবিধাজনক। কুকিপ্রদেশ অন্তর্নিবিষ্ট থাকলেও বর্মণদের রাজ্যটি ত্রিপুরার করায়ত্তে না আনতে পারলে শক্তিশালী কোনো রাজ্যের স্বপ্ন দেখা অর্থহীন। ত্রিপুরা রাজ্য স্বর্ণখণ্ড। সমগ্র কুকিপ্রদেশ, মিতাই রাজ্য, শ্রীহট্ট সমেত উত্তরে তৈরঙ্গ নদী, দক্ষিণে রসাঙ্গ (আরাকান), পূর্বে মেখলি (মণিপুর সীমান্ত), পশ্চিমে কাচবঙ্গ (বঙ্গ সাম্রাজ্যের সীমানা)—অন্তর্নিবিষ্ট। ফসলের প্রাচুর্য ও প্রজাদের শৈল্পিক দক্ষতা অতুলনীয়। যে কোনো রাজ্যের জন্য এটি বিশাল সম্পদ। বর্মণরা পার্বত্য অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গা দখল করে রেখেছে। পশ্চিমের বঙ্গ-সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লেও এক সময়ে ছিল সম্পূর্ণ আর্যাবর্ত জুড়ে এবং উত্তরে সম্প্রসারিত হয়ে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাছাড়া দাক্ষিণাত্যের রাজাদের সার্বক্ষণিক লক্ষ্য ছিল বঙ্গ-সাম্রাজ্যের ওপর। এই ক্ষেত্রে রাঢ়ও নিরাপদ ছিল না। কামরূপ পর্যন্তও বঙ্গ-সাম্রাজ্যের বিস্তার লাভ সম্ভব হয়। এখন বঙ্গ-সাম্রাজ্যের সঙ্গে ত্রিপুরা-রাজ্যের সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে চলেছে। তাছাড়া বঙ্গ-সাম্রাজ্য যতটা সম্ভব মণিপুরের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ এড়িয়ে চলছে।
গোমতী ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থলে—সমুদ্রের মতো বিস্তৃত জলপথে—ভেসে চলেছে অসংখ্য পালতোলা নৌকা। ছোট-বড় এসব নৌকার পালের বিচিত্র গড়ন ও রঙের বাহার এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। চন্দ্রবংশীয় ত্রিপুরার মহারাজা দ্রুহ্য মাণিক্য কিছুদিনের জন্য ময়নামতিতে অবসর সময় কাটানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। যুদ্ধবিগ্রহে পুরোপুরি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত তিনি। অস্ত্রের ঝনঝন তার আর পছন্দ হচ্ছে না।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য কয়েকদিন ভেসে বেড়াচ্ছেন গোমতী নদীর সীমাহীন জলের নিরবচ্ছিন্ন স্রোতধারায়। এক ঝাঁক অতিকায় হাঁসের মতো নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে তার নৌবহর। মাঝখানে মহারাজের বজরা। তার বজরাকে পাহারার জন্য নিয়োজিত নৌকাগুলো দূরে থেকে তিনটে ছোট থেকে বড় বৃত্ত তৈরি করে রয়েছে। তিনটে বৃত্তের ভেতর প্রবেশের সাধ্য অন্য কোনো নৌকার নেই। নৌবহর যখন দুই কূলের কোনো নিশানা দেখতে পায় না, তখন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মনে হয়, তিনি যেন সত্যিই সমুদ্রে ভেসে চলেছেন। নদী ছুঁয়ে আসা স্নিগ্ধ ঝিরঝিরে হাওয়া প্রাণমন জুড়িয়ে দেয়। সঙ্গী তার অবশ্য রাজকবি রাধারমণ।
রাধারমণের উদ্দেশ্যে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: নতুন দু-একটা ছত্র শোনান না, রাধারমণ! কালিদাস থেকে দুটি চরণ আবৃত্তি করার পর তাঁকে থামিয়ে দেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য: আপনার কাছে বঙ্গীয় মহাকবি কালিদাসের কবিতা শুনতে চাইনি, রাজকবি। বলুন যদি আমিই আপনাকে সারাদিন শ্রীহর্ষ, ভারবি, কালিদাস প্রমুখের কবিতা শোনাতে পারি। তার চেয়ে বরং আপনার অন্তরে কী আছে তা-ই প্রকাশ করুন, রাজকবি।
মহারাজ, ওগুলো তো সব রাজ্যজয়োল্লাস আর রাজপ্রশস্তি, সভাগৃহে ওসব শোনায় ভালো, এই নৈসর্গিক নদীর বুকে...
