সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুলের সমকালীন ভাবনা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২৪

বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতো আগমন যার। বিদ্রোহ-প্রেম-সাম্যবাদের মশাল হাতে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নানাবিধ সমস্যা-সংকটে যখন বিশ্ব আলোড়িত; তখন আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। সালটি ১৮৯৯। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যখন মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত; তখন তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের গান। একই কণ্ঠে হামদ-নাত এবং শ্যামা সংগীতের সুরের মূর্ছনায় মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী। যা সমকালে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এখনো সাম্যবাদের প্রসঙ্গ এলে কবি নজরুলের বাণী শোনা যায় সবার মুখে।

কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র মানুষ। কে কুলি-মজুর আর কে সাহেব? সবাই তার দৃষ্টিতে সমান। আশরাফ আর আতরাফের কোনো ভেদাভেদ নেই এখানে। সবাই সৃষ্টির সেরা। সবাইকেই তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। নজরুলের সাম্যবাদ তার অন্তরের প্রেরণালব্ধ বস্তু। কবি কল্পনার রঙে রঙিন। মানবতাবোধই তার সাম্যবাদের ভিত্তি। তিনি সব ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবধর্মকেই উচ্চাসনে বসিয়েছেন। মানবের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেছেন। কেননা সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্ট জীব মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে কবি নজরুলের সাম্যবাদ স্রষ্টাকে অস্বীকার করে নয়। কাল মার্কসের মতো তার সাম্যবাদ নাস্তিক্য সাম্যবাদ নয়। তার সাম্যবাদ আস্তিক্য সাম্যবাদ। অসাম্প্রদায়িক হলেও তিনি পুরোপুরি আস্তিক ছিলেন।

নজরুলের সাম্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে তার ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৫২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন- ‘সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘মানুষ’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘ঈশ্বর’, ‘পাপ’, ‘কুলি-মজুর’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘সাম্য’ ও ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’। মূলত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের কবিতাগুলোয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়াও নজরুলের অনেক কবিতায় সাম্যবাদের উচ্চকিত উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কবিতাগুলো হলো—‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যের গান’, ‘মানুষ’, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’, ‘ভাঙার গান’, ‘বন্দি বন্দনা’, ‘রণভেরি’, ‘আত্মশক্তি’, ‘মরণ বরণ’, ‘বন্দনাগান’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘ধীবরদের গান’, ‘কৃষাণের গান’, ‘দীপান্তরের বন্দিনী’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘মুক্তিসেবকের গান’, ‘ছাত্রদলের গান’, ‘সাবধানী ঘণ্টা’, ‘উদ্বোধন’ প্রভৃতি।

মূলত অন্তরে প্রেম আর বিদ্রোহ না থাকলে সাম্যবাদ আসে না। সবাইকে সমান চোখে দেখার জন্য অন্তরে প্রেম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মানসিকতা থাকতে হয়। কাজী নজরুল ইসলামের হৃদয়ের এই হাহাকারই তাকে সাম্যবাদী হিসেবে তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে লেখক শামস্ আলদিন তার ‘‘সাম্যবাদী’র চেতনা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার আদর্শ ছিল আলাদা। তিনি দেখেছেন ভারতবাসীর ওপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্মম অত্যাচার এবং শোষণকে। এই উদ্দেশ্যের পথে শ্বেতাঙ্গরা সঙ্গে নিয়েছে ভারতবর্ষীয় জমিদার-মহাজনদের। ধর্মধ্বজাধারীরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর উৎপীড়ন চালিয়ে নিরন্ন এবং অসহায় করেছে। এই অসাম্য দেখে নজরুলের কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে। তাই জনদরদি রোমান্টিক কবি সাম্যবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে কাব্যকাননে। মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবের মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।’

‘কাজী নজরুল ও তার সাম্যবাদী চেতনা’ প্রবন্ধে কবি ও লেখক আনোয়ার কামাল বলেছেন, ‘কৈশোরেই নজরুলের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ভিত্তি গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী সময়ে তাকে সাম্যবাদী হতে পথ মসৃণ করে দেয়। ‘রাণীগঞ্জে নজরুলের শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ নামে একজন প্রিয় বন্ধু জুটেছিলেন। নজরুল ইসলাম মুসলমান, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় হিন্দু-ব্রাহ্মণ, আর শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ খ্রিষ্টান। তিনবন্ধু একসঙ্গে খেলাধুলা করতেন, একসঙ্গে বেড়াতেন। এই যে তিন ধর্মের তিন বন্ধু একত্রে মেলামেশার কারণেই নজরুলের ভেতর সেই কৈশোর থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা গেড়ে বসেছে। পরবর্তী সময়ে তারই প্রতিফলন, তাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত করেছে।’

