আমিনুল ইসলামের কবিতা: ভাবের শিল্পিত প্রকাশ

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২৪
কবি আমিনুল ইসলাম

হোসেনউদ্দীন হোসেন

কবিতা রসময় বস্তু এবং ভাবজগতের ভাবের আবেগমন্থিত উচ্ছসিত অভিব্যক্তির শিল্পিত প্রকাশ। এই প্রকাশক্ষমতা যিনি অর্জন করেন, তিনিই কবি। ভাবই হচ্ছে কাব্যের আধার। শব্দের পর শব্দ সাজানো কবিতা নয়। শব্দ দ্বারা ভাবের রূপসৃষ্টি করতে পারলেই কবিতা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ রূপটি হলো বাকপ্রতিমা। যাঁর কাব্য দ্বারা ভাব-কল্পনার মূর্তি গড়তে পারেন, তারাই প্রকৃত কবি।

আমিনুল ইসলামের ‘কবিতাসমগ্র’র মধ্যে বহু কবিতায় এই কাব্যগুণ আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, সে কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাণের দ্যোতনা এবং নিবিড় সুরমূর্ছনা। উদাহরণ হিসেবে আমি বেশ কয়েকটি কবিতার কথা উল্লেখ করছি। প্রথমেই আলোচনা করছি ‘চীনা বাদামের খোসা’ কবিতাটি দিয়ে—

পড়ে আছে খোসা-উড়ে গেছে দিন
একদিন খোসাগুলোরও দিন ছিল
বিক্রেতা বালকের হাত ঘুরে
চলে গেছে অবসর-প্ররোচিত ভাগাড়ে।
খোসাগুলো ছুঁতে পারেনি ঠোঁটে
নেইলপালিসের ডগায় ভেঙে চুরে
পড়ে আছে অসহায় নিয়তির ধূলোয়।

ঐ ঠোঁট হয়ত আজ বেদখল হওয়া চর;
অথবা ঝোপঝাড়ে আকীর্ণ ভুলের ভূগোলে
সে আজ রঙ-চটে যাওয়া কোনো প্রত্ন-ইঁদারা!

ও খোসা, ও চীনাবাদামের খসে-পড়া যৌবন,
তোমাকে ভাতারমারির বিলে কুড়িয়ে পাওয়া
পাখির পালক ভাবি; বুকে হাত দিয়ে
তোমাকে ভাবি: নিষাদ সময়ের স্মৃতির সাফল্য।
(জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার)

চৌদ্দ পঙক্তিতে কবিতাটি রচিত। এ কবিতার মধ্যে বাহুল্য কোনো শব্দ নেই। শব্দের বাঞ্জনা আছে। পরিমিতি বোধ আছে। একটা বাদামকে কেন্দ্র করে জীবনের ইতিবৃত্ত রূপকথার মতো তুলে ধরা হয়েছে। জীবন সম্পর্কেও রয়েছে বাস্তবতার কল্পনা ও নিখুঁত ভাবনা। ‘পড়ে আছে খোসা উড়ে গেছে দিন’—ছত্রটির মধ্যেও রয়েছে বিষাদের সুর ও গভীর বেদনাবোধ। জীবন তো এই রকমই। এক দিন তো সে জীবন্ত ছিল—এখন মৃত। লুপ্ত হয়ে গেছে নিয়তির ধূলোয়। বেশ কিছু উপমা আছে। যেমন ‘ঐ ঠোঁটও হয়ত আজ বেদখল হওয়া চর;’ কিংবা ‘রঙ-টচে যাওয়া প্রত্ন-ইঁদারা।’ ‘বেদখল হওয়া চর’ ‘রঙ-চটে যাওয়া প্রত্ন ইঁদারা’ বাক প্রতিমায় মিশে গিয়ে গভীর এক ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। ‘প্রত্ন’ শব্দটি বিশেষ অর্থবোধক। ‘ভাতারমারির বিলে কুড়িয়ে পাওয়া পাখির পালক ভাবি; বুকে হাত দিয়ে তোমাকে তোমাকে ভাবি:’ ছত্রটি উৎপ্রেক্ষা হিসেবে ফুটিয়ে তোলায় কবিতাটির নির্মিত রসময় হয়ে উঠেছে। কবি এই কবিতায় শুধু প্রত্ন সময়ের প্রতিমা নির্মিত করেননি—জীবন সস্পর্কে তার যে বোধ সেটিও কাব্যভাষায় স্পষ্ট করে তুলেছেন।