আবারও তাঁকে থামিয়ে দেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য, বললেন: এই নদীর বুকে ঢেউ খেলে না? এখানের আকাশে পাখি ওড়ে না, মেঘ ভেসে বেড়ায় না? সমীরণ বয়ে চলে না, রাত্রিতে শুক্লা একাদশীর চাঁদও ওঠে না...! এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। শুক্লার নাম আজ এতদিন পর কণ্ঠে এলো কী করে! সঙ্গে সঙ্গেই পাথর দিয়ে চাপা দেন মনের প্রকোষ্ঠে। না, মহারাজের কোনো দুর্বলতা থাকতে পারে না। মহারাজের প্রেমরাজ্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। মহারাজের পুষ্পকানন হলো রণক্ষেত্র। মহারাজের পুষ্পমঞ্জরি হচ্ছে ঢাল আর তরবারি। মহারাজের ভালোবাসার পাত্র অসংখ্য প্রজা। রাজ্যের সমগ্র প্রজা। একটু ভেবে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য যোগ করলেন: কী হলো রাজকবি, শব্দ খুঁজছেন বুঝি, না ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন?
রাধারমণ নিজেকে সামলে নিয়ে শুধালেন: মহারাজ, এই-যে নিসর্গের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছি, তার চেয়ে বড় কবিতা আর কী হতে পারে? শব্দ দিয়ে কি এর রচনা সম্ভব? অসম্ভবই বটে।
আপনি রাজকবিই বটে রাধারমণ! যান, জেলেনৌকায় গিয়ে ওদের সঙ্গে মাছ ধরেন।
শাপটা অঞ্চলে—যেখানে গোমতী ও মেঘনা নদী এসে মিশেছে সেখানে—পৌঁছে বিস্ময়ের সীমা আর রইল না মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের। নৌপথে আগে আর কখনো আসেননি তিনি এখানে। মেঘনা নদীর উত্তাল প্রবাহের অনেক কাহিনি লোকমুখে শুনেছেন তিনি বটে, কিন্তু এ যে এত প্রমত্তা তা চোখে দেখার আগে কল্পনা করতে পারেননি। মেঘনার তীব্র স্রোতে ভেসে দক্ষিণের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেছে মহারাজের নৌবহর। ফেরার যাত্রা কল্পনা করে একটু ভাবনায় পড়লেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। উত্তাল নদীর প্রবল এই স্রোত ঠেলে উজানে যেতে আবার কত দিন লেগে যাবে কে জানে! মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে আশ্বস্ত করেন প্রধান নৌচালক: এই সময়ে হাওয়া বয় দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পাল তুলে স্রোতের বিপরীতে এগোনো খুব কঠিন হবে না। জলের চেয়ে বায়ুশক্তি বেশি!