তাই তো তিনি মন্দির-কাবার চেয়ে মানুষের হৃদয়কে বড় জ্ঞান করেছেন সব সময়। কবি বলেছেন—‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।’ ‘সাম্য’ কবিতায় কবি স্রষ্টাকে মহিমাময় এবং মানুষের দেহ ও মনকেই তার ভজনালয় রূপে বিবেচনা করেছেন—
‘হেথা স্রষ্টার ভজন আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তার দুঃখের সিংহাসন।
সাড়া দেন তিনি এখানে তাহারে যে নামে যে কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে নামে ডাকে সে মাকে।’
পাশাপাশি তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতাটি বহুল প্রশংসিত। ‘নারী’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষে সাম্যের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করেছেন। কবির ভাষায়—
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
আর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি সবেচেয়ে বেশি সমালোচিত। এই কবিতায় কবি বলেছেন—
‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
হয়তো তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।’

কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের কবি। সাম্যের কবি। তাঁর বড় পরিচয় তিনি সাম্যবাদী কবি। নজরুলের সাম্যবাদ যেন সব মানবের মহামিলন। কবির ভাষায়—
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
কবি এখানে মানবতারই জয়গান গেয়েছেন। মানুষকে কখনো তিনি ঘৃণার চোখে দেখেননি। তাই কবি আবার বলেছেন—
‘বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।’
এমনকি মানুষকে তিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। কেননা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কারো আসল পরিচয় হতে পারে না। আসল পরিচয় হলো—আমরা সবাই মানুষ। ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেছেন—
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
এ ছাড়াও তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে—
‘জাতের চাইতে মানুষ সত্য
অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ ঘরে সব এক সমান।’

‘ঈশ্বর’ কবিতায় নজরুল ইসলাম ঈশ্বর অন্বেষণের ব্যাপারে বলেছেন, বনে-জঙ্গলে, পর্বত চূড়ায় ঈশ্বর অন্বেষণের কোনো প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর মানব মনেই অধিষ্ঠিত। আর শাস্ত্র অন্বেষণে না গিয়ে সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হতে বলেছেন। ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিরাজিত, তাকে বাইরে না খুঁজে নিজের মধ্যে ডুব দিতে হবে। কবি যথার্থই বলেছেন—
‘স্রষ্টারে খোঁজো—আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।’
সর্বোপরি কবি তাঁর কবিতায় স্বপ্নের দেশ-আদর্শ দেশের কথা বলেছেন। এমন দেশ যেখানে রাজা-প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ এ স্থানে বর্ণবৈষম্য নেই, এখানে সাদা ও কালোদের জন্য আলাদা গোরস্তান বা গির্জা নেই। এখানে কোনো ধর্মের বা শাস্ত্রের ভেদ নেই, নেই কোলাহল। সেখানে পাদ্রী পুরুত মোল্লা এক পাত্রে জল খেলেও জাত যাবে না, স্রষ্টা বাতিল হবে না।

আমরা দেখতে পাই, কাজী নজরুলের কবিতার প্রধান বিষয় বিপ্লব আর সাম্যবাদ। যুগ-চেতনা তাকে বিপ্লবের মন্ত্র শিখিয়েছে আর সামাজিক বৈষম্য তাকে সাম্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রাসী করে তুলেছে। কবি নজরুল ইসলাম একসময় কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাহচর্যে এসেই আরও বেশি সাম্যবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন থেকেই সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ পুরোদমে ঘটে নজরুলের বিভিন্ন লেখায়। কাজী নজরুল কর্তৃক প্রকাশিত ও পরিচালিত ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা হয়ে ওঠে সাম্যবাদী চিন্তার মুখপত্র।

তাঁর বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে সাম্যবাদ, নারীর মর্যাদা ও মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা প্রেম। একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে তার সমসাময়িক অবস্থা বা প্রেক্ষাপটের ওপর। কোনো সচেতন শিল্পী তার সময় ও সমাজকে কখনো অস্বীকার করতে পারেন না। কাজী নজরুল ইসলাম তার ব্যতিক্রম নন। তিনি দেশের এমন এক সংকটময় মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন; যখন মুক্তি সংগ্রামের স্লোগান আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল। ফলে এ আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব পড়েছে তার কাব্যে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার নেশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদী।

যেহেতু সাম্যবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত এ বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, তা একান্তই অভিনব। এখানেই কাজী নজরুল ইসলামের কবি চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।