আমিনুল ইসলামের আর একটি কবিতার নাম: ‘কোনো এক বিকেলের ছবি।’ এই কবিতায় ‘বিকেল’ এবং ‘সন্ধ্যার’ মধ্যবর্তী একটি সময়ের দৃশ্যকল্প কবি অঙ্কন করেছেন। কবিতাটি ছন্দবদ্ধ। দৃশ্যটি সম্পর্কে কবি বর্ণনা করেছেন: পুকুরের জল পা ডুবিয়ে দিন একেলা বসে আছে। বিকেল এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘বিকেল’ এবং ‘সন্ধ্যার’ মধ্যবর্তী দূরত্ব সামান্যমাত্র। মানুষের মুখ গহ্বরের ওপরের ঠোঁটের সঙ্গে নিচের ঠোঁটের যতটুকু দূরত্ব ঠিক ততটুকু। একটার সঙ্গে আর একটা জোড় লাগার মুহূর্ত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। উপমা দিয়েছেন কবি নারীর খোঁপায় বাঁধা খুলে দেওয়া ছড়িয়ে পড়া চুলের সঙ্গে। ঠিক সন্ধ্যার অন্ধকারও তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে।
‘পুকুর জলে পা ডুবিয়ে একলা বসে দিন
বিকেল এসে থেমে আছে দু’ অধরের মাঝ
যদিও ধরে চুলের খোপা ক্লিপ দুই কি তিন
খোপা ভেঙে একটু পরে ছড়িয়ে যাবে সাঁঝ।’
কবির এই ভাবকল্পনা কাব্যরূপ পেয়ে সফল হয়ে উঠেছে, একটা মুহূর্তটিকে নিয়ে এই কবিতাটি রচনা করেছেন তিনি। ‘বিকেল’ ও ‘সন্ধ্যা’র এই অপরূপ দৃশ্য—
সাঁঝ ও বিকেল দুয়ের মাঝ আত্মীয়তাকারী
দাঁড়িয়ে ঠাঁয় নিষ্পাহারা একটি শূন্যলোক
শূন্যলোকে চেয়ে আছে শান্তি অভিসারী
আহ্নিকগতির অভিজ্ঞতায় ক্লান্ত দুটি চোখ।
সমগ্রদিনের শেষে যে অখণ্ড আবহ আকাশ এবং পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয়, সেটিরই সার্থক রূপ দিয়েছেন কবি।

সুন্দর কী! কবির বোধে সুন্দর অসুন্দরও হয় এবং অসুন্দরও সুন্দর হয়ে ওঠে। কবি যা ভাবেন, তা’ অন্তর দিয়েই ভাবেন। এই ভাবনা-ভাবুকের ভাবনা। ভাবনাটা লীলাময়। মনে হয় সবকিছু লীলাখেলা। কবির মনে যা’ আনন্দ দেয়, কবির কাছে সেটিই সুন্দর। অর্থাৎ সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য। সমুদ্রের সঙ্গে, অরণ্যের সঙ্গে, আকাশের আলোকবীণার সঙ্গে সুর মিশিয়ে কবি উপলব্ধি করেছেন—
‘দ্যাখো-নীল-সাদা প্রচ্ছদে ভাঁজ হয়ে শুয়ে আছে সুন্দর
লাল আলো চুমে যায় সাদা-কালো চোখ
ভোরের হাওয়া এসে খেলা করে মেঘভাঙা চুলে
দেরি নেই আর,—
শিহরিত আবেশে খুলে যাবে দুইরঙা নন্দরের ভাঁজ
খুলে যাবে বাসি পরিধান।
যদ্যপি পাহারা শাসিত উঠোন
তথাপি সুরভিত মুগ্ধতায় মাতোয়ারা জগতের সকল পাহারা।’
কবি লীলা উপলব্ধি করেন কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারে না। তাই তিনিও স্বীকার করে নেন এবং বলেন:
‘সুদখোর রোদের উঠোন—
দণ্ডপ্রাপ্ত কবিকে প্রেমিক হয়ে বোধিপ্রাপ্ত হতে হয়।
(শুয়ে আছে সুন্দর)।’