মনে-মনে হাসলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। তবে প্রধান নৌচালকের কথায় আশ্বস্ত হলেন তিনি। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের নির্দেশে গোমতী ও মেঘনার সঙ্গমস্থল শাপটা অঞ্চলেই যাত্রাবিরতি নেওয়া হলো। নিম্নবঙ্গের এই ভাটি অঞ্চলের সৌন্দর্য তার মন কেড়ে নিয়েছে। বঙ্গ-সাম্রাজ্যের উপকণ্ঠে পৌঁছেছে রাজনৌবহর। চারদিক থেকে জলঘেরা জায়গা এটি। বর্মণদের পক্ষে এমন জায়গা জয় করা প্রায় অসম্ভব। পদাতিক ও নৌসেনাদের সমন্বয়ে হয়তোবা সম্ভব হতে পারে। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কাছে শাপটা অঞ্চলটি বড্ড অরক্ষিত মনে হলো, ভেবে অবাক হন তিনি, যেখানে দুর্গই বিশ্বের অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর রক্ষাব্যূহ, সেখানে বঙ্গসম্রাটরা কেন এখানে কোনো দুর্গ নির্মাণ করেননি! বঙ্গসম্রাটদের অবহেলার কারণেই হয়তো শাপটা অঞ্চলে কোনো শক্তশালী প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তোলা হয়নি। ফলে ময়নামতি নিরাপদে রয়েছে। কিন্তু যদি কোনো শক্তিশালী বঙ্গসম্রাট উপযুক্ত নৌবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন, তাহলে ময়নামতি আর নিরাপদ থাকবে না। তখন উদয়পুর বা রাঙ্গামাটিই আত্মরক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হয়ে পড়বে। তাই রাঙ্গামাটি ও উদয়পুর দুটিই ত্রিপুরার রাজধানী হিসেবে রক্ষা করা আবশ্যক।
নিম্নবঙ্গের এই অঞ্চলে প্রচুর কাঁঠাল জন্মায়। পোড়ামাটির তৈজস ও অলংকার বানায় এখানের মৃৎশিল্পীরা। কয়েকটা কুমোরপাড়া রয়েছে আশেপাশে। নৌকাগুলোর সম্মুখভাগ কাঁঠাল ও মাটির হাঁড়িপাতিলে ভরিয়ে তোলে রাজানুচররা। নিম্নবঙ্গের এই অঞ্চলের সৌন্দর্য মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কৈশোরের দিনগুলো মনে করিয়ে দেয়। মাটির রং এখানে ভিন্ন, কিন্তু প্রকৃতি ত্রিপুরার মতোই—গাঢ় সবুজ। ত্রিপুরার নিচু পাহাড় থেকে বয়ে আসা মিষ্টি বাতাস, বুনোফুলের গন্ধ, পোষাপ্রাণীগুলোর চকচকে শরীর, ওদের ছোটখাটো আকার—সবকিছুই কেমন যেন ভালো লেগে যায় মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের। এখানের গরুগুলো ত্রিপুরার বড় ছাগল থেকে সামান্য বড়। দেখতে খুবই সুন্দর। বেশিরভাগ মাটিই তো রাঙ্গামাটির মতো লাল। উদয়পুরের মেঘহীন, শুকনো কৈশোরের দিনগুলো এখন থেকে অনেক দূরের মনে হয়, যেন ফেলে এসেছেন সেইসব দিন! জীবনের নিত্যকমের্র ভেতর এখন কোনো কিছুরই আর অবসর নেই। এমনকি এই-যে প্রমোদবিহারে বের হয়েছেন, মাথার ভেতর সারাক্ষণ কাজ করে চলেছে ভবিষ্যতের ভাবনাসমূহ। কী এক জীবন যে দিয়ে পাঠিয়েছে ঈশ্বর! এখানের বকপাখিগুলো এত সুন্দর, অবাক হয়ে দেখেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য! একদল বকপাখি দূরে ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে তার মনে পড়ে গেল, রাজবাড়ির পায়রাগুলোর কথা। রাজপ্রাসাদের অলিন্দ থেকে তিনি যখন হাততালি দেন, ওরা ডিগবাজি খেয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে। অলিন্দের কাছাকাছি এসে আবার উড়ে যায় উন্মুক্ত আকাশে। তখন তিনি ব্যথিত মনে হাততালি থামিয়ে দেন। আবার যখন তিনি হাততালি দেন তখন একই ঘটনা ঘটে। পায়রাদের স্মৃতিচারণের আনন্দের ভেতর ডুবে রইলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য কিছুক্ষণ।
একদিন সন্ধ্যায় ঝিরঝিরে হাওয়ায় মধ্যনদীতে বজরায় নৃত্যগীতের আসরের আয়োজন করা হয়। এই আসরে প্রথম রাজকবি রাধারমণ নতুন কবিতা বাঁধেন। তারপর মণিপুরের এক নর্তকি বাংলায় টপ্পাগীত শোনায়। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়। ওর কণ্ঠের অসাধারণ কারুকাজ মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে অভিভূত করে। গীতের ভাষা তার খুব পছন্দ হয়। এর চর্চা ও ব্যবহারের জন্য আদেশ দেন তিনি। রাজনর্তকি হিসেবে রেখে দেওয়া হয় তাকে।
একদিন সকালে ছোট-বড় শালবৃক্ষ-ঘেরা সুনসান একটি বনাঞ্চল পেয়ে হাঁটতে বেরুলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। হঠাৎ স্থানীয় একদল মানুষের সাক্ষাৎ পেলেন তিনি। তিনি ও রাজানুচরদের দেখে লোকগুলো ভাবতে থাকে: কোনো বিতাড়িত বা পরাজিত গোত্রের মানুষ ওরা। দলটির একজন জিজ্ঞেস করল: মহাশয়রা কি দূরাগত?