এই অবস্থাকে কাব্যভাষায় বলা হয়: ‘আনন্দং সম্প্রয়ন্ত্যভিসংবিশান্তি।’ যা’ কিছু তা’ সবই পরিপূর্ণ আনন্দের দিকে চলেছে। ধুঁকতে ধুঁকতে রাস্তার ধূলোর ওপরে মুখ থুবড়ে মৃত্যুর দিকে চলছে না। যথার্থ আনন্দই সমস্ত দুঃখকে নিবারণ করতে পারে। অসীম দুঃখ স্বীকার করে নেওয়ার শক্তিই হলো প্রতিভা। এটাই হচ্ছে কবির নিজস্ব প্রকাশ। তাই ‘যদ্যপি পাহারা শাসিত উঠোন’ এবং ‘সুদখোর রোদের উঠোন’ সুরভিত মুগ্ধতায় জগজ্জীবনকে মাতোয়ারা করে দিচ্ছে। এটাও ভাবুক কবির পরম একটি উপলব্ধি। এই উপলব্ধির মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবনযাপনের কাঠিন্য ও কোমলতা। রয়েছে সংঘাত, রয়েছে ভালোবাসার মুগ্ধতা, রয়েছে বৈচিত্র্যময় ওঠানামার ক্ষত।

প্রকৃতির সঙ্গে ভাবুক মানুষের সহজমিলন হয়। সে আপন ভাবরসে বিশ্বের দেহে আপন রং লাগায়, মানুষের রং। স্বাভবত বিশ্বজগৎ ভাবুকের কাছে তার বিশুদ্ধ প্রাকৃতিকতায় প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে মানুষ তো শুধু প্রাকৃতিক নয়। সে মানসিক। সে মনের ভাবনা দ্বারা সবকিছু মিলিয়ে নেয়। বস্তুবিশ্বের সঙ্গে মনের সামঞ্জস্য ঘটায়। সমগ্র বিশ্বমণ্ডল তার ভাবানুষঙ্গ মণ্ডিত করে তোলে। তাই দেখা যায় যে, মানুষের ব্যক্তিস্বরূপের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির মানবিক পরিবর্তন যেমন ঘটে; তেমনই পরিবর্ধনও ঘটে। প্রকৃতিকে মানুষ মানবভাবের সঙ্গে যতই যুক্ত করে নিয়েছে; ততই মানুষের মনের পরিণতি ও বিশালত্ব ও বিশেষত্ব লাভ করেছে। মানুষের মনের রসে বিশেষ রসের রূপ নিয়েছে প্রকৃতি। এই রূপরসটি মানুষই দিয়েছে প্রকৃতিকে।

আমিনুল ইসলামেরও কাব্যভাবনার মধ্যে আছে বিশ্বজগত ও বিশ্বপ্রকৃতি। বিশ্বপ্রকৃতিকে তিনি নানাভাবে নানারকম ভাবে অবলোকন করেছেন। দেখেছেন ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য, নদ-নদী, অরণ্য-পাহাড়, সমুদ্র। আকাশের চন্দ্রজ্যোৎস্না, দিগন্ত নীলিমা। মানুষের বিপন্ন অস্তিত্ব। প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ। দেখেছেন দিন-রাত্রি পরিক্রমা। অর্থাৎ চলমান জীবন সংগ্রাম তার কবিতার ছত্রে অনায়াসে শিশির বিন্দুর মতো, শস্যের দানার মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন-

১.
পাথর তো নই—তথাপি পাথর হয়ে আছি
ঘষা ঘষা ঘষা...
ক্ষয়ে যাওয়া... ক্ষয়ে যাওয়া... এবং ক্ষয়ে যাওয়া
(পাথর নিয়তি/ আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট)

২.
অথবা সে নিজেই নদী ছিল একদিন। সেই স্রােত-সেই নদী।
একবুক শিবনৃত্য নিয়ে জমে আছে আড়ালে বসে থাকা বুকে।
(পাথরের নদী/ আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট)

৩.
শুধু এতটুকু সবুজ আড়াল—শুধু এতটুকু শুদ্ধ ছায়া
আড়ালে থাবার দাগ-দৃষ্টিতে বিধ্বস্ত ছায়া।
(বাঘ হরিণের সংসার/ আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট)

৪.
প্রবাহ মানেই ঢেউ-ঢেউ লেগে ভেঙে পড়ে অন্তরঙ্গ কূল
পেছনে জাগিলে দ্বীপ-সেই দ্বীপে বহু ধূলো কিছু চাঁপাফুল।
অদেখা ধূসর চক্র—আরো আছে ব্রতবদ্ধ হলুদ যাতনা
পথে পথে নিষ্পেষণ—সে পথেই বিস্তারিত জলের সাধনা।
(ঢেউ লাগা দিন/ আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট)

৫.
জেগে উঠেই হয়ে যাবে স্রােত ঢেউ বাঁক;
কিন্তু কোথাও কোনো নৌকার ছায়া নেই।
ভীরু সকাল হয়ে কাঁপছে অপ্রস্ফুটিত দুপুর।
(অপ্রস্ফুটিত দুপুর/ জোছনার রাত বেদনার বেহালা)

৬.
পদ্মার কাছে ফিরে এসে
আমিও মুছে ফেলেছি আমার ব্যর্থতার নুন; দেখো পিঠে শিশু নিয়ে
আমি পাড়ি দিতে পারি শ্রাবণ গাঙের ফেনায়িত আক্রোশ।
(কপোতাক্ষ: সে এক হাফ সাঁতারের স্মৃতি/ জোছনার রাতে বেদনার বেহালা)

৭.
দেখে যাও সোনালি দানায় ভরে
গেছে ঘরদোর। তবু জমে আছে
কতিপয় বেয়াড়া বিচালির গোড়া;
চৈত্রের খৈলানে এবার বহ্নোৎসব।
(স্রােতের ভাঙন চরের উৎসব/ শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)

৮.
সুদখোর দুপুরের রোদে পুড়ে উঠি আমি নিজেও।
গালে হাত দিয়ে আমাকে দেখে ডালপালাময় অতীত—
(এই আমি/ শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)

৯.
কিন্তু আগাছার উৎপাত মাথায় নিয়ে
আমি আর কতকাল বন্দি থাকিবো এভাবে?
আর কতদিন পাশ দিয়ে চলে যাবে
পৌর বিভাগের লোকজন!
আর কত রাত শুনতে হবে
গোখরো নীরবতার খোলস বদলানোর শব্দ?
(বাড়ির দুঃখ অথবা দুঃখের বাড়ি/ শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)

১০.
শীত এসে কড়া নাড়ে—জাগো ভাই জাগো অঘ্রাণ!
কোথায় ধানের পালা! ঘুঘু খোঁড়ে বাথান-উঠান।
(শীত এসে কড়া নাড়ে ধোঁয়া ওঠা হেমন্তের দ্বারে/ শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)

চারদিকের পরিবেশ আলো অন্ধকার জনজীবন লোকালয় কবির ভাবনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। উল্লেখ করা যায়, কবিরা মানস নেত্রে যে ভুবন দেখেন; সে ভুবন ছায়ার মতো, মায়ার মতো, যাকে ধরতে গেলে ধরা যায় না, তাই সত্য, করুণ সত্য, মধুর সত্য, গভীর সত্য। সেই সত্যকেই সংসারের সমস্ত আনাগোনার ওপরে উজ্জ্বলতা দান করেন কবি তার বাণীর মধ্যে। ‘সুদখোর দুপুরের রোদ’, ‘আগাছার উৎপাত’, ‘গোখরো নীরবতার খোলস বদলানোর শব্দ’, ‘ঘুঘু খোঁড়ে বাথান-উঠান’ ছবির মতো পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এই প্রকাশতত্ত্বই হলো সৃষ্টির তত্ত্ব সত্যের তত্ত্ব। রূপেরও সীমা আছে কিন্তু রূপ যখন তার সীমায় প্রদীপের মতো অসীমের আলো জ্বালিয়ে ধরে; তখনই সত্য প্রকাশ পায়। প্রকাশটি কেমন? প্রকাশটা হচ্ছে তরুহীন মাটির মধ্যে ছায়াহীন মধ্যাহ্ন রৌদ্রের মতো। তাই কবির ভাবনার আলোকে সেই সত্যই রূপ পেয়েছে—যে সত্য রূপের অবয়ব মূর্তিমান করেছেন—
‘কড়িকাঠে ঝুলে আছে দিন
ধূসর রোদের ঠোঁটে লালা
নাড়ি টিপে ফিরে যায় যম;

ও দিন তুমি নেমে এসো
কথা দিচ্ছি আর ভুল হবে না
দ্যাখো তোমার জন্য এনেছি—
শরতের ঘুড়ি
চিরকুমার স্বপ্নের রাত
এবং আরও কত কী!
তুমি ফিরে না এলে, বলো—
কী করে আমি বাজাই
তোমার দেয়া সেই পাগলপারা বাঁশি?
(কড়ি কাঠে ঝুলে আছে দিন/ শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)