রাধারমণ বললেন, আজ্ঞে মহাশয়।
দ্বিতীয় বলল, পলাতক, না পরাজিত?
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, এমনটা ভাবার কারণ কী মহাশয়, জানতে পারি?
তৃতীয় বলল, আপনাদের দেখে তেমনই সন্দেহ হচ্ছে।
চতুর্থ বলল, আপনারা কখনোই ভ্রমণকারীর দল হতে পারেন না!
রাধারমণ বললেন, আপনাদের দেশের মানুষেরা কি ভ্রমণ করে না? আপনারা কি জানেন যে, পর্যটনের অধিকার শাস্ত্র আমাদের কতটুকু দিয়েছে, আপনারা কি শাস্ত্রানুসারী নন?
রাধারমণের নরম সুরের বলা কথায় কিছুটা সহজ হয়ে ওঠে লোকজন। প্রথম বলল: আজ্ঞে মহাশয়, আমরা শাস্ত্রানুসারী। কিন্তু আমাদের জ্ঞান সীমিত, অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবেন আমাদের।
দ্বিতীয় জানতে চাইল, মহাশয়দের আগমনের হেতু জানতে পারি?
রাধারমণ বললেন, নিছকই প্রমোদভ্রমণ।
একটু ভেবে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, বিকেলে আমাদের বজরায় আসুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।
তৃতীয় বলল, মহাশয়রা কি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছেন?
চতুর্থ বলল, সমুদ্রের ধারণা অবশ্য আমাদের নেই, মহাশয়! জল কতটা বেশি হলে একটা সমুদ্র্র হয়?
রাধারমণ বললেন, এই বিষয়টি আমাদেরও অজানা।
পঞ্চম বলল, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এলে শুদ্ধি-অনুষ্ঠান করতে হবে আপনাদের।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, শুদ্ধি কেমন করে হবো, তা ব্যাখ্যা করার জন্য আপনারা বিকেলে আসুন আমাদের বজরায়।
ষষ্ঠ বলল, কোন্ ঘাটে মহাশয়দের বজরা?
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, এখানে কি অনেক ঘাট আছে? আমাদের বজরা মাঝনদীতে নোঙর ফেলা।
সপ্তম বলল, ঘাট বলতে অনেক কিছু বোঝায়, মহাশয়...। তারপর একটু থেমে বলল, তা ঘাট আছে বইকি। ঠিক আছে, বিকেলে এখানে আসব আমরা।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, আপনাদের এখানে দর্শনীয় কিছু আছে মহাশয়? ঘুরেফিরে দেখতে পারি?
প্রথম বলল: ভাটির দেশ, এখানে দেখার আর কী থাকবে! এক সময় আমাদের অঞ্চল চন্দ্রবংশীয় রাজাদের অধীন ছিল। তারপর পালরাজা এসে ওদের তাড়িয়ে দিলেন। পূর্ব-দক্ষিণ থেকে বর্মণরা এসে অনেক দিন এই অঞ্চলটি দখল করে রেখেছিল। আমাদের মতো বৈষ্ণব ছিল ওরা। এখানকার মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে স্থানীয় হয়ে উঠেছিল। তারপর সেনরাজাদের দখলে চলে যায় দেশ। তারা ছিলেন শিবভক্ত। এইসব পালাবদলে আমরা আর সংঘবদ্ধ থাকতে পারিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য মহাশয়, কোনো একটা রাজবংশ আমাদের অঞ্চলে দীর্ঘসময় স্থায়ী হতে পারেনি। তাই কোনো দর্শনীয় স্থান গড়ে ওঠেনি। তবে একটু অগ্রসর হলে শত শত চাষি ও জেলে বসতি দেখতে পাবেন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তারা না থাকলে আপনাদের জন্য চাষবাস করে দেবে কে? মাছ ধরবে কে? রাজ্যের সেবা দেবে কে?