‘কড়িকাঠে ঝুলে আছে দিন’, ‘ধূসর রোদের ঠোঁটে লালা’ শব্দগুচ্ছে যে ব্যঞ্জনাধ্বনি আকুলিত হয়ে উঠেছে, এটাই হলো কবির আত্মগত সৃষ্টিসত্য। এই কবিতায় রয়েছে একটা নতুন জাগরণের উপলব্ধি—রয়েছে চৈতন্যের নতুন চাঞ্চল্য। মন নতুন সৃষ্টির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অন্তর খুঁড়ে সে যা চায়, সেটাকে সে নিজের চিন্তায় নিজের বাসনাকে রূপ দেয়। অরূপকে সে সত্য সৃষ্টি দ্বারা রূপময় করে অঙ্কন করে। উপর্যুক্ত কবিতার ভাবনায় ‘কড়ি কাঠে ঝুলে থাকা দিন’-এর বদলে কামনা করেছেন কবি এমনই একটা দিনের—যে দিনগুলোতে থাকবে শরৎ ঋতুর প্রশান্তি, শ্যামল মেঘের ছায়া, অনাবিল আনন্দের ফল্গুধারা। কবিতাটি যে সার্থক কবিতা হয়ে উঠেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমিনুল ইসলাম নিজের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন—‘আমি মনের দিক হতে একেবারেই প্রকৃতিলগ্ন। ঘুড়িবালক যেমন তার ভোঁ-কাটা ঘুড়ির কথা ভুলতে পারে না, আমিও পারি না আমার হারিয়ে-যাওয়া জন্মগ্রামের কথা ভুলে যেতে। সে-সব স্মৃতি ও বাস্তবতার নিত্য টানাপোড়েন। নদী আমার ব্যক্তিগত জীবনে, আমার স্বপ্নের উঠোনে এবং আমার কাব্যভাবনায় প্রায় স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে আছে। নদী নিয়ে আমি প্রায় স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্ন দেখি। আর কবিতা তো এক ধরনের স্বপ্ন-সৃষ্টিই।’ এ উচ্চারণের মধ্যেই রয়েছে আমিনুল ইসলামের জীবন বোধ। রয়েছে সৃষ্টির বেদনা। সৃষ্টির তত্ত্বই হলো এই।

আমিনুল ইসলামের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে একই সুর-একই বেদনা ও আনন্দের প্রকাশ। রয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্বন্ধ, অর্থাৎ সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, কল্যাণের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ। রয়েছে তাদেরও কথা-যে মানুষ লোভী এবং নির্লজ্জ। মত্তকরীর মতো যারা পৃথিবীকে দলন করছে। কবি উচ্চারণ করেছেন—

ক.
‘আমার বিশ্বাসের গায়ে ভয়ঙ্কর কৃষ্ণ লেবেল!
আমার অবিশ্বাসের গায়ে জোরজুলুমের হাত!
আমার আত্মবিশ্বাসের দেয়ালে অজস্র গোলার ঘা!
আমার মুগ্ধ বাতায়নে টিকটিকির নির্ঘুম চোখ!—
(শৃঙ্খলিত কোকিলের গান/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)

খ.
সত্তার গভীরে বারুদের গন্ধে টের পাই—
আমার শেকড় সংশ্লিষ্টতায় যে মাটি জল।
তা কোনো এক উত্তাল অতীতে পুড়েছিল
পোড়ামাটি-নীতির লোভী বর্বর অনলে।
(শেকড় ছুঁয়ে/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)

গ.
যা’কিছু সবুজ নিবিড় মাটিতে মূল
অলখে নিয়ত খায় কৌটিল্যের ঘূণে
রঙিন গেলাসে আড্ডা হুলস্থূল
মাটির কলসে কান্না উঠেছে জমে।
(এই নদী এই হাওয়া/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)

ঘ.
আমাদের চারপাশে অকৃতজ্ঞ হাওয়া
এ হাওয়া ছুঁয়ে গেছে প্রান্তরেরও বুক—
(অকৃতজ্ঞ হাওয়া/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)
এত বৈরিতা ও রূঢ়তার মধ্যেও কবি নৈরাশ্য ও হতাশার কথা বলেননি। তার মনে জেগে উঠেছে যে প্রত্যয়বোধ, তা হলো—
যাবে তারা, তবে যাক। অবন্ধু বিকেলে
আলোর সঞ্চয় নিয়ে থেকে যাবো আমি—
---  ---  ---  ---  ---
ধাবমান সময়ের বাতিল পশ্চাতে
কে যেন অদৃশ্যে তোলে মহাম্যুজিয়াম
ধূলিমাখা প্রত্নধন আমার কোঁচাতে
(উজান বাসনা/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)