দ্বিতীয় বলল, তাদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কথা বলিনি, মহাশয়। ইচ্ছে হলে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তাদের সাক্ষাৎ লাভ করাই উচিত।
তৃতীয় বলল, কী বলছেন মহাশয়!
রাধারমণ বললেন, আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুল সমান নয়, বিধাতাও সমান করে সৃষ্টি করেননি। মানুষও তেমনই। জগৎ-সংসারের সবকিছুও তেমনই।
পঞ্চম বলল, মানুষ আঙুল নয়, মহাশয়।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, চাষি জেলে কি আপনাদের কোনো ক্ষতি করেছে?
তৃতীয় বলল, না, ক্ষতি করার ক্ষমতা কি তাদের আছে?
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তাহলে?
প্রথম বলল, মহাশয়রা দেখছি, বুঝেও বুঝতে চাইছেন না! তারপর মহারাজের উদ্দেশ্যে যোগ করল: আপনার দীর্ঘ ও শক্তিশালী শরীর দেখে মনে হচ্ছে আপনি ক্ষত্রিয় বংশীয়।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, এখানের আবহাওয়া মনে হচ্ছে সহজে মানুষকে উত্তেজিত করে তোলে। ঠিক আছে মহাশয়রা, বিকেলে আপনাদের নিয়ে যেতে আমাদের লোক এখানে আসবে। দিনের তাপমাত্রা এত বেড়েছে যে, মস্তিষ্ক শীতল রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
চতুর্থ বলল, ঠিক আছে, সেই কথাই রইল। ইচ্ছে হলে সামনে কিছুটা এগিয়ে গেলে নদীতটে একটা শিবমন্দির দেখতে পাবেন। নদীর হাওয়া খেতে খেতে সেখানে বিশ্রামও নিতে পারেন।
চোখ দিয়ে একটা ইঙ্গিত দেয়। বুঝতে কোনো অসুবিধে হলো না মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের, এখানে বৈষ্ণব ও শিবভক্তরা রয়েছে। তার ধারণা ছিল এই অঞ্চলটি বৌদ্ধপ্রাধান্য, কেননা সকালে ভিক্ষুর একটা দল দেখেছিলেন তিনি, নদীতে স্নান করছে। গ্রামের এই দলটি যে জেলে ও চাষিদের কথা বলেছে তারা হয়তো বৌদ্ধ হবে। না হলে এত বড় একটা ভিক্ষুর দল টিকে থাকে কী খেয়ে!
দুপুরে আকাশ কালো করে মেঘ ভাসতে লাগল। তীব্র বাতাসও। বাতাস থামতে-না-থামতেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি গাছের পাতার রংকে আরও গাঢ় সবুজ করে দিচ্ছে। কোনো কোনো গাছের কচিপাতার রং হালকা সবুজ। বিকেলে বৃষ্টি থেমে গিয়ে সূর্য উঠল আবার। গাছ-পাতা টিয়েপাখির পালকের রং ধারণ করল।
রাজানুচরদের সঙ্গী হলেন রাধারমণও। নদীতীরে পৌঁছে তিনি দেখলেন গ্রামবাসীরা সেজেগুজে, কপালে চন্দনতিলক এঁকে, চুলে সিঁথি কেটে বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে অপেক্ষমান। তিনি এও দেখলেন, গ্রামবাসীদের মধ্যে বাসন্তী রঙের বস্ত্র পরিহিত, মুণ্ডিত শিরের একজন বৌদ্ধভিক্ষু বসে আছেন। তিনিও রাজবজরায় যাবেন কি না তা তিনি জানেন না। দূর থেকে দেখা গেল, গ্রামবাসীরা সকলেই শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সকলেই প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজানুচরদের নৌকাটি ঘাটে ভিড়ল। সকলের কোলাহল রাধারমণের কর্ণমূলে প্রবেশ করল। তাকে নৌকা ছেড়ে কোথাও যেতে নেই, তাই তিনি উদাসীনভাবে কয়েক মুহূর্ত নৌকার ওপর চক্ষু মুদ্রিত করে বসে রইলেন। চক্ষু মুদ্রিত করে ভাবতে লাগলেন, ভাবলেন: এই বৌদ্ধভিক্ষু কি এখন নৌকায় আরোহণ করেছেন? তিনিও কি গ্রামবাসীর সঙ্গে রাজবজরায় চললেন? নাকি, ঘাটের ওপরই বসে রয়েছেন? যতক্ষণ চক্ষু মুদ্রিত থাকবে, তা তিনি জানতে পারবেন না। বৌদ্ধভিক্ষু নৌকায় উঠতে পারেন, সেই সম্ভাবনাও আছে। আবার তিনি ঘাটেও বসে থাকতে পারেন, সেই সম্ভাবনাও বর্তমান। হয় তিনি নৌকায় উঠবেন, নয়তো ঘাটেই বসে থাকবেন—তা-ই রাধারমণের সাধারণ ধারণা। কিন্তু একদল উচ্চশ্রেণির বঙ্গীয় দার্শনিকরা বলে থাকেন যে, যতক্ষণ-না চক্ষু উন্মীলন করা হচ্ছে, ততক্ষণ এই ভিক্ষু ঘাটে, না-হয় নৌকায় অবস্থান করার সম্ভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু যখনই চোখ খোলা হবে, তখনই এই দুই প্রকার সম্ভাবনার কোনো একটি সত্য বলে প্রতিভাত হবে, অন্য সম্ভাবনাটি মিথ্যে বলে প্রমাণিত হতে পারে। যদিও এই অপর সম্ভাবনা অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বে ঘটতে পারে। রাধারমণের মনে হলো, ব্যাপারটার মধ্যে কেমন এক শান্ত ও কম্পনশূন্য কী যেন আছে। রাধারমণ উচ্চশ্রেণির বঙ্গীয় দার্শনিকদের যুক্তিগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চক্ষু উন্মুক্ত করেন; সঙ্গে সঙ্গেই অবগত হন যে, নদীঘাটেই বৌদ্ধভিক্ষু আগের মতোই বসে আছেন। তখনই তিনি ধারণা করলেন যে, অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বে বৌদ্ধভিক্ষু নৌকায় আরোহণ করে রাজবজরার দিকে চলছেন। তখনই তার চিন্তাকাশে উদ্ভাসিত হয় যে, এই বিশ্বের একটি নদীঘাটে উপবিষ্ট বৌদ্ধভিক্ষুর সঙ্গে যদি অপর সমান্তরাল বিশ্বের নৌকায় আরোহণকারী ভিক্ষুর কোনো ভাবে দেখা হয়ে যায়! একে অপরের প্রতিবিম্ব; এক-একজন এক-এক প্রকার সম্ভাবনার ফলে দেখা হয়ে গেলে কেমন হবে? একজনের অপূর্ণতা অন্যজনের পূর্ণতা দেখে তাদের কী মনে হবে? বিস্ময়, কাতরতা, ক্রোধ, প্রেম, শান্তি? কী প্রকার ভাব উদিত হবে? দেখতে রাধারমণের ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। অন্তহীন সম্ভাবনার উত্তাল চিন্তার মধ্যেই এক সময় নৌকা এসে স্থির হয় রাজবজরার নিকট। রাধারমণ উঠে দাঁড়ান। তাঁর মনে তবুও দোলাচল চলতে থাকে। কল্পনায় যেন এক অন্য কালের অন্য নদী প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন।
রাজানুচররা গ্রামবাসীদের রাজবজরায় নিয়ে এলো। একটা আমোদ-প্রমোদের ভাব গ্রামবাসীদের অন্তরে বিদ্যমান। রাজবজরার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পরই এক প্রকার ভীতুচিহ্ন দেখা দেয় তাদের চোখে-মুখে। এখানে রয়েছে রাজকীয় পরিবেশ, সুন্দরী গায়িকা ও নর্তকীদের সমাবেশ, খাবারের বিশাল আয়োজন। এসব দেখে সাধারণ গ্রামবাসীদের ভয় পাওয়ারই কথা। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে তারা ভেবে নিয়েছিল ভাগ্যান্বেষী কোনো ক্ষত্রিয় হিসেবে। বেদে নৌবহর যেমন জীবিকার সন্ধানে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়, তেমনই এদেশে কিছু ক্ষত্রিয় আছে যারা সব সময় থাকে সুযোগের সন্ধানে। তারা যাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়, তাদের জন্য যুদ্ধ করে। তবে যুদ্ধটা করে পেশাদারিত্ব নিয়ে, প্রাণপণে। নিজেদের ক্ষত্রিয় চরিত্রের স্খলন ঘটায় না। যোদ্ধা হিসেবে তাদের কোনো ফাঁকি নেই। যখন যুদ্ধকর্ম থাকে না, তখন হয়তোবা ঘুরে বেড়ায় তারা। বিশাল এই রাজবজরা মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের ভাসমান রাজপ্রাসাদ। তারই উন্মুক্ত জায়গায় বসেছে বিলাস আসর। দিনান্তে যখন সূর্য অস্ত যায়; তখন গ্রামবাসীরা আহারাদি সমাপন করে। অতঃপর বিলাস বিশ্রাম। অতঃপর পেছনের একটি রাজকীয় বজরার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। গ্রামবাসীর দলটি কাঁচুমাচু হয়ে গালিচার এক কোণায় বসে থাকে। কিছুটা কৌতুকবোধ করলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য, তাই জিজ্ঞেস করলেন: মহাশয়দের আহারাদি ও বিশ্রাম ভালো হয়েছে তো?
প্রথম বলল, আজ্ঞে মাননীয় মহাশয়।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য লক্ষ্য করলেন ‘মাননীয়’ শব্দটি এবার জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রাজানুচরদের ও রাধারমণকে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল যেন তার পরিচয় প্রকাশ না করা হয়।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: অতি উত্তম। মহাশয়রা কি কাব্যকলা পছন্দ করেন? আগন্তুকদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে তিনি যোগ করলেন: ঠিক আছে, রাজকবি রাধারমণ, শোনান কিছু কবিতা তাহলে।
রাধারমণ শুরু করলেন: জিম জিম করিআ করিণিরে রিসই; তিম তিম তথতা মঅগল বরিসই।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, এই কাব্যের অর্থ কী?
রাধারমণ বললেন: হস্তী যদি হস্তিনীকে ঈর্ষা করে, তবুও খাদে নিপতিত হস্তীকে দেখে হস্তিনী অশ্রুবর্ষণ করে।
গ্রামবাসীর দলটি একেবারে চুপসে গেল। শুরুতেই তাদের নিয়ে এমন খোঁচাখুঁচি, পরে না-জানি কী আছে, ঈশ্বরই জানেন!
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য জিজ্ঞেস করলেন, এটি কি আপনার নতুন রচনা, রাজকবি?
রাধারমণ বললেন: না মহারাজ, সমাজে প্রচলিত একটি চর্যা। শুনেছি, চর্যাপদ একজনের রচনা নয়। চর্যাপদের কবিরা নাকি বঙ্গীয় সমাজের আড়ালে ও অভ্যন্তরে মিশে থাকতে পছন্দ করতেন। তাই চর্যাপদ সমাজেরই রচনা। এরকম হাজার হাজার চর্যাপদের দোহাকোষ রয়েছে।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, ভাষা শ্রুতিমধুর!
রাধারমণ বললেন, আজ্ঞে মহারাজ।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য অনুরোধ জানালেন, আরেকটা শোনা যাক তাহলে।
রাধারমণ বললেন: কমল কুলিশ মাঝে ভইঅ মইলী; সমতা জোএ জলিঅ চণ্ডালী। অর্থাৎ, কমল কুলিশ মাঝে মৃত হয়ে চণ্ডালী সমতাযোগে প্রজ্বলিত হলো। সহজ অর্থ হচ্ছে মহারাজ: আমি মারা গেলে তারপর বুঝবে।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: ছন্দ মাটিঘেঁষা। ভাষায় সংস্কৃতের খট্টাং খট্টাং বা প্যাঁচ নেই। প্রাচ্যভাষার সহজ অভিব্যক্ত। প্রাণ আছে এতে। আপনার কাব্যচর্চা এই ভাষায় চালালে হয় না, রাজকবি?
রাধারমণ বললেন, চেষ্টা করবো মহারাজ।
তা-ই করুন, রাজকবি।
ঠিক আছে, মহারাজ।
গ্রামবাসীর দলটি একটু নড়েচড়ে বসল। এতক্ষণে তারা বুঝতে পারল, কোথায় এসে পড়েছে। তাদের একটু হালকা ও চাঙা করে তুলতে চান মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। কাব্যরস যে তাদের উজ্জীবিত করতে পারছে না তা বুঝতে পারলেন তিনি। তাই নির্দেশ দিলেন নর্তকিদের উপস্থিত হওয়ার জন্য।
বীণায় ঝংকার উঠল। খোলে বোল ভাঙতে শুরু হলো। গ্রামবাসীর দলটিকে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: মহাশয় সহজ হয়ে বসুন। এটি কোনো রাজসভা নয়। ক্ষণিক আনন্দের জন্য এক আবহ তৈরি করা হয়েছে মাত্র। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে ভুলে থাকার জন্য। এর চেয়ে বেশি কিছুই নয়।
ধীরে ধীরে নর্তকীরা নৃত্যগীত শুরু করল।
রাজভৃত্যদের আদেশ দেওয়া হয় পানীয় সরবরাহের জন্য। কিছুক্ষণ পান করে ও গীতনৃত্যের আবেশে মুগ্ধ হয়ে সত্যি সত্যিই চাঙা হয়ে উঠল গ্রামবাসীর দলটি। নদীর যেখানে নৌকাগুলো নোঙর ফেলেছে, এখান থেকে নদীতটের ভূমির চিহ্ন প্রায় অদৃশ্য; আকাশের নিচে সবুজ এক ফিতের মতো মনে হয়।
রাজকবি রাধারমণ ও মণিপুরের সেরাসব সুন্দরী নর্তকির উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে মধ্যযাম পর্যন্ত নৌবিহারে প্রমত্ত পানভোজন ও নৃত্যগীত উপভোগ করে কাটিয়ে দিলো গ্রামবাসীর দলটি। এখন তাদের শরীরে অবসাদ। তা দেখে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য অতিথিদের বিশ্রামের জন্য নির্দেশ দিলেন। ভোরে রাজানুচররা নৌকাযোগে অতিথিদের নদীতটে ফিরিয়ে দিলো। তাদেরই মুখ থেকে অতিথিরা জানতে পারল, আসরের মধ্যমণি ছিলেন ত্রিপুরার মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য।
নিম্নবঙ্গের শাপটা অঞ্চলে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের রাজকীয় নৌবহর অবস্থান করে সারা বর্ষাকাল। শরতের নদী এখনো খরস্রোতা। জল অনেকাংশে ঘোলা। মধ্যনদী কিছুটা পরিষ্কার। খরস্রোতা আর দুকূল প্লাবিত কীর্তিনাশিনী মেঘনার উন্মত্ততা দেখে শরৎকালেই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ময়নামতিতে ফেরার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। যেদিন যাত্রা শুরু করবেন, ঠিক সেদিনই, হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি এসে দিনটিকে গুমোট জলহাওয়ার দিকে ঠেলে দিলো। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় সূর্যের আলোয় নদীটিকে চকচকে দেখাচ্ছে। শক্তিশালী স্রোত ও বাতাসে প্রায় উড়ে বাঁক ঘুরে এগিয়ে চলেছে রাজকীয় নৌবহর। নদীর ওপার দিয়ে এক সারি মাঝি রাজকীয় নৌকার গুণ টেনে চলেছে উজান বেয়ে। ময়নামতি পর্যন্ত স্রোত উজিয়ে যেতে হবে তাদের। অনুকূল বাতাস পেলে পাল তোলা যাবে, নয়তো গুণ টেনে অথবা দাঁড় বেয়ে অগ্রসর হতে হবে।
দিনকয়েক পর, রাজবজরা গোমতী নদীর বাঁক ঘুরে ময়নামতিতে এসে উপস্থিত হলো। তাকে অনুসরণ করে ছোট-বড় নৌকাগুলো টালমাটাল ভঙ্গিতে এসে রাজঘাটে এসে পৌঁছলো।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন
>> গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১
এসইউ/জিকেএস