প্রকৃত কবির কোনো তথ্য বা তত্ত্বকে উপলক্ষ্য করে কবিতা লেখেন না। যদি কেউ লেখেন তবে তা কবিতা হবে না। প্রয়োজনের যোগে যা অতি কাছে, তা থাকে ব্যক্তিপুরুষের সম্যক অনুভূতির বাইরে। অর্থাৎ যেসব বস্তুর সঙ্গে কবির ব্যবহারের সম্বন্ধই প্রধান, সে বস্তু সাধারণ শ্রেণিভুক্ত হয়ে যায়, তার বিশিষ্টতা কবিদের কাছে অগোচর হয়ে পড়ে। কবিতায় অতি কাছের বস্তুর প্রবেশ ঘটে খুবই কম, কারণ তার দিকে যখন কবি তাকান; তখন সেই বস্তু কবির কাছে চরমরূপে প্রকাশ পায় না। নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর স্বরূপের মিল ঘটে গেলে সেই বস্তু হয়ে যায় কবির কাছে প্রত্যক্ষ এবং বিশেষ। কবির মনের মানুষের সঙ্গে বস্তুর মিলন হওয়া চাই। প্রয়োজনের বেড়া অতিক্রম করে কল্পনার ভূমিকার যে বস্তু কবির মনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, সেটাই কবির কাছে বাস্তব। এই বাস্তববোধই কবির মনে কবিতার জন্ম দেয়। কবিরা দুই জগতের বাসিন্দা। একটি হচ্ছে বাস্তব জগত অপরটি হচ্ছে কল্পনার জগত। কবি কল্পনা জগতের বোধের বিশিষ্টতাকে তাঁর কবিতায় দেদীপ্যমান করে তোলেন। অরূপকে বিশেষ রূপে সৃষ্টি করে প্রকাশ করেন। তাঁর সৃষ্টি সসীম, ব্যক্তিপুরুষের আত্মপ্রকাশে সীমাতীত। এই ব্যক্তি পুরুষই হলো মানুষের অন্তরঙ্গ ঐক্যতত্ত্ব। এটা তার চিত্তের কেন্দ্র থেকে বিকীর্ণ হয়ে বিশ্বপরিমণ্ডলিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। আছে দেহের মধ্যে, আছে মনের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে—মনকে অতিক্রম করে, বর্তমানকে অধিকার করে অতীত এবং ভবিষ্যতের উপকূলকে প্লাবিত করে।

কবিমাত্রই রোমান্টিক, কম আর বেশি। যার ভেতরে রোমান্টিকতার ছোঁয়া নেই, তিনি কবি নন। আবার রোমান্টিক সর্বস্বতাও আধুনিক কবি হওয়ার পথে বাধা। আমিনুল ইসলাম বর্তমানকে প্রত্যক্ষ করলেও সাময়িক বিষয়গুলো আড়াল না করলেও নিজস্ব উপলব্ধিতে কাব্যভাবনায় যে প্রকাশ করেছেন, এর মূলে রয়েছে রোমান্টিক মন! তিনি চেনা জিনিসকে উপস্থাপনের অচেনার রূপ-রস-গন্ধ লাগিয়ে তা করেছেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা পাঠে দেখা যায়, তিনি কল্পনা জগতের বোধের বিশিষ্টতাকে তাঁর কবিতায় দেদীপ্যমান করে তুলেছেন এবং অরূপকে বিশেষ রূপে সৃষ্টি করে প্রকাশ করেন। ফলে তার সৃষ্টি হয়েছে উঠেছে বোঝা আর চেনা আর না-চেনার মাঝামাঝি শিল্প, যা প্রকৃত কবিতার মূল শক্তি। বহুমুখী জীবনাভিজ্ঞতা, সূক্ষ্ণ কল্পনাশক্তি, শাণিত শিল্পবোধ, বাস্তবতার সাথে কল্পনাকে জুড়ে নেওয়ার শক্তি এবং একখানি রোমান্টিক মন তাকে প্রকৃত কবি হতে সহায়তা করেছে।

সূত্র: বীরেন মুখার্জি সম্পাদিত ‘দৃষ্টি, আমিনুল ইসলাম সংখ্যা’, ২০১৯, পৃষ্ঠা- ৪৫।

লেখক: হোসেনউদ্দীন হোসেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাশিল্পী, কবি ও গবেষক।